বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের টরন্টো ফ্লাইট শুরুর সম্ভাব্য দিন ২৮ জুন। অথচ এখনও টিকিট বিক্রির ঘোষণা দিতে পারছে না রাষ্ট্রীয় পতাকাবাহী প্রতিষ্ঠানটি। এক্ষেত্রে বাধা হয়ে আছে এজেন্টের মাধ্যমে টিকিট বিক্রির পদ্ধতি-বিএসপি চালুর অনুমোদন না পাওয়া।
বিমানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আবু সালেহ মোস্তফা কামাল বুধবার কুর্মিটোলায় বিমান বাংলাদেশ ট্রেনিং সেন্টারে সাংবাদিকদের সঙ্গে মতবিনিময়কালে এমন তথ্য জানান।
মোস্তফা কামাল বলেন, ‘ঢাকা-টরন্টো ফ্লাইট শুরু ইস্যুতে আমরা ২৮ জুন লক্ষ্য ধরেই অগ্রসর হচ্ছি। সেখানে ফ্লাইট চালু করতে সব লাইসেন্স ও এগ্রিমেন্ট আমরা পেয়ে গেছি।
‘আমরা যদি বলি যে এই তারিখ থেকে ফ্লাইট শুরু হবে তাহলে ওয়েবসাইটের মাধ্যমে যে কেউ টিকিট কাটতে পারবেন। কিন্তু শুধু ওয়েবসাইট দিয়ে ব্যবসা হয় না। সেজন্য বিএসপির প্রয়োজন রয়েছে।
‘বিএসপির সঙ্গে এজেন্সির সম্পর্ক রয়েছে। কারণ এজেন্সি টিকিট না করলে সেই টাকা বিমানে যোগ হবে না। এটা ইন্ট্রিগ্রেট করতে বিজনেস লাইসেন্স লাগে, যা আমরা এখনও পাইনি। আর সেজন্য টিকিট বিক্রির ঘোষণা দিচ্ছি না।’
টরন্টো রুটের ফ্লাইট চালানোর ক্ষেত্রে তুরস্কের ইস্তাম্বুলে কেন স্টপওভার বা টেকনিক্যাল ল্যান্ডিং হবে তারও ব্যাখ্যা দেন আবু সালেহ মোস্তফা কামাল। বলেন, ‘আমরা যখন ফ্লাইটটি নিয়ে আসবো এটা টরন্টো থেকে ঢাকা চলে আসবে সরাসরি। যাওয়ার সময় ইস্তান্বুল হয়ে যাবে। আসার সময় ১৬ থেকে ১৭ ঘণ্টা লাগবে। আর যাওয়ার পথে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ চলার সময়টাতে ইস্তান্বুলে টেকনিক্যাল ল্যান্ডিং হবে।
‘আজ যুদ্ধ শেষ হলে কালই ফ্লাইট সরাসরি টরন্টো যাবে। আমরা যে ফ্লাইটটি নিয়ে গেলাম সেটি রাশিয়া হয়ে যায়নি বলে যাত্রী কম নিতে হয়েছে। যখন রাশিয়ার ওপর দিয়ে যাবো তখন আমরা কেবিন ফ্যাক্টর অনুযায়ী যাত্রী নিতে পারব।’
বিমানের এমডি বলেন, ‘এভিয়েশনের দৃষ্টিভঙ্গিতে এটা অবশ্যই ভায়াবল হবে। আমরা ইস্তান্বুল যাচ্ছি এজন্য যে যাওয়ার পথে আমরা একটি টেকনিক্যাল ল্যান্ডিং করলাম। এটা আমরা যাত্রী নিয়েও যেতে পারতাম। তা আপাতত নিচ্ছি না। যাত্রী নিতে গেলে সেটার জন্য ল্যান্ডিং ফি, টাইমিং ফি এগুলো লাগবে। সে তুলনায় যাত্রী না নিয়ে গেলই বরং খরচ কম।
