বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

দুই চাকায় ভরসা বাড়ছে   

  •    
  • ৩ জুন, ২০২২ ০৮:২৫

গত পাঁচ বছরে দেশে বাইসাইকেলের চাহিদা বেড়েছে তিন গুণ। ২০১৪ সালে বার্ষিক চাহিদা ছিল পাঁচ লাখ পিস। এখন তা বেড়ে হয়েছে ২০ থেকে ২৫ লাখ। স্থানীয় বাজারে চাহিদার ৩০ শতাংশ জোগান দিচ্ছে দেশি ব্র্যান্ডগুলো।  

বনশ্রীর বাসা থেকে বাংলামটর অফিসে প্রতিদিন যাওয়া-আসা চাকরিজীবী সুমন সরকারের কাছে ছিল পাহাড় ডিঙানোর মতো। যানজট, যানবাহনের সংকটসহ নানা যন্ত্রণায় কাহিল অবস্থা। এই পথ কিছু সময় রিকশায়, কিছু সময় টেম্পোতে, তারপর বাসে দিতেন পাড়ি।

চলাচলের সমস্যা দূর করতে এক সহকর্মীর পরামর্শে গত মাসে বাইসাইকেল কেনেন সুমন। অভিজ্ঞতা জানতে চাইলে বলেন, ‘স্বস্তিদায়কভাবে চলাচলে বাইসাইকেলের বিকল্প নেই। দূষণমুক্তভাবে বাড়তি ব্যয় ছাড়া নির্দিষ্ট সময়ে গন্তব্যে পৌঁছাতে ধীরে ধীরে জনপ্রিয় হচ্ছে এই দুই চাকার বাহন।’

রাজধানীতে বাহন হিসেবে বাইসাইকেলের প্রতি মানুষের আগ্রহ বাড়ছে দিন দিন। বিশেষ করে যানজটসহ রাস্তার নানা যন্ত্রণা থেকে বাঁচতে ভরসার নাম বাইসাইকেল। যানজটের মধ্যেও রাস্তার একপাশ দিয়ে চলে যায় সাইকেল। সাইকেল চালানো স্বাস্থ্যসম্মতও।

দেশে বড় হচ্ছে বাইসাইকেলের বাজার। একসময় নির্দিষ্ট কয়েকটি মডেলের সাইকেল থাকলেও এখন মডেলে এসেছে বৈচিত্র্য। স্থানীয়ভাবে উৎপাদন হওয়ায় কিছুটা সাশ্রয়ী দামে কিনতে পারেন ক্রেতা।

কেন বাড়ছে চাহিদা

বাইসাইকেল পৃথিবীর সবচেয়ে সস্তা বাহন। রক্ষণাবেক্ষণেও খরচ কম। নেই বাড়তি তেল বা মবিলের খরচ। পরিবেশের কোনো ক্ষতি করে না। সাধ্যের মধ্যে অনেকে এটা কিনে ব্যবহার করতে পারেন। এ জন্য পৃথিবীর অনেক উন্নত শহরে বাইসাইকেল ব্যক্তিগত বাহন হিসেবে জনপ্রিয়তা পেয়েছে।

আবার মোটরসাইকেলের ড্রাইভিং লাইসেন্স কিংবা গাড়ি রেজিস্ট্রেশন করতে অনেক ঝক্কি পোহাতে হয়। ঝামেলা এড়াতে অনেকে বাইসাইকেলে ঝুঁকছেন। কারণ লাইসেন্স-রেজিস্ট্রেশন কোনোটাই দরকার নেই বাইসাইকেলের জন্য।

নিয়মিত সাইকেল চালালে আলাদা করে ব্যায়াম করার বা নিয়ম করে হাঁটাহাঁটির দরকার পড়ে না। এ জন্যও এটার ব্যবহার বাড়ছে।

পাশাপাশি যেকোনো জায়গায় এটা রাখা যায়। গ্যারেজের জন্য বাড়তি খরচও গুনতে হয় না।

সবচেয়ে বড় সুবিধা সাইকেল নিয়ে কোনো জ্যামে দুর্ভোগ পোহাতে হয় না। জ্যামে আটকা পড়লে সাইকেল কাঁধে উঠিয়ে হেঁটেই পার হয়ে যেতে পারেন চালক।

বাইসাইকেলের উৎপাদন

সাইকেলের বাজার প্রতি বছর বড় হচ্ছে। ২০১০ সাল পর্যন্ত এ বাজারের পুরোটাই ছিল আমদানিনির্ভর। ব্যবসায়ীরা বিদেশ থেকে পূর্ণাঙ্গ সাইকেল কিংবা বিভিন্ন যন্ত্রাংশ এনে সংযোজন করে বাজারজাত করছেন, তবে দিন দিন চাহিদা বাড়ায় স্থানীয় উদ্যোক্তারাও বিনিয়োগে এসেছেন। এতে সাশ্রয়ী দামে মিলছে বিভিন্ন ধরনের দেশি সাইকেল।

