বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

যেভাবে বদলে গেল একটি উপজেলা

  •    
  • ৩ জুন, ২০২২ ০৮:২৩

সিলেট এলাকার অবহেলিত এক উপজেলা বিশ্বম্ভরপুর গত দেড়-দুই বছরে বদলে গেছে। পরিচ্ছন্ন, নান্দনিক এক রূপ পেয়েছে এটির সদর। বিভিন্ন মোড়ে নির্মাণ করা হয়েছে চমৎকার সব স্থাপনা।

বিশ্বম্ভরপুর উপজেলার চালবন মোড়ের নাম এখন কৃষাণ চত্বর। এই মোড়ে সড়কের পাশেই এক কৃষকের ভাস্কর্য। উঁচু স্তম্ভের ওপর দাঁড়িয়ে থাকা এই কৃষকের মাথায় বেতপাতার ছাতা, হাতে লাঠি, আর লুঙ্গি পরা, ভাঁজ করে কৃষকেরা যেমন পরে থাকেন।

সুনামগঞ্জ শহর থেকে মাত্র ১২ কিলোমিটার দূরে বিশ্বম্ভরপুর উপজেলা। উপজেলা সদরে যাওয়ার আগে চালবন মোড়ের কৃষকের এই ভাস্কর্য দেখিয়ে সিলেট থেকে বেড়াতে আসা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সাইমুম আদনান বললেন, ‘সিলেট নগরেও তো এমন ভাস্কর্য নেই। এ রকম সুন্দর কিছু করার উদ্যোগও নেই। বরং এমন কিছু করতে গেলে সারা দেশেই মৌলবাদী গোষ্ঠীসহ নানা চক্রের বাধার মুখে পড়তে হয়। অথচ হাওরপাড়ের এই প্রায় গ্রামীণ এলাকায় নির্মাণ করা হয়েছে এমন চমৎকার ভাস্কর্য।’

টাঙ্গুয়ার হাওরবেষ্টিত সুনামগঞ্জের তাহিরপুরে যাওয়ার পথে বিশ্বম্ভরপুর। সুনামগঞ্জ শহরের সবচেয়ে কাছের এই উপজেলাটি এতদিন ছিল সবচেয়ে অবহেলিত। ছিল মোড়ে মোড়ে ময়লা আবর্জনার স্তূপ। ছিল না তেমন কোনো পরিচিতিও।

অথচ এই বিশ্বম্ভরপুর গত দেড়-দুই বছরে নান্দনিক রূপ নিয়েছে। বিভিন্ন মোড়ে নির্মাণ করা হয়েছে চমৎকার সব স্থাপনা। কৃষাণ চত্বর, বোয়াল চত্বর, জয়বাংলা চত্বর, হাওরবৃত্ত চত্বর– এ রকম সব স্থাপনা নির্মাণ করা হয়েছে উপজেলাজুড়ে।

পর্যটকদের আকর্ষণের জন্য নির্মাণ করা হয়েছে ‘হাওর বিলাস’ ও ‘পাহাড় বিলাস’ নামে আরও দুটি নান্দনিক স্থাপনা। হাওর আর পাহাড় দেখতে এই দুই জায়গায় এখন পর্যটকদের ভিড় লেগে থাকে।

এলাকাবাসী জানান, স্থানীয় উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. সাদি উর রহিম জাদিদের উদ্যোগেই বদলে যাচ্ছে বিশ্বম্ভরপুর। ২০২০ সালে বিশ্বম্ভরপুরের ইউএনও হিসেবে যোগ দেন জাদিদ। এরপর থেকে উপজেলাটি পর্যটকদের জন্য আকর্ষণীয় করে গড়ে তোলার উদ্যোগ নেন তিনি।

স্থানীয় সংসদ সদস্য পীর ফজলুর রহমান মিসবাহ নিউজবাংলাকে বলেন, ‘এখানকার ইউএনও খুব কর্মঠ। তিনিই আমাদের সঙ্গে কথা বলে এসব সুন্দর স্থাপনাগুলো নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছেন। ফলে এখন বিশ্বম্ভরপুর উপজেলার চেহারা বদলে গেছে।’