‘আরেকটি কারণ হলো এতে ক্রু লে-ওভার হবে। ইস্তাম্বুল দিয়ে গেলে আমাদের ক্রু-টাইম বেঁচে যাবে। ৬ থেকে ৮টি ক্রুর টাইমিং আমরা সেট করতে পারবো। এটা বিরাট ব্যাপার।
ইস্তাম্বুলে ঢাকা থেকে কয়েকটি ফ্লাইট যায়। ওখানে কোনো সমস্যা হলে তাৎক্ষণিক পার্টস বা ইঞ্জিনিয়ার পাঠিয়ে সেটি আমরা ঠিক করতে পারব। এ জন্যই ইস্তাম্বুলে টেকনিক্যাল ল্যান্ডিংয়ে আমরা এক ঘণ্টা সময় ব্যয় করব।’
গত ২৬ মার্চ টরন্টোর পিয়ারসন আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে ৭০ যাত্রী নিয়ে উড়াল দেয় বিমানের প্রুভেন (পরীক্ষামূলক বাণিজ্যিক) ফ্লাইট। ঢাকা থেকে উড়াল দিয়ে টানা সাড়ে ১৮ ঘণ্টা আকাশে থেকে কানাডায় পৌঁছে বোয়িং ৭৮৭ ড্রিমলাইনার।
দেশি এয়ারলাইন্সগুলোর মধ্যে একটানা এতক্ষণ আকাশে ওড়ার নজির আর নেই। বিশ্বেও এমন নজির খুব কম। যুক্তরাষ্ট্রের উড়োজাহাজ নির্মাতা প্রতিষ্ঠান বোয়িং বলছে, যাত্রী নিয়ে সেভেন এইট সেভেন উড়োজাহাজের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ একটানা ওড়ার রেকর্ড এটি।
ঢাকা থেকে আকাশপথে টরন্টোর যে দূরত্ব, এটিকে এভিয়েশনের পরিভাষায় বলা হয় ‘আল্ট্রা লং হওল’। বিশ্বে এ ধরনের গন্তব্যে সরাসরি ফ্লাইট চলার নজিরও খুব বেশি নেই।
এয়ারলাইন্সগুলো সাধারণত তৃতীয় কোনো গন্তব্যে স্টপওভার করেই ফ্লাইট পরিচালনা করে। এর একটি বড় কারণ, এ ধরনের দূরত্বে ফ্লাইট পরিচালনার ক্ষেত্রে উড়োজাহাজে পর্যাপ্ত জ্বালানি বহন করতে হয়। বাড়তি জ্বালানি বহন করার কারণে উড়োজাহাজের ভারসাম্য ঠিক রাখতে কমিয়ে রাখা হয় যাত্রীসংখ্যা। এভিয়েশনের পরিভাষায় এটিকে বলে লোড পেনাল্টি।
ঢাকা থেকে সরাসরি টরন্টো যেতে সময় লাগে প্রায় ১৬ ঘণ্টা। এই রুটে বিমান ব্যবহার করছে যুক্তরাষ্ট্রের নির্মাতা প্রতিষ্ঠান বোয়িংয়ের তৈরি ৭৮৭ ড্রিমলাইনার উড়োজাহাজ। এই উড়োজাহাজগুলোর জ্বালানি খরচ অন্যগুলোর চেয়ে অন্তত ২০ শতাংশ কম। সে সুবাদে এগুলো পূর্ণ যাত্রী নিয়ে একটানা ১৬ ঘণ্টারও বেশি সময় আকাশে উড়তে পারে।
সাড়ে ১৮ ঘণ্টা উড়াল দিয়ে বিমানের যে উড়োজাহাজটি টরন্টোয় গিয়েছিল, এই পথ পাড়ি দেয়ার জন্য সেটিতে বহন করা যেত সর্বোচ্চ ১৪০ যাত্রী। অথচ বিমানের ড্রিমলাইনার উড়োজাহাজটির যাত্রী ধারণক্ষমতা ২৯৮ জন।
১৬ ঘণ্টায় টরন্টো পৌঁছানোর রুট ব্যবহার করে যদি এই উড়োজাহাজটি দিয়ে সরাসরি টরন্টো ফ্লাইট করা হতো, তাহলে সেখানে সর্বোচ্চ বহন করা যেত ২৩০ যাত্রী।
