সাত দফা প্রস্তাবের ভিত্তিতে জনসংহতি আন্দোলনের সঙ্গে ‘যুগপৎ ধারা’য় আন্দোলনে একমত হওয়ার কথা জানিয়েছেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।
মঙ্গলবার দুপুরে হাতিরপুলে গণসংহতি আন্দোলনের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে দলটির সঙ্গে দুই ঘণ্টার রাজনৈতিক সংলাপ অনুষ্ঠান শেষে এ কথা জানান তিনি।
সরকারবিরোধী আন্দোলনে নামতে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে ধারাবাহিক সংলাপের অংশ হিসেবে এই বৈঠক হয়। সংলাপে গণসংহতি আন্দোলনের পক্ষ থেকে বিএনপিকে সাত দফা প্রস্তাব দেয়া হয়। ক্ষমতায় গেলে কী কী করতে হবে, সেই বিষয়গুলো সন্নিবেশিত আছে এই সাত দফায়।
দুপুর সোয়া ১২টায় হাতিরপুলে গণসংহতি আন্দোলনের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে আসেন মির্জা ফখরুল। সঙ্গে ছিলেন স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকু ও সাবেক সংসদ সদস্য জহির উদ্দিন স্বপন।
গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক জোনায়েদ সাকির নেতৃত্বে ১১ সদস্যের প্রতিনিধিদল আলোচনায় অংশ নেয়।
সংলাপে বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়াসহ রাজনৈতিক নেতাদের মুক্তি, নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে মামলা প্রত্যাহারসহ বিদ্যমান সংবিধানের মৌলিক সংশোধনসহ নানা বিষয়ে আলোচনা হয়।
বৈঠক শেষে দেশের সব মানুষ ও রাজনৈতিক দলগুলোকে ঐক্যবদ্ধ করে একটা ‘জনগণের সরকার প্রতিষ্ঠার জন্য’ একমত হওয়ার কথা জানান ফখরুল। জানান, যুগপৎ আন্দোলনের ব্যাপারে তারা একমত হয়েছে।
বিএনপি নেতা বলেন, ‘আমরা বিশ্বাস করি, অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা যেটা শুরু করেছি, সেটা অতি দ্রুত শেষ করে একটা যৌক্তিক পর্যায়ে এসে পৌঁছতে পারব এবং এই সরকার যারা আমাদের রাষ্ট্রব্যবস্থাকে ধ্বংস করছে, যারা আমাদের মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষাগুলোকে হত্যা করছে, তাদের বিরুদ্ধে একটা ফলপ্রসূ আন্দোলন করে এতে জয়যুক্ত হতে সক্ষম হব।’
তিনি বলেন, ‘যে বিষয়গুলোতে আমরা একমত হয়েছি তা হচ্ছে যে, এই সরকারকে পদত্যাগ করতে হবে, সংসদ বাতিল করতে হবে। সংসদ বাতিল করে একটা নিরপেক্ষ নির্বাচনকালীন সরকার গঠন করতে হবে। তাদের অধীনে নির্বাচন কমিশন গঠন হবে, তাদের মাধ্যমে নির্বাচন হবে। সেই নির্বাচনের মাধ্যমেই ভবিষ্যতে পার্লামেন্ট ও সরকার গঠিত হবে।’
গণসংহতির সঙ্গে ধারণাগত কোনো পার্থক্য নেই বলেও জানান বিএনপি নেতা। বলেন, ‘আমাদের আলোচনায় মৌলিক কোনো মতভেদ দেখিনি। তবে নির্বাচনকালীন সরকারের নামের বিষয়ে মতভিন্নতা থাকতে পারে, অন্তর্বর্তীকালীন না নিরপেক্ষ সরকার। এটা নিয়ে কোনো সমস্যা হবে না। আমরা আলোচনার মাধ্যমে এই বিষয়ে ঐকমত্যে পৌঁছাতে পারব।’
গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক জোনায়েদ সাকি বলেন, ‘আমাদের দলের পক্ষ থেকে এটা স্পষ্টভাবে মনে করি, বর্তমান সরকারের পতনের জন্য আন্দোলন দরকার। এইভাবে যদি একটা জাতীয় রূপরেখা আজকে বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর কাছ থেকে হাজির হয়, তাহলে জনগণ নতুন করে আন্দোলিত হবে। একটা বৃহত্তর ঐক্য গড়ে তুলে বর্তমান সরকারকে পদত্যাগে বাধ্য করতে পারব।’
