চালের দাম নিয়ন্ত্রণে এভাবে মিলে মিলে অভিযান চালালে পরিস্থিতির আরও অবনতি হবে বলে সতর্ক করে দিয়েছেন একজন মিল মালিক। বলেছেন, তারা সরকারকে সহযোগিতা করতে প্রস্তুত। তবে এভাবে অভিযান কোনো সুফল বয়ে আনবে না।
বৃহস্পতিবার কুষ্টিয়া জেলা প্রশাসকের সম্মেলন কক্ষে চালকল মালিকদের সঙ্গে প্রশাসনের মতবিনিময় সভায় এই কথা বলেন ওমর ফারুক নামে এক মিল মালিক।
জনাব ফারুক বাংলাদেশ অটো রাইস মিলস ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের কুষ্টিয়া শাখার সভাপতি, যিনি ফ্রেস অ্যাগ্রো অটোমেটিক নামে একটি রাইস মিল প্রতিষ্ঠা করেছেন।
করোনা পরিস্থিতির উন্নতির পর ইউক্রেনে রুশ হামলার প্রতিক্রিয়ায় আন্তর্জাতিক বাজারে খাদ্যপণ্য ও জ্বালানি মূল্যের ঊর্ধ্বগতির কারণে দেশে দেশে বাড়ছে নিত্যপণ্যের দাম। চাল উৎপাদনে বাংলাদেশ প্রায় স্বয়ংসম্পূর্ণ হলেও দেশের প্রধান এই খাদ্যশস্য নিয়েও তৈরি হয়েছে উদ্বেগ।
হাওরে আগাম বন্যার পর অতি বৃষ্টিতে দেশে ধানের প্রধান মৌসুম বোরো ফসলের কিছু ক্ষতি হয়েছে। এর পাশাপাশি গম আমদানিতে দেখা দেয়া অনিশ্চয়তার কারণে বাড়তি চাপ পড়তে যাচ্ছে চালের বাজারে।
ইউক্রেন ও রাশিয়া থেকে গম আমদানি পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যাওয়ার পর বাংলাদেশে আমদানির প্রধান উৎস ভারত ইউরোপে গম পাঠানো বন্ধ করে দিয়েছে। এই নিষেধাজ্ঞা বাংলাদেশের জন্য নয় জানানো হলেও ব্যক্তি পর্যায়ে গম আমদানি অনিশ্চিত হয়ে গেছে। ফলে গমের অপূর্ণ চাহিদা চাল দিয়ে পূরণ করতে গেলে বাজারে বাড়তে চাপ তৈরি হওয়ার শঙ্কা দেখা দিয়েছে।
এরই মধ্যে এই প্রবণতা স্পষ্ট হয়েছে, বাজারে বাড়তে শুরু করেছে সব ধরনের চালের দাম। সরকারি হিসেবেই এক সপ্তাহে দাম বেড়েছে ৩ থেকে প্রায় ৮ শতাংশ। চিকন চালের চেয়ে মোটা চালের দাম বেশি বাড়ায় স্বল্প আয়ের মানুষরা বিপাকে আরও বেশি। কারণ, এই চালের ভোক্তা তারাই।
এই পরিস্থিতিতে সরকার চাল আমদানি উন্মুক্ত করার ঘোষণার পাশাপাশি অবৈধ মজুত রুখতে বাজারে ও মিলে মিলে অভিযান শুরু করেছে। দেশ থেকে চাল কিনে মোড়কজাত করে বিক্রিতে নিষেধাজ্ঞা দেয়ার কথা জানিয়েছেন খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদার।
অভিযানের মধ্যে রাজধানীতে চাল সরবরাহের অন্যতম উৎস কুষ্টিয়ার জেলা প্রশাসক সাইদুল ইসলাম পরিস্থিতি নিয়ে বৈঠকে বসেন মিল মালিকদের সঙ্গে। সরু চালের প্রধান মোকাম কুষ্টিয়ার খাজাগনরের প্রায় ৩০ জন অটো রাইস মিলের মালিক এতে অংশ নেন।