ঢাকা থেকে জাপানের নারিতা হয়ে এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চল এবং কানাডার টরন্টো হয়ে উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকার দেশগুলোর সঙ্গে আকাশপথে যুক্ত হতে বেশ কয়েক বছর ধরেই চেষ্টা চালিয়ে আসছে বিমান। কিন্তু করোনার কারণে সে পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা যায়নি।
এ রুটে বিমানের ফ্লাইট চলাচল পুরোদমে শুরু হলে এয়ারলাইন্সটি তার বহরে থাকা লম্বা পাল্লার উড়োজাহাজগুলোর পূর্ণ সক্ষমতা ব্যবহার করতে পারবে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
বিমানের বহরে লম্বা দূরত্বে উড়তে সক্ষম অন্তত ১০টি উড়োজাহাজ থাকলেও রুট না থাকায় দীর্ঘদিন ধরে সেগুলোর সক্ষমতার পুরোটা ব্যবহার করা যাচ্ছে না। এগুলোর মধ্যে রয়েছে ছয়টি বোয়িং ৭৮৭ ও চারটি বোয়িং ৭৭৭ মডেলের উড়োজাহাজ। এর প্রত্যেকটি ১৬ ঘণ্টার বেশি টানা উড়তে সক্ষম।
লম্বা দূরত্বের মধ্যে বর্তমানে ফ্লাইট চালু রয়েছে শুধু লন্ডন রুটে। এ রুটে সরাসরি যেতে সময় লাগে প্রায় ১১ ঘণ্টা।
বর্তমানে বাংলাদেশে ফ্লাইট পরিচালনা করা কোনো এয়ারলাইন্সেরই ঢাকা থেকে টরন্টোয় সরাসরি ফ্লাইট নেই। বিমান আশা করছে, নারিতা ও টরন্টোয় ফ্লাইট শুরু করলে মধ্যপ্রাচ্য, মধ্য এশিয়া ও দক্ষিণ এশিয়ার অনেক আন্তর্জাতিক যাত্রী তারা পাবে।
পর্যটন ভিসা খুললে নারিতা, হজের পর মালেতে উড়ালের প্রস্তুতি
টরন্টো ছাড়াও আরও চারটি নতুন রুটে ফ্লাইট শুরুর প্রক্রিয়ার কথা জানান বিমানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক। তিনি বলেন, ‘নারিতার ক্ষেত্রে জাপান সরকার পর্যটন ছাড়া অন্য দুটি ক্ষেত্রে ভিসা চালু করেছে। পর্যটন এখনও ওপেন করেনি। এই রুটে ড্রিমলাইনার চালালে সেক্ষেত্রে আমাদের ক্যাপাসিটি দেয়া আছে ১৪০ জন। সঙ্গত কারনেই আমরা যাবো না। ২৯০ আসন ওপেন করার পর আমরা নারিতা যাবো। আমাদের দিক থেকে আমরা রেডি।’
আবু সালেহ মোস্তফা কামাল বলেন, ‘মালেতে গ্রীষ্মকালীন যে সূচি তাতে সে অনুযায়ী আজ থেকেই সেখানে বিমানের ফ্লাইট পরিচালনার কথা। কিন্তু পারছি না। কারণ আমরা নিজস্ব ফ্লাইটে হজ যাত্রী নিচ্ছি। মালেতে ফ্লাইট পরিচালনা করলে হজযাত্রী বহনের জন্য ৫ তারিখ থেকে এটা বন্ধ রাখতে হতো। এ জন্য আমরা হজের পর মালেতে ফ্লাইট শুরু করব।
‘এরপর চেন্নাই ও বাহরাইনে আমরা ফ্লাইট পরিচালনা করবো। আমরা নতুন রুটের কথা ভাবছি।’