চার বছর আগে বাড়ি নির্মাণের জন্য সুদে টাকা নিয়েছিলেন সাত লাখ। এই সময়ে পরিশোধ করেছেন ১২ লাখ। কিন্তু আরও ১৬ লাখ টাকার জন্য চাপ দেয়া হচ্ছে।
সুদের সেই টাকা তোলার জন্য এক নারীকে ভয়ভীতি প্রদর্শনের অভিযোগে উঠেছে সরকার সমর্থক ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগের এক কেন্দ্রীয় নেতার বিরুদ্ধে।
ভুক্তভোগী নারী অভিযোগ করছেন, ছাত্রলীগ নেতা দলবল নিয়ে তার বাসায় গিয়ে ও মোবাইল ফোনে একাধিকবার হুমকি দিয়েছেন। আরও টাকা না দিলে তিন শিশু সন্তানের ক্ষতি করার কথা বলেছেন।
এ ঘটনায় থানায় দুটি সাধারণ ডায়েরি করার পর পুলিশ দৃশ্যমান কোনো পদক্ষেপ না নেয়ায় আতঙ্কে আছেন তিনি।
ঘটনা যা ঘটেছে
ভুক্তভোগীর নাম মুন্নি ইসলাম। তিনি সাভারের আশুলিয়ার ডেন্ডাবর কবরস্থানরোড এলাকার বাসিন্দা।
স্বামী জামাল উদ্দিন থাকেন প্রবাসে। মুন্নি তার তিন সন্তান নিয়ে নিজ বাড়িতে থাকেন। তাদের গ্রামের বাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়।
গত ২৬ মে ছাত্রলীগের উপ-আন্তর্জাতিক সম্পাদক এস এম মাহবুবুর রহমান সালেহীর বিরুদ্ধে আশুলিয়া থানায় সাধারণ ডায়েরি করেন মুন্নি।
মুন্নি টাকা নিয়েছিলেন তার দূর সম্পর্কের চাচা মানিক মিয়ার কাছ থেকে। তার শ্যালক মো. সোহেলের সঙ্গে বন্ধুত্ব আছে ছাত্রলীগ নেতা সালেহীর।
গত ১৩ মে এই দুইজনসহ আরও কয়েকজনের বিষয়েও থানায় সাধারণ ডায়েরি করেন মুন্নি।
সাধারণ ডায়েরিতে বলা হয়, ২০১৫ সালে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় বসবাসরত মানিক মিয়ার কাছে সাভারে বাড়ি নির্মাণের জন্য ৭ লাখ টাকা ধার হিসেবে নেন মুন্নি ইসলাম। পরে মুন্নির স্বামী জামাল উদ্দিনের তিনটি চেক নিরাপত্তা হিসেবে নিজের কাছে জমা রাখেন মানিক মিয়া।
এরপর ব্যাংকের মাধ্যমে চার বছর ধরে বিভিন্ন কিস্তিতে ওই টাকা পরিশোধ করেন। কিন্তু আরও টাকা পাবে দাবি করে মানিক মিয়া ব্যাংকের চেক ফেরত না দিয়ে নানা তালাবাহনা করতে থাকেন।
মুন্নির অভিযোগ, গত ২৯ এপ্রিল মানিক মিয়ার শ্যালক সোহেল ও তার সঙ্গীরা সাভারে ডেন্ডাবর কবরস্থান রোড এলাকায় বাড়িতে এসে অতিরিক্ত টাকা দাবি করেন। তিনি টাকা পরিশোধে অপারগতা জানালে তারা বাড়িতে তালা ঝুলিয়ে দেয়ার হুমকি দিয়ে চলে যায়।
ব্রাহ্মণবাড়িয়া জনতা ব্যাংক শাখায় জেসমিন আক্তারের অ্যাকাউন্টে বিভিন্ন সময় কিস্তির টাকা ট্রান্সফার করেন মুন্নি। ছবি: নিউজবাংলা
মুন্নি জানান, পরে বাড়িতে দলবল নিয়ে আসেন ছাত্রলীগ নেতা সালেহী। তিনি তিন সন্তানের কথা মনে করিয়ে হুমকি দেন বলে সাধারণ ডায়েরিতে অভিযোগ করা হয়।
মুন্নি নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমার স্বামী দীর্ঘ দিন প্রবাসে থাকেন। আমি এখানে তিন সন্তান নিয়ে বসবাস করি। ২০১৫ সালে বাড়ি নির্মাণের জন্য ৭ লাখ টাকা আমার চাচা মানিক মিয়ার কাছে নিয়েছিলাম। ইন্টারেস্টের (সুদের) উপরেই টাকাটা নেয়া। এরপর চার বছর ধরে আশুলিয়ার পল্লীবিদ্যুৎ ইউসিবি ব্যাংকের আমার অ্যাকাউন্ট থেকে কিস্তিতে ১২ লাখ টাকা পরিশোধ করি।
‘ব্রাহ্মণবাড়িয়া জনতা ব্যাংক শাখায় জেসমিন আক্তারের (একাউন্ট নম্বর- ০১২০০৩১০০৪১০৬৩) অ্যাকাউন্টে বিভিন্ন সময় কিস্তির টাকা ট্রান্সফার করি। জেসমিন আমার চাচার শ্যালিকা। টাকা প্রদানের সমস্ত প্রমাণ আমার কাছে আছে।’
