বাংলাদেশ অনেক ক্ষেত্রে তার প্রতিবেশী দেশ ভারতের চেয়ে এগিয়ে। রাজস্ব ঘাটতি, বাণিজ্য ভারসাম্য, কর্মসংস্থান, ঋণ ও জিডিপির সঙ্গে আনুপাতিক বিনিয়োগ হারের মতো বিভিন্ন ক্ষেত্রে বাংলাদেশ এখন ভারতের চেয়ে এগিয়ে রয়েছে।
হংকংভিত্তিক সংবাদমাধ্যম সাউথ চায়না মর্নিং পোস্টে প্রকাশিত একটি নিবন্ধে এমন অভিমত দিয়েছেন সৈয়দ মুনির খসরু। বাংলাদেশের আর্থসামাজিক অর্জনের চিত্র তুলে ধরে নিবন্ধটি লিখেছেন দ্য ইনস্টিটিউট ফর পলিসির অ্যাডভোকেসি অ্যান্ড গভর্ন্যান্সের এই চেয়ারম্যান।
নিবন্ধে তিনি লিখেছেন, ২০০৯ সাল থেকে বাংলাদেশ আর্থিক ও ঋণ ব্যবস্থাপনার পাশাপাশি সামাজিক নিরাপত্তা ও অবকাঠামোগত প্রকল্পে বিনিয়োগের মাধ্যমে সামষ্টিক অর্থনীতিতে স্থিতিশীলতা রাখতে সক্ষম হয়েছে। গত চার দশকে বাংলাদেশে অর্থনৈতিক অগ্রগতি সামঞ্জস্যপূর্ণ ছিল। এই ধারা এখনও চলছে। দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশের তুলনায় মোট দেশজ উৎপাদন (জিডিপি) প্রবৃদ্ধির দিক থেকে বাংলাদেশ এগিয়ে। ২০২০ সালে দক্ষিণ এশিয়ার গড় জিডিপি ৬ দশমিক ৫৮ শতাংশ হ্রাস পায়। অথচ সে বছর বাংলাদেশে জিডিপি প্রবৃদ্ধি ছিল ৩ দশমিক ৫ শতাংশ।
মুনির খসরু তুলনামূলক চিত্র তুলে ধরে বলেছেন, বাংলাদেশের জিডিপিতে সাধারণ কৃষিখাতের অবদান ছিল এক-তৃতীয়াংশ। তবে ২০১০ ও ২০১৮ সালের মধ্যে তা কমে মোট জিডিপির ১৫ শতাংশের নিচে নেমে গেছে। তবে এই সময়ে জিডিপিতে শিল্পখাতের অবদান বেড়েছে। এক-পঞ্চমাংশের কম থেকে বেড়ে এটি এক-তৃতীয়াংশ হয়েছে। ১৯৮০ সাল থেকে জিডিপিতে উৎপাদনখাতের অবদান দ্বিগুণ হয়েছে।
বাংলাদেশে নব্বইয়ের দশক থেকে রপ্তানি ২০ গুণ বেড়ে চার হাজার কোটি মার্কিন ডলার ছাড়িয়েছে জানিয়ে তিনি বলেছেন, অধিক রেমিট্যান্স থেকে কম মজুরির শ্রমিকেরাও দেশের অর্থনীতিতে অবদান রাখছেন। ২০১৯ সালে রেমিট্যান্স এসেছে ১ হাজার ৬৪০ কোটি ডলার।
শক্তিশালী রেমিট্যান্স, রপ্তানি ও কৃষিখাতের কল্যাণে বাংলাদেশ ২০২৬ সাল পর্যন্ত মাথাপিছু জিডিপিতে ভারতের চেয়ে এগিয়ে থাকবে বলে আশাবাদী মুনির খসরু।
তিনি নিবন্ধে লিখেছেন, ২০২০ সালে ভারতের মাথাপিছু জিডিপি ২ হাজার ৯৮ ডলার থেকে কমে হয় ১ হাজার ৯২৯ ডলার। ঠিক এসময় মাথাপিছু জিডিপিতে ভারতের থেকে এগিয়ে যায় বাংলাদেশ। ওই বছর ভারতের অর্থনীতির আকার ২ লাখ ৮৭ হাজার কোটি থেকে কমে দাঁড়ায় ২ লাখ ৬৬ হাজার কোটি ডলারে। এদিকে টানা ১৫ বছর ধরে ৬ শতাংশ প্রবৃদ্ধিতে ওই বছর বাংলাদেশের অর্থনীতির আকার ছিল ৩৫ হাজার ৫০০ কোটি ডলার। আর মাথাপিছু জিডিপি ১ হাজার ৯৬১ ডলার।
২০০৪ সাল থেকে বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি বাড়তে থাকে উল্লেখ করে তিনি লেখেন, ২০০৮ সালের বৈশ্বিক মন্দার আগে বাংলাদেশের মাথাপিছু জিডিপি ছিল ভারতের অর্ধেক। তবে ২০১৪ সালের মধ্যে তা ৭০ শতাংশ বাড়ে। ২০২০ সালে করোনার কারণে ভারতের অর্থনীতির ৭ দশমিক ৩ শতাংশ সংকুচিত হয়। তবে ওই সময় বাংলাদেশর অর্থনীতির আকার বাড়ে ৩ দশমিক ৫ শতাংশ।
মানব উন্নয়ন কর্মসূচিতে অগ্রসর বাংলাদেশের চিত্র তুলে ধরে তিনি বলেছেন, মেয়েদের শিক্ষার হার বৃদ্ধি পাওয়ায় জন্মহার ও বাল্যবিবাহ কমেছে। গড় আয়ু, জন্মহার ও শিশু পুষ্টির মতো মানব উন্নয়ন সূচকে বাংলাদেশ ভারতের চেয়ে অনেক এগিয়ে গেছে। বিহারে সন্তান জন্মদানের সময় প্রতি ১ হাজার নারীর ৪৭ জনের মৃত্যু হচ্ছে। অন্যদিকে শিক্ষা ও নারীর ক্ষমতায়নে বিনিয়োগের মাধ্যমে মাতৃমৃত্যুর হার কমিয়ে আনতে সফল বাংলাদেশ। এই অর্থনৈতিক অগ্রগতির ব্যাপক সুফল পাচ্ছে বাংলাদেশের মানুষ। সেই তুলনায় ভারত অনেকটা পিছিয়ে। অর্থনৈতিক অগ্রগতির ফলে বাংলাদেশের জনগণের জীবনমান বেড়েছে। যা শিক্ষা ও স্বাস্থ্যখাতে ইতিবাচক প্রভাব ফেলেছে।
অন্যদিকে ভারত মানব উন্নয়ন সূচকে খারাপ করেছে। উদাহরণ হিসেবে তিনি কর্মক্ষেত্রে নারীর হারের কথা উল্লেখ করে বলেছেন, বিশ্ব ব্যাংকের হিসাব অনুযায়ী, গত বছর ভারতে নারী কর্মীর সংখ্যা ছিল ১৯ শতাংশ। এর বিপরীতে বাংলাদেশে এই হার ছিল ৩৫ শতাংশ।
তিনি লিখেছেন, ২০১৬ সালে ভারত কালো টাকা ও জ্ঞাত আয় বহির্ভূত সম্পদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়। এরপর কয়েক বছর দেশটির অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি হ্রাস পায়। এ সময় সেখানে ডিজিটাল লেনদেন বৃদ্ধি পায়। হঠাৎ করে বাজার থেকে ৫০০ ও ১০০০ রুপির নোট প্রত্যাহার করে নেয়ায় সে সময় অর্থনীতিতে বিরূপ প্রভাব পড়ে। ভারতে নোট নিষিদ্ধ করায় সাধারণ জনগণ দৈনন্দিন খাদ্য ও জ্বালানি কিনতে সংকটে পড়েন এবং ব্যবসা-বাণিজ্য ব্যাহত হয়। এক রাতের মধ্যে ৮৬ শতাংশ নগদ অর্থ তুলে নেয়ার পর অর্থনীতিতে ধীরে ধীরে ধস নামতে থাকে। এদিকে বাংলাদেশের অর্থনীতির আকার গত ৫০ বছরে প্রায় ২৭০ গুণ বেড়েছে। বাংলাদেশের বাজেট ঘাটতি জিডিপির ৫ শতাংশ অথবা এর কম থাকছে।
বাংলাদেশ বিশ্বের দ্বিতীয় সর্ববৃহৎ তৈরি পোশাক রপ্তানিকারক দেশ বলে উল্লেখ করে মুনির খসরু লিখেছেন, রপ্তানিভিত্তিক শিল্পকলকারখার সংখ্যা বৃদ্ধির ফলে বাংলাদেশ এমন অবস্থানে উঠে এসেছে। বাংলাদেশের অধিকাংশ রপ্তানিপণ্য মুক্তবাণিজ্য চুক্তির সুবিধা ভোগ করছে। উদ্ভাবন ও স্বল্প বেতন হওয়ায় প্রতিযোগিতামূলক বাজারে অনেক ক্রেতা ভারতের পরিবর্তে বাংলাদেশকে বেছে নিচ্ছে।
ভারতের ষষ্ঠ বৃহৎ বাণিজ্য অংশীদার বাংলাদেশ। ২০২০-২১ অর্থবছরে দুই দেশের মধ্যে ১ হাজার ৮০ কোটি ডলারের দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য হয়েছে। ২০১৯-২০ অর্থবছরে এই বাণিজ্যের পরিমাণ ছিল ৯৫০ কোটি ডলার। ভারত-বাংলাদেশের মধ্যে স্বাক্ষরিত অর্থনৈতিক অংশীদারত্ব চুক্তির আলোকে বাণিজ্য বাড়ছে বলে নিবন্ধে উল্লেখ করা হয়েছে।
বাংলাদেশ এখন দক্ষিণ এশিয়ায় অর্থনৈতিক অগ্রযাত্রার তারকার খ্যাতি উপভোগ করছে বলে নিবন্ধে লিখেছেন মুনির খসরু।