পীর ফজলুর রহমান বলেন, ‘যেসব জায়গায় বিভিন্ন ভাস্কর্য ও স্থাপনা নির্মাণ করা হয়েছে, সেগুলো আগে বেদখল হয়ে ছিল। ময়লার ভাগাড় ছিল। এসব উচ্ছেদ করেই স্থাপনাগুলো নির্মাণ করা হয়েছে।’

উপজেলার ছিলাকান্দি বাজারে মুক্তিযোদ্ধা ভাস্কর্য নামে আরেকটি ভাস্কর্য নির্মাণ করা হচ্ছে বলে জানান তিনি।

বিশ্বম্ভরপুরের ‘কারেন্টের বাজারে’ নির্মিত একটি ভাস্কর্য দৃষ্টি কাড়বে যে কারও। বাজারের মোড়ে নির্মাণ করা হয়েছে বোয়াল মাছের ভাস্কর্য, যাতে জড়াজড়ি করে আছে দুটি বোয়াল। এই চত্বরের নাম এখন বোয়াল চত্বর।

হাওরবেষ্টিত সুনামগঞ্জ মাছের জন্যও প্রসিদ্ধ। হাওরের বোয়াল মাছের বিশেষ খ্যাতি রয়েছে। ভাস্কর্যের মাধ্যমে সেই ঐতিহ্যই ফুটিয়ে তোলা হয়েছে।

বিশ্বম্ভরপুরের ভাস্কর্য আর স্থাপনাগুলো সুনামগঞ্জের ইতিহাস আর ঐতিহ্যকে তুলে ধরছে বলে জানান বাংলাদেশ উদীচী শিল্পী গোষ্ঠী সুনামগঞ্জ জেলা সংসদের সাধারণ সম্পাদক জাহাঙ্গীর আলম। তিনি নিউজবাংলাকে বলেন, ‘এখানকার স্থাপনাগুলো সুনামগঞ্জকেই উপস্থাপন করছে। সুনামগঞ্জের হাওর, ধান, মাছ, কৃষক এসব তুলে ধরা হয়েছে স্থাপনায়।’

তিনি বলেন, ‘জেলা শহরের পার্শ্ববর্তী হলেও বিশ্বম্ভরপুর এতদিন ছিল সুনামগঞ্জের সবচেয়ে অবহেলিত উপজেলা। অন্য জেলার মানুষজন টাঙ্গুয়ার হাওরের জন্য তাহিরপুরকে চেনে। শিল্প কারখানার জন্য ছাতককে চেনে। বিশ্বম্ভরপুরের কোনো পরিচিতি ছিল না। এসব স্থাপনা নির্মাণের কারণে মানুষজন এখন বিশ্বম্ভরপুরকে চিনছে। অনেক পর্যটক এখানে বেড়াতে আসছেন।’

এমন উদ্যোগকে ইতিবাচক উল্লেখ করে এই সংস্কৃতিকর্মীর দাবি, প্রত্যেক উপজেলায় এমন উদোগ নেয়া প্রয়োজন।

উপজেলা পরিষদ সূত্রে জানা যায়, গত দুই বছরে উপজেলা পরিষদ মোড়ে বঙ্গবন্ধুর তর্জনীর আদলে জয়বাংলা চত্বর, কারেন্টের বাজারে বোয়ালের ভাস্কর্যে বোয়াল চত্বর, পলাশ বাজারের হাওরবৃত্ত চত্বর, চালবন বাজারে কৃষাণ চত্বর নির্মাণ করা হয়েছে।

এ ছাড়া উপজেলা পরিষদ ভবনের পাশে ‘হাওর বিলাস’ ও মেঘালয় পাহাড়ের পাদদেশে ‘পাহাড় বিলাস’ নামে দুটি স্থাপনা নির্মাণ করা হয়েছে, যেখানে রয়েছে উঁচু ওয়াচ টাওয়ারে উঠে হাওর ও পাহাড় দেখার সুবিধা। ভ্রমণপিপাসুদের জন্য রয়েছে দৃষ্টিনন্দন ফুড কোর্ট, বিশ্রামাগার।

উপজেলাকে এমন নান্দনিক রূপ দেয়া ইউএনও মো. সাদি উর রহিম জাদিদ নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আগে পুরো উপজেলাজুড়ে অব্যবস্থাপনা ছিল প্রচুর। বাজারগুলো ছিল ঘিঞ্জি আর ময়লা আবর্জনায় ভরা। বিশেষত সরকারি জায়গা দখল করে পার্কিং আর দোকান করা হয়েছিল।

‘আমি এখানে যোগ দেয়ার পর এগুলোকে একটা ব্যবস্থাপনায় নিয়ে আসার কাজ শুরু করি। প্রথমে অবৈধ দখল উচ্ছেদ করি। এরপর সৌন্দর্যবর্ধন ও বিনোদনকেন্দ্র গড়ে তোলার উদ্যোগ নিই। আগে এখানে বিনোদনের কোনো সুযোগ ছিল না। জেলার টাঙ্গুয়ার হাওর ছাড়া বেড়ানোর আর ভালো কোনো জায়গাও নেই। এখন বিশ্বম্ভরপুরেও অনেকে বেড়াতে আসেন।’

এসব স্থাপনা নির্মাণে স্থানীয় সংসদ সদস্য, বিভাগীয় কমিশনার ও জেলা প্রশাসক অনেক সহযোগিতা করেছেন জানিয়ে তিনি বলেন, ‘তাদের কাছে থেকে অর্থসহায়তাও পেয়েছি। এ ছাড়া উপজেলা পরিষদের বিভিন্ন ফান্ডের টাকাও এসব নির্মাণে ব্যবহার করেছি। তবে খুব বেশি টাকা খরচ হয়নি। সব মিলিয়ে ৬০ থেকে ৭০ লাখ টাকা ব্যয় হয়েছে।’

এলাকার মানুষজনও এসব কাজের প্রশংসা করছেন জানিয়ে ইউএনও বলেন, ‘ভাস্কর্য নির্মাণে আমরা কোনো বাধা পাইনি। বরং হাওর বিলাস করার পর সবাই খুব প্রশংসা করছে। এখন মানুষজন বিভিন্ন জায়গায় এমন স্থাপনা চায়। তা ছাড়া এখানে তেমন উগ্র মানুষজনও নেই।

‘বোয়াল চত্বর নির্মাণ করেছেন শিল্পী জালাল সরকার, জয় বাংলা ও কৃষাণ চত্বরের শিল্পী নাইম দিপু এবং হাওর বৃত্তের নকশা করেছেন প্রকৌশলী জিষ্ণু কুমার দাস।’

সিলেটের সাংবাদিক উজ্জ্বল মেহেদীর বাড়ি সুনামগঞ্জে। নিজ জেলার একটি উপজেলায় এমন উদ্যোগের প্রশংসা করে তিনি বলেন, ‘একজন জনপ্রতিনিধি ও প্রশাসনের একজন কর্মকর্তা আন্তরিক হলে যে একটি উপজেলা বদলে যেতে পারে, তার বড় উদাহরণ বিশ্বম্ভরপুর। ইউএনওর উদ্ভাবনী ও সৃষ্টিশীল চিন্তা আর স্থানীয় সংসদ সদস্যের সহযোগিতায় বিশ্বম্ভরপুর এখন আমূল পাল্টে গেছে। এসবের জন্য আলাদা কোনো অর্থ বরাদ্দেরও প্রয়োজন হয়নি।’

উজ্জ্বল বলেন, জেলার মধ্যে বিশ্বম্ভরপুর উপজেলাই ছিল সবচেয়ে উপেক্ষিত ও অবহেলিত। কোনো কিছুই ছিল না এখানে। সেই বিশ্বম্ভরপুরই এখন হয়ে উঠেছে হাওর পর্যটনের অন্যতম বড় ক্ষেত্র।

এ বিভাগের আরো খবর