বাইসাইকেলের ব্যবসায়ী সংগঠনগুলোর তথ্য অনুযায়ী, গত পাঁচ বছরে দেশে সাইকেলের চাহিদা বেড়েছে তিন গুণ। ২০১৪ সালে বার্ষিক চাহিদা ছিল পাঁচ লাখ পিস। এখন তা বেড়ে হয়েছে ২০ থেকে ২৫ লাখ। এর মধ্যে স্থানীয় বাজারে চাহিদার ৩০ শতাংশ জোগান দিচ্ছে দেশি ব্র্যান্ডগুলো।

দেশি সাইকেল

১৯৯৬ সালে সরকারি সাইকেল তৈরির কারখানা কেনার মাধ্যমে প্রথম বেসরকারি উদ্যোক্তা হিসেবে সাইকেল তৈরির বাজারে নাম লেখায় মেঘনা গ্রুপ। ২০১১ সাল থেকে প্রতিষ্ঠানটি বিভিন্ন ব্র্যান্ডের সাইকেল স্থানীয়ভাবে বাজারজাত শুরু করে।

২০১৪ সালে সাইকেল উৎপাদনে নাম লেখায় প্রাণ-আরএফএল গ্রুপ। ‘দুরন্ত’ ব্র্যান্ড দিয়ে তাদের এ যাত্রা শুরু।

বাংলাদেশ বাইসাইকেল মার্চেন্টস অ্যাসেম্বলিং অ্যান্ড ইমপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিবিএমএআইএ) তথ্য অনুযায়ী, শুধু ঢাকার বংশালেই দুই শতাধিক সাইকেলের দোকান রয়েছে। আর সারা দেশে এ রকম খুচরা বিক্রেতা প্রতিষ্ঠান রয়েছে সাড়ে চার হাজার।

এখন ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী ও রংপুর মিলিয়ে প্রায় ৮০ শতাংশ আমদানিকারক বিদেশ থেকে সাইকেল আনছেন। এর বেশির ভাগই যন্ত্রাংশ এনে দেশে সংযোজন করছেন।

প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের বিপণন পরিচালক কামরুজ্জামান কামাল নিউজবাংলাকে বলেন, ‘স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক উভয় বাজারে সাইকেলের চাহিদা বেড়েছে। আগের থেকে বাইসাইকেলের ব্যবহার বেড়েছে অনেক। আমরা সাশ্রয়ী দামে ক্রেতাদের বাইসাইকেল দিতে পারছি।’

বছরে ৬ লাখ বাইসাইকেল তৈরির সক্ষমতা আছে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘আগে কম উৎপাদন করা হতো, কিন্তু এখন আন্তর্জাতিক বাজার থেকেও প্রচুর ক্রয়াদেশ আসছে। অনেক সময় চাহিদা মেটানোও সম্ভব হচ্ছে না, তবে এখন আমরা সক্ষমতা বাড়িয়েছি।’

চাহিদা বৃদ্ধির কারণ হিসেবে তরুণদের মধ্যে স্বাস্থ্য সচেতনতা বাড়ার প্রবণতার কথা জানিয়ে কামাল বলেন, ‘রপ্তানি ও অভ্যন্তরীণ চাহিদার বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে ২০২২ সাল থেকে আমরা বছরে ১০ লাখ পিস সাইকেল তৈরির পরিকল্পনা নিয়েছি।’

নিজেদের সক্ষমতা আরও বাড়ানো হচ্ছে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘আগে হবিগঞ্জে আমাদের একটা কারখানায় বাইসাইকেল তৈরি হতো। এ বছর রংপুরে আরও একটা কারখানা চালু করেছি। ইতোমধ্যে পরীক্ষামূলক উৎপাদন শুরু হয়েছে সেখানে।’

রপ্তানি আয় বাড়ছে

রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর তথ্য অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের ১১ মাসে (জুলাই-মে) বাইসাইকেল রপ্তানি করে আয় হয়েছে ১৫ কোটি ৬৫ লাখ ডলার। আগের অর্থবছরের একই সময়ে যা ছিল ১২ কোটি ২ লাখ ডলার। প্রবৃদ্ধি ৩০ দশমিক ২১ শতাংশ।

বিগত ২০২০-২১ অর্থবছরে বাইসাইকেল রপ্তানি করে ১৩ কোটি ১০ লাখ ডলার আয় করে বাংলাদেশ।

বাইসাইকেল রপ্তানি বাড়াতে ১ জুলাই থেকে ৪ শতাংশ হারে নগদ প্রণোদনা ঘোষণা করেছে সরকার। অর্থাৎ কোনো রপ্তানিকারক ১০০ টাকার সাইকেল রপ্তানি করলে সরকারের কোষাগার থেকে তাকে ৪ টাকা দেয়া হবে।

১৯৯৫-৯৬ অর্থবছরে তাইওয়ানের কোম্পানি আলিতা বাংলাদেশ লিমিটেড স্বল্প পরিসরে বাংলাদেশ থেকে বাইসাইকেল রপ্তানি শুরু করে। পরে এ ধারায় যুক্ত হয় মেঘনা ও প্রাণ-আরএফএল গ্রুপ।

