সারি সারি টেবিলের ওপর প্লেটে প্লেটে সাজানো লিচু। বোঁটা ছাড়ানো, ডাল-পাতা বিহীন। একেকটি প্লেটে লিচুর সংখ্যা প্রায় ৪০ থেকে ৪৫টি। দরদাম করছিলেন নানা বয়সী নারী-পুরুষ। প্রতিটি টেবিলের পেছনেই পিঁড়িতে বসে থাকা বিক্রেতাদের প্রায় সবাই নারী।
ঠাকুরগাঁও রোড মুন্সিরহাট এলাকায় রাস্তার পাশে ব্যতিক্রম এই লিচুর বাজারটি প্রতি বছরই বসে। এবারও দোকান নিয়ে বসেছেন নাসরিন আক্তার, নার্গিস বেগম, আয়েশা বানু, লিপি আক্তারসহ ২০ জনেরও বেশি নারী।
বিক্রেতাদের মধ্যে নাসরিন বেগম বলেন, ‘প্রতি বছর ঢাকার কারওয়ান বাজারের মতন আমরা এখানে পুরুষদের সঙ্গে টক্কর দিয়া ব্যবসা করি। প্লেটে করে থোকা থেকে ছুটে যাওয়া লেচু বেচি। এক ধামা লেচু ৫০০ টাকায় কিনে ১২০০ থেকে ১৫০০ টাকাও বেচি। এবারে শিলাবৃষ্টি আর কালবৈশাখীতে সব ঝইড়া গেছে। তাই লেচু কম, দামও বেশি।’
নাসরিন জানান, গত বছর যে প্লেট ভর্তি লিচু তিনি ৩০ টাকা দরে বিক্রি করেছেন, এবার তার দাম চাইছেন ৮০ টাকা করে। ৭০ টাকার নিচে এবার বাজারে কোনো প্লেট নেই। তবে লিচুর মানভেদে দামেও কিছু তারতম্য রয়েছে।
মানের কারণেই বাজারের আরেক ব্যবসায়ী নার্গিস বেগম এক প্লেট লিচু বিক্রি করছেন ১৫০ টাকায়। তিনি বলেন, ‘আজ বাজারের সেরা লেচু আমার। তাই দাম বেশি। আমার কাছে কম দামেরও লেচু আছে। এগুলো কিছুটা ছেঁড়া-ফাটা। ভালো লেচুর দাম বেশি।’
বিক্রেতা লিপি জানান, সেই কাকডাকা ভোরে তার স্বামী কয়েকটি লিচু বাগানে যান। এসব বাগান থেকে তিনি ঝরে পড়া লিচু কিনে আনেন। এগুলোই পরে প্লেটে সাজিয়ে বিক্রি করেন লিপি।
তিনি বলেন, ‘এবার লেচুর আমদানি কম, ব্যবসায়ী বেশি। কাস্টমারের চাহিদা পূরণ করতে পারতেছি না।’
লিচু কিনতে আসা খগেন বর্মণ বলেন, ‘প্রতি বছর এখানে নারীরা লিচু বিক্রি করেন। আমরা যারা বাজারে বেশি দামে লিচু কিনতে পারি না তারা এখানে কম দামে কিনি। আমি ৫ কিলোমিটার দূর থেকে এসেছি এখানে লিচু কিনতে।’
আরেক ক্রেতা ইদ্রিস আলী বলেন, ‘এই বাজারটা গরীবের বাজার। এবার একটু দাম বেশি হলেও বাগানের ছোটা লিচুটা কম দামেই পাই। তাই নাতিদের জন্য ১০০ টাকায় লিচু নিলাম ২ প্লেট। অনেক দরদাম করেই নিতে হলো। লিচু ৭০ এর কমে কেউ বিক্রি করছে না।’
মুন্সিরহাট বাগানবাড়ি এলাকার ভেতরে গিয়ে দেখা যায়, লিচু ভাঙ্গার কাজ চলছে। ফলন নিয়ে হতাশ বাগান মালিক মালিকেরা। তাদেরই একজন আজিজুল হক জানান, গত বছর যে বাগান থেকে তিনি আড়াই লাখ লিচু পেয়েছেন এবার পেয়েছেন মাত্র ৩০ হাজার।
তিনি বলেন, ‘দফায় দফায় শিলাবৃষ্টি আর কাল বৈশাখী আমাদের পথে বসিয়েছে।’
বাগান মালিক আব্দুল মালেক জানান, জেলার সব উপজেলায় কম বেশি শিলাবৃষ্টি হলেও মুন্সিরহাট গোবিন্দনগর এলাকায় ২৫০ একর জমির বাগান সবেচেয় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
জেলা কৃষি কর্মকর্তা আবু হোসেন বলেন, ‘জেলায় মোট ৯০০ হেক্টর জমিতে লিচুর আবাদ হয়েছে। এবার শিলাবৃষ্টিতে লিচু ও আমের কিছুটা ক্ষতি হয়েছে। বিশেষ করে মুন্সিরহাট, গোবিন্দনগর এলকার বাগানগুলো বেশি আক্রান্ত হয়েছে। তাই এ অঞ্চলে লিচুর দাম বেশি।’
এর আগে ভ্রাম্যমাণ লিচু বাজারটির ব্যবসায়ী নুরজাহান বেগমের কণ্ঠেও হতাশার সুর শোনা গেছে। নিউজাংলাকে তিনি বলেন, ‘ঘূর্ণীঝড় পাথরে বাগানের সব লেচু ঝইড়া গেছে। এবার তাই ব্যবসা হইতেছে না। প্রতিবার পিঁড়ি নিয়ে বইসা আধবেলায় এক হাজার টাকা কামাইতাম। এবার সারাদিন বইসাও ৫০০ টাকা কামাইতে পারতাছি না।’