সাকি মনে করেন, বাংলাদেশের সাংবিধানিক যে ক্ষমতা আছে, যেটার ওপরে ভর করে বর্তমান সরকার ফ্যাসিবাদ কায়েম করেছে। এই ক্ষমতাকাঠামোর বদল দরকার। সে জন্য আমরা সাংবিধান সংস্কারের সুনির্দিষ্ট কতগুলো প্রস্তাব দিয়েছি।
তিনি বলেন, ‘আমরা মনে করি, নির্বাহী বিভাগ থেকে বিচার বিভাগকে সম্পূর্ণ আলাদা করতে হবে, নিম্ন আদালতকে উচ্চ আদালতের অধীনস্থ করতে হবে, সমস্ত দিক থেকে তার নিয়োগ-বদলি, পদোন্নতিসহ …।
‘উচ্চ আদালতের বিচারক নিয়োগের সুনির্দিষ্ট পদ্ধতি করতে হবে এবং জ্যেষ্ঠতার লঙ্ঘন করার কোনো রকম তৎপরতা কিংবা কোনোভাবেই জ্যেষ্ঠতা লঙ্ঘন করা যাবে না।
‘আমরা মনে করি এই সরকারের পতনের পরে ভবিষ্যৎ রাষ্ট্রটি কীভাবে চলবে, এই বিষয়ে সাংবিধানিক সংস্কারের মাধ্যমে রাষ্ট্রের গুণগত রূপান্তর বা গণতান্ত্রিক রূপান্তর, নতুন একটা গণতান্ত্রিক বন্দোবস্ত তৈরির মধ্য দিয়েই বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে নতুন স্বপ্ন তৈরি হতে পারে।’
গণসংহতির সাত প্রস্তাব
১. আইন বিভাগকে নির্বাহী বিভাগের কর্তৃত্ব থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত করা। উচ্চ আদালতে বিচারক নিয়োগের জন্য স্বচ্ছ পরীক্ষা পদ্ধতি এবং জ্যেষ্ঠতা লঙ্ঘন না করার কঠোর নীতিমালা প্রণয়ন। নিম্ন আদালতের নিয়োগ, বদলি, পদোন্নতিসহ সার্বিক কার্যক্রম তদারকির ক্ষমতা উচ্চ আদালতের অধীনস্ত করা, সব গণবিরোধী, নাগরিক অধিকার খর্বকারী, উপনিবেশিক নিয়ন্ত্রণের লক্ষ্যে সৃষ্ট আইন যা এখনো বলবৎ আছে সেসব আইন বাতিল করে একটা গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ও স্বাধীন দেশের উপযোগী আইনকানুন ও আইনি কাঠামো তৈরি, আর্থিক প্রতিষ্ঠানসমূহের জবাবদিহি নিশ্চিতের জন্য আইন প্রণয়ন।
২. সমস্ত সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান যেমন নির্বাচন কমিশন, অ্যাটর্নি জেনারেল, মহা হিসাব-নিরীক্ষক, পাবলিক সার্ভিস কমিশন, মানবাধিকার কমিশন, দুর্নীতি দমন কমিশন ইত্যাদিতে সাংবিধানিক কমিশনের মাধ্যমে নিয়োগ পদ্ধতি প্রণয়নের জন্য প্রয়োজনীয় সাংবিধানিক সংস্কার করা। একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচনে গঠিত সংসদের সরকারি দল, বিরোধী দল ও বিচার বিভাগের প্রতিনিধিদের দ্বারা এই কমিশন গঠিত হবে।
৩. রাষ্ট্রপ্রধান ও সরকারপ্রধানের মধ্যে ক্ষমতার পৃথকীকরণ ও ভারসাম্য প্রতিষ্ঠার সুনির্দিষ্ট বিধান প্রণয়ন। সংসদের উচ্চকক্ষ গঠন ও প্রাদেশিক ব্যবস্থা প্রবর্তনের জন্য প্রয়োজনীয় সাংবিধানিক সংস্কার।
৪. সংখ্যানুপাতিক নির্বাচন ব্যবস্থার প্রবর্তন। নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা ও প্রচারণায় টাকার খেলা, পেশিশক্তি, প্রশাসনিক কারসাজি, সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষ ব্যবহারের পথ বন্ধ করতে প্রয়োজনীয় আইনি সংস্কার।
৫. সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ সংস্কার করে সংসদ সদস্যদের (কেবলমাত্র সরকার গঠনে আস্থা ভোট ও বাজেট পাসে ভোট প্রদান ব্যতিরেকে) স্বাধীনভাবে জনগণের প্রতিনিধিত্ব ও সকল বিলে ভোট প্রদানের অধিকার নিশ্চিত করা। সরকার ও দলের ক্ষমতাকে পