ভারতের পশ্চিমবঙ্গের নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশন থেকে ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট স্টেশনের উদ্দেশে ভারত-বাংলাদেশের মধ্যকার তৃতীয় ট্রেন সার্ভিস ‘মিতালী এক্সপ্রেস’ যাত্রা শুরু করেছে।
বুধবার সকালে উদ্বোধনী অনুষ্ঠান ভারতের নয়াদিল্লি থেকে অনুষ্ঠিত হয়েছে। সকালে সেখান থেকেই ভার্চুয়াল ফ্ল্যাগ অফের মাধ্যমে ট্রেনটির যাত্রা উদ্বোধন করেন বাংলাদেশের রেলপথ মন্ত্রী নূরুল ইসলাম সুজন এবং ভারতের রেলমন্ত্রী আশ্বিনি বৈষ্ণব। ট্রেনটি আগামীকাল বৃহস্পতিবার রাত ৯টা ৫০ মিনিটে ঢাকা ছেড়ে ফের নিউ জলপাইগুড়ির উদ্দেশে যাত্রা করবে।
ট্রেনটি উদ্বোধনের ফলে দুই দেশের সম্পর্ক আরও জোরদার হবে বলে আশা প্রকাশ করে দুই দেশের রেলমন্ত্রী।
ভারতের রেলমন্ত্রী আশ্বিনি বৈষ্ণব বলেন, ‘এই ট্রেনটি দুই দেশের সম্পর্ক জোরদারে একটি মাইলস্টোন হয়ে থাকবে।’
তিনি বলেন, ‘ভারত সব সময় বাংলাদেশের রেলকে মজবুত করতে পাশে থাকবে।’
তিনি আশা করে বলেন, ‘দুই দেশের রেলের সম্পর্ক আরও জোরদার হবে।’
বুধবার সকালে উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে বক্তব্য দেন রেলপথ মন্ত্রী নূরুল ইসলাম সুজন। ছবি: নিউজবাংলাবাংলাদেশের রেলমন্ত্রী নূরুল ইসলাম সুজন বলেন, ‘ট্রেনটি চালুর মধ্য দিয়ে দুই দেশের সম্পর্ক সোনালি অধ্যায় হিসেবে আরও এক উচ্চতায় পৌঁছে গেল।’
তিনি বলেন, ‘রেলওয়ের মাধ্যমে দুই দেশের যে যোগাযোগ তা অবিভক্ত ব্রিটিশ আমল থেকেই। অবিভক্ত ভারতে যে রেল ব্যবস্থা ছিল তা পুনস্থাপনের জন্য আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি।’
তিনি দুই দেশের রেলের উদ্দেশে বলেন, ‘আমরা এবং আপনারা (ভারত) ২ দিন এই ট্রেন অপারেট করব। কিন্তু যদি সম্ভব হয় তাহলে ৫ দিন করা যায়, সে জন্য আমি এখানে প্রস্তাব রাখব। কারণ এই রুট বাংলাদেশে অত্যন্ত জনপ্রিয়। পর্যটন ও শিক্ষার জন্য দুই দেশের মানুষ এই রুট ব্যবহার করে।’
তিনি বলেন, ‘ভারত তার রেলব্যবস্থাকে যেভাবে গড়ে তুলেছে, সেই অভিজ্ঞতা যদি বাংলাদেশের রেলের জন্য আমরা কাজে লাগাতে পারি, তাহলে উভয় দেশই উপকৃত হবে।’
গত বছর ২৭ মার্চ বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ‘মিতালী এক্সপ্রেস’ ট্রেন উদ্বোধন করেন। সে দিন ট্রেনটি চিলাহাটি-হলদিবাড়ী রুটে পরীক্ষামূলকভাবে চলাচল করে। তবে করোনা মহামারির কারণে ট্রেনটি এত দিন নিয়মিত চলাচল শুরু করতে পারেনি, যা বুধবার থেকে চালু হলো।
বাংলাদেশ রেল মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, মিতালী এক্সপ্রেস ট্রেনটি ভারতের নিউ জলপাইগুড়ি থেকে বাংলাদেশের ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট স্টেশনের মধ্য চলাচল করবে। ট্রেনটি হলদিবাড়ী (ভারত)-চিলাহাটি (বাংলাদেশ) রুট দিয়ে চলাচল করবে। এ ট্রেনের পরিচালন সময় ৯ ঘণ্টা ৫৫ মিনিট। নিউ জলপাইগুড়ি ছাড়বে ভারতীয় সময় বেলা ১১টায় আর ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট স্টেশনে পৌঁছাবে বাংলাদেশ সময় রাত ১০টা ৩০ মিনিটে। অনুরূপভাবে ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট ছাড়বে বাংলাদেশ সময় রাত ৯টা ৫০ মিনিটে আর নিউ জলপাইগুড়ি পৌঁছাবে ভারতীয় সময় সকাল ৭টা ১৫ মিনিটে।
ট্রেনটি সপ্তাহে মোট চার দিন চলাচল করবে। ভারত থেকে রোববার ও বুধবার, বাংলাদেশ থেকে সোম ও বৃহস্পতিবার। ট্রেনের ভাড়া এসি বার্থে ৫২৫৫ টাকা, এসি সিট ৩৪২০ ও এসি চেয়ার ২৭৮০ টাকা।
এই ভাড়ার মধ্যে যোগ হবে ভ্রমণ কর, যে কারণে যাত্রীদের নতুন করে খরচ দিতে হবে না। অন্যদিকে পাঁচ বছরের কম বয়সী যাত্রীদের ভাড়া হবে অর্ধেক। নিয়ম অনুযায়ী একজন প্রাপ্ত বয়স্ক যাত্রী সর্বোচ্চ ৩৫ কেজি পর্যন্ত ওজনের মালামাল বিনা মূল্যে বহন করতে পারবেন।
জানা গেছে, শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত চারটি কেভিন কোচ ও চারটি চেয়ার কার ও ডিজেলচালিত ইঞ্জিন থাকবে এই আন্তর্জাতিক এক্সপ্রেস ট্রেনটিতে। এতে মোট আসন সংখ্যা ৪৫৬টি।
বাংলাদেশ রেলওয়ে জানিয়েছে, ট্রেনটি ভারতের দিকের শেষ স্টেশন হলদিবাড়িতে ১০ মিনিট থামবে। আর বাংলাদেশের দিকে প্রথম স্টেশন চিলাহাটিতে চালক পরিবর্তনের জন্য আধা ঘণ্টার জন্য থামবে। এছাড়া এটির আর কোন বিরতি নেই। ট্রেনটি নিউ জলপাইগুড়ি ছাড়ার পর ভারতে হলদিবাড়ী স্টেশনে ভারতীয় সময় ১২টা ৫৫ মিনিটে পৌঁছাবে এরপর ১০ মিনিট বিরতি দিয়ে ১টা ০৫ মিনিটে ফের ছাড়বে।
বাংলাদেশ সময় ১টা ৫৫ মিনিটে ট্রেনটি চিলাহাটি পৌঁছাবে আর ছাড়বে ২টা ২৫ মিনিটে। অন্যদিকে ঢাকা থেকে বাংলাদেশ সময় রাত ৯টা ৫০ মিনিটে ছাড়ার পর চিলাহাটি পৌঁছাবে বাংলাদেশ সময় ভোর ৫টা ৪৫ মিনিটে আর ছাড়বে সকাল ৬টা ১৫ মিনিটে। এরপর ট্রেনটি ভারতীয় সময় ৬টায় হলদিবাড়ী (ভারত) পৌঁছাবে এবং হলদিবাড়ী থেকে ৬টা ৫ মিনিটে ছাড়বে এবং ভারতীয় সময় ৭টা ১৫ মিনিটে নিউ জলপাইগুড়ি পৌঁছাবে।
বাংলাদেশ-ভারতের মধ্যে যাত্রীবাহী ট্রেন চলাচল শুরু হচ্ছে বলে ভারতীয় রেল কর্তৃপক্ষের এমন সিদ্ধান্তের কথা গত ১৭ মে দেশটির পূর্ব রেলের মহাব্যবস্থাপক ও উত্তর-পূর্ব সীমান্ত রেলওয়েকে জানানো হয়। এর পর ভারতীয় রেলের এক চিঠিতে মিতালী এক্সপ্রেস ট্রেনটি চালুর সিদ্ধান্ত চিঠির মাধ্যমে বাংলাদেশে রেলওয়েকে জানানো হয়।
মিতালী এক্সপ্রেস ট্রেনটি ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে তৃতীয় ট্রেন। ইতোমধ্যে দুটি যাত্রীবাহী ট্রেন ‘মৈত্রী এক্সপ্রেস’ এবং ‘বন্ধন এক্সপ্রেস’ দীর্ঘ দুই বছর কোভিড-১৯ পরিস্থিতির কারণে বন্ধ থাকার পর গত রোববার কার্যক্রম শুরু করেছে।
একসময় বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ ও আসামের আটটি রেল সংযোগ ছিল। পাকিস্তান আমলে এসব লাইন বন্ধ করে দেয়া হয়। দুই দেশের মধ্যে সামাজিক ও অর্থনৈতিক যোগাযোগ বাড়ানোর লক্ষে বন্ধ থাকা লাইনগুলো চালুর উদ্যোগ নিয়েছে দুই দেশের সরকার।
প্রথমে ঢাকা-কলকাতা মৈত্রী এক্সপ্রেস চালু হয় ২০০৮ সালের ১৪ এপ্রিল। ঢাকা থেকে বঙ্গবন্ধু সেতু ও লালন সেতু হয়ে দর্শনা-গেদে রুটে এই ট্রেন চলাচল করে সপ্তাহে পাঁচ দিন। এরই ধারাবাহিকতায় বেনাপোল-পেট্রাপোল, চিলাহাটি-হলদিবাড়ি, বিরল-রাধিকাপুর, রোহনপুর-সিঙ্গাবাদ রুটে ট্রেন যোগাযোগ চালু করা হয়।
বর্তমানে চালু থাকা পাঁচটি রুটের মধ্যে বেনাপোল-পেট্রাপোল, দর্শনা-গেদে রুটে যাত্রীবাহী ট্রেন চলাচল করছে। একই সঙ্গে চালু পাঁচটি রুট দিয়ে মালবাহী ও পার্সেল।
২০১৭ সালের ১০ নভেম্বর খুলনা-কলকাতা বন্ধন ট্রেন চালু হয়। বেনাপোল-পেট্রাপোল রুটে সপ্তাহে দুই দিন চলাচল করে এটি। ২০২০ সালের ১৭ ডিসেম্বর চিলাহাটি-হলদিবাড়ী রুটে মালবাহী ট্রেন চলাচল শুরু হয়। দুই দেশের প্রধানমন্ত্রী ওই দিন মালবাহী ট্রেন চালুর মধ্য দিয়ে রুটটি উদ্বোধন করেন। এ রুটে পরের বছরের ২৬ মার্চ থেকে যাত্রীবাহী ট্রেনও পরীক্ষামূলক চলাচল করে।