এগুলো ছাড়াও জার্মান বাংলা, আলিতা ও নর্থবেঙ্গল নামের তিনটি প্রতিষ্ঠান ঢাকা, গাজীপুর ও চট্টগ্রামে তাদের কারখানা থেকে উৎপাদিত সাইকেল রপ্তানি করছে।

রপ্তানিকারকরা জানান, বর্তমানে ফ্রিস্টাইল, মাউন্টেন ট্র্যাকিং, ফোলডিং, চপার, রোড রেসিং, টেন্ডমেড (দুজনে চালাতে হয়) ধরনের বাইসাইকেল রপ্তানি হচ্ছে।

এসব সাইকেল তৈরির জন্য কিছু যন্ত্রাংশ বাংলাদেশের বাইরে থেকে আমদানি করতে হলেও বেশির ভাগই দেশে তৈরি হচ্ছে। বিশেষ করে চাকা, টিউব, হুইল, প্যাডেল, হাতল, বিয়ারিং ও আসন তৈরি করছে প্রতিষ্ঠানগুলো।

৫ হাজার টাকা থেকে ২ লাখ টাকা পর্যন্ত দামের বাইসাইকেল রয়েছে বাংলাদেশি কোম্পানিগুলোর।

রপ্তানিকারকরা আশা করছেন, এবার সাইকেল রপ্তানি থেকে লক্ষ্যের চেয়ে ৩০ শতাংশ বেশি বিদেশি মুদ্রা দেশে আসবে। আগামী ১০ বছরের মধ্যে তৈরি পোশাকের মতো গোটা ইউরোপের বাজারও দখল করে নেবে বাংলাদেশের সাইকেল।

বাংলাদেশ থেকে রপ্তানি হওয়া বাইসাইকেলের ৮০ শতাংশই যায় ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোতে। বাকিটা যায় ভারত, যুক্তরাষ্ট্র, সংযুক্ত আরব আমিরাত, অস্ট্রেলিয়াসহ আরও কয়েকটি দেশে।

প্রতিবন্ধকতা

দেশের বাইসাইকেলের বড় বাজার এখনও আমদানিকারকদের দখলে। এ জন্য সরকারের নীতিসহায়তা প্রয়োজন বলে মনে করেন খাতসংশ্লিষ্টরা।

সাইকেল তৈরিতে ব্যবহৃত কাঁচামালের ৫০ শতাংশ আসে চীন, ভারত, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া ও ভিয়েতনাম থেকে। বাইসাইকেলে ব্যবহৃত রং আমদানিতে প্রায় ৯০ শতাংশ শুল্ক দিতে হয়। উৎপাদকরা বলছেন, এই শুল্ক হার অস্বাভাবিক। স্থানীয় শিল্পের বিকাশ চাইলে এ শুল্ক কমাতে হবে। তা না হলে আমদানিনির্ভরতা কমানো যাবে না। রপ্তানি বাজারেও প্রতিযোগিতা সক্ষমতা বাড়বে না।

বাংলাদেশ বাইসাইকেল অ্যান্ড পার্টস ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক ও মেঘনা গ্রুপের পরিচালক লুৎফুল বারী বলেন, ‘পোশাক রপ্তানিতে যে নীতিসহায়তাগুলো দেয়া হয়, সেগুলো দেয়া হলে বাইসাইকেলেও ভালো রপ্তানি আয় হবে। সরকারের সহায়তা পেলে বাইসাইকেল খাতটি আরও টেকসই করা সম্ভব।’

তিনি আরও বলেন, ‘আমরা সরকারের কাছে বন্ড ফ্যাসিলিটি ও নগদ সহায়তা চেয়েছিলাম। সরকার আমাদের অনুরোধ রেখেছে। চলতি অর্থবছর সাইকেল রপ্তানির ওপর ৪ শতাংশ হারে নগদ সহায়তা দেয়ার ঘোষণা দেয়া হয়েছে। ফলে এ খাতে সামনে রপ্তানি আয় আরও বাড়বে।’

রাস্তায় প্রয়োজন আলাদা লেন

বাইসাইকেলের ব্যবহার দিন দিন বাড়লেও এটা চালানোতে ঝুঁকিও রয়েছে। শহরে বাস, মোটরসাইকেল, লেগুনা, ট্রাক, সিএনজিচালিত অটোরিকশাসহ বিভিন্ন ধরনের বাহনের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে সাইকেল চালানোর জন্য চালককে অনেক ঝুঁকি ও ঝামেলা পোহাতে হয়। কারণ সাইকেল চালানোর জন্য পরিকল্পিত আলাদা লেন নেই।

বাইসাইকেলচালকরা জানান, সড়কে হাতে গোনা দুয়েকটি সাইকেলের লেন ছাড়া আর দেখা যাচ্ছে না। ফলে প্রতিনিয়ত দুর্ঘটনা ঘটার আশঙ্কা রয়েছে। কারণ, বড় বড় যানবাহন বেপরোয়াভাবে চলাচল করে।

তারা বলেন, রাজধানীর গুরুত্বপূর্ণ স্থানে বাইসাইকেলের আলাদা লেন হবে—কিছুদিন পরপর এমনটা শোনা যায়, কিন্তু বাস্তবে তা হয় না।

এ বিভাগের আরো খবর