সভায় কুষ্টিয়া চেম্বার অব কমার্সের সভাপতি রবিউল ইসলাম, জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক সুবীর নাথ চৌধুরী, সিনিয়র কৃষি বিপণন কর্মকর্তা ও মিল মালিকরা উপস্থিত ছিলেন।
সকাল সাড়ে ১০টায় সভা শুরু হয়ে বেলা ১১টা ৪৫ মিনিটের দিকে শেষ হয়।
জেলা প্রশাসক বলেন, ‘কী এমন ঘটলো যে আপনারা দাম বাড়িয়েই যাচ্ছেন। এসব বন্ধ করেন।’
তিনি বলেন, ‘এখন থেকে প্রত্যেক মিলারকে তাদের মজুত, ধান কেনা, চাল বিক্রি, কোথায় বিক্রি করছেন, ধান কোথায় থেকে কতো দরে কিনছেন প্রতিদিনের হিসাব প্রতিদিন খাদ্য বিভাগকে দিতে হবে।
‘জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক আজই একটি কাগজে ফরম্যাট দেবেন। সেটা পূরণ করে প্রতিদিন খাদ্য বিভাগে দাখিল করতে হবে।’
মিল মালিকরা বলেন, এবার ধানের দাম বেশি, উৎপাদন খরচ বেড়েছে। আর এভাবে অভিযান চলতে থাকলে বাজারে সরবরাহে বিঘ্ন ঘটবে। এতে পরিস্থিতি আরও খারাপ হবে।
ফ্রেস অ্যাগ্রো অটোমেটিক অটো রাইস মিলের মালিক ওমর ফারুক বলেন, ‘আমরা সহযোগিতা করব, কিন্তু অভিযান চাই না। অভিযান চললে চাল উৎপাদনে ঘাটতি হবে। এতে পরিস্থিতি আরও অবনতি হবে।’
কুষ্টিয়া সচেতন নাগরিক কমিটির সভাপতি রফিকুল আলম টুকু বলেন, ‘যেভাবে প্রশাসন অভিযান চালাচ্ছে তাতে কোনো কাজ হবে না। তারা লাইসেন্স দেখছে, ভুয়া ব্র্যান্ডিং ধরে জরিমানা করছে। আসল জায়গায় হাত দিতে হবে।’
তিনি বলেন, ‘মজুত কোথাও হচ্ছে, সেটা ধরতে হবে। প্রয়োজনে গোয়েন্দা নজরদারি করে মজুতদারদের শাস্তি দিতে হবে। শাস্তির ভয়ে হলেও দাম কমে যাবে।
আব্দুল খালেক নামে অন্য এক মিল মালিক বলেন, ‘করপোরেট ব্যবসায়ীরা চাল ব্যবসায় নেমে ধানের দাম বাড়িয়ে দিয়েছে। তারা ইচ্ছামতো ধান কিনছে। কৃষকরা যত দাম চাচ্ছে, তারা দিচ্ছে। এ কারণে দাম যেমন বাড়ছে, তেমনি আমরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছি।’
মিল মালিক জয়নাল আবেদীন বলেন, ‘কৃষক ছাড়া অন্য কোনো মজুতদারের কাছ থেকে ধান কিনলে দাম বেশি পড়ে যায়। এ কারণে এই মধ্যস্বত্ত্বভোগীদের থামাতে হবে।’ খুচরা বিক্রেতা রিপন হোসেন বলেন, ‘আমরা মিল থেকে কিনে বিক্রি করি। তারা দাম বাড়ালে আমাদেরও দাম বেশি নিতে হচ্ছে।’
মিলে মিলে অভিযান কুষ্টিয়াতে চালের দাম কমাতে পারেনি। বাজারে সরু চাল কেজিতে এখন ৬৭ টাকা দরে বিক্রি হচ্ছে। গত এক মাসে ৭ দফায় দাম বেড়েছে ১১ টাকা। এতে চরম বিপাকে পড়েছে নিম্ন আয়ের মানুষ।