তিনি বলেন, ‘কিন্তু তারপরও চাচা মানিক মিয়া আমার স্বামীর চেক ফেরত না দিয়ে উল্টো আরও ১৬ লাখ টাকা পাবেন বলে দাবি করছেন। চাচার শ্যালক সোহেল তার লোকজন ছাত্রলীগ নেতাকে নিয়ে বাসায় এসে আমাকে হুমকি দিচ্ছে। ওই ছাত্রলীগ নেতা অনবরত বাড়িতে এসে ও মুঠোফোনে সুদের টাকার জন্য ভায়া হয়ে আমাকে চাপ দিচ্ছেন। আমার ছোট বাচ্চাদেরও হুমকি দিচ্ছেন ওই ছাত্রলীগ নেতা।’
মুন্নি জানান, টাকা দিতে না চাওয়ায় তার ফ্ল্যাটটি তাদের কাছে বিক্রি করে দেয়ার জন্য চাপ দেয়া হচ্ছে। তিনি বলেন, ‘যেহেতু তিনটা সন্তান নিয়ে আমি একটা নারী একা বসবাস করছি। তাই থানায় দুইটা জিডি করেও আতঙ্কে দিন কাটছে আমার। সবসময় আতঙ্কে থাকি।’
মুন্নির এই অভিযোগ ও সাধারণ ডায়েরির পর কী ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে, জানতে চাইলে আশুলিয়া থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) আসওয়াদুর রহমান নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমরা বিষয়টা তদন্ত করে দেখছি। তদন্তের পর আইনগত ব্যবস্থা নেয়া হবে।’
হুমকি নয়, সুন্দর করে বলেছি: ছাত্রলীগ নেতা
মুন্নির এই অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে ছাত্রলীগের উপ-আন্তর্জাতিক সম্পাদক এস এম মাহবুবুর রহমান সালেহী নিউজবাংলাকে বলেন, ‘ওনার কাছে যদি কোন এভিডেন্স (প্রমাণ) থাকে যে, ওনারে হুমকি-ধামকি বা এটাইপের কিছু… ওনারে সুন্দরমত বারবার বলা হইতেছে।’
টাকা নেয়ার বিষয়ে কী জানেন- এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘৫-৭ বছর আগে নিছে টাকা। সেটা হচ্ছে একটা ইন্টারেস্টের (সুদ) উপরে। কয়েক বছর দিছে। পরবর্তীতে ৩-৪ বছর ধরে হচ্ছে আজ দেয়, কাল দেয় দিবে করে তালাবাহানা করতেছে।’
এই অভিযোগের বিষয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় থাকা মানিক মিয়ার বক্তব্য জানতে পারেনি নিউজবাংলা। তার ব্যক্তিগত মোবাইল ফোন নম্বরে কল দিলে সেটি বন্ধ পাওয়া গেছে।
মানিক মিয়ার শ্যালক মো. সোহেল বুঝতে পারছেন না, এই টাকার লেনদেন নিয় সংবাদ কেন হতে হবে।
নিউজবাংলাকে তিনি বলেন, ‘যদি জিডি করে থাকে হয়ত থানায় থেকে ফোন দিত। হয়ত থানার কোন একজন এসআই ফোন দিত, বা যিনিই ইনচার্জের দায়িত্বে উনিই ফোন দিত। আপনি নিউজ রিপোর্টার হয়ে আমাকে কল করতেছেন? উনিতো মহিলা মানুষ হয়ে ছাড় পাইতেছে। আইনগত যখন নেয়ার সময় হবে তখন অবশ্যই নেয়া হবে। উনিতো আমার রিলেটিভ হয়। উনার সম্মান রক্ষা করতেছি। আত্মীয়তার মান রাখছি।’
কত টাকা দিয়েছেন এমন প্রশ্নে বলেন, ‘উনি (মুন্নি ইসলাম) ৭ লক্ষ টাকা নিছেন ২০১৫ সালে। ২১ হাজার টাকা ইন্টারেস্ট (লাভ/সুদ) প্রতি মাসে উনি পে করবেন। উনি ৩-৪ মাস দিয়ে তিন বছর চার মাস যোগাযোগ টোটালি বন্ধ করে দিছেন। ওনার বাসার অ্যাড্রেসটা পর্যন্ত কাউকে দেয় নাই। আমাদের কাছে টাকা নিয়ে বাড়ি কিনছে। ওনার জন্য আমার দুলাভাই (মানিক মিয়া) দুইবার স্ট্রোক করছেন। উনি (দুলাভাই) সুইসাইড নোট লিখে নিতে আত্মহত্যা করতে গিয়েছিলেন।’
কিত টাকা পেয়েছেন এমন প্রশ্নে বলেন, ‘উনি যে বলেছেন ১২ লাখ টাকা দিয়েছে কোথায় দিয়েছে? সব মিথ্যা কথা বলতেছে। আসল টাকাটা দিয়েও তো বলতে পারে যে ভাই আর পারব না। আমার সামর্থ্য নাই।’
সুদ বা লাভ আদায় নিয়ে আদালতের নিষেধাজ্ঞার বিষয়ে বললে তিনি আসলের পরিপ্রেক্ষিতে আদায়কৃত টাকাটাকে ‘সম্মানি’ বলে জানান। তাই সুদের বদলে সম্মানি লেখার পরামর্শ দেন তিনি।
আশুলিয়া থানার উপপরিদর্শক (এসআই) আসওয়াদুর রহমান নিউজবাংলাকে বলেন, ‘ভুক্তভোগী নারী সাধারণ ডায়েরি করেছেন। আমরা বিষয়টা তদন্ত করে দেখছি। তদন্তের পর আইনি ব্যবস্থা নেয়া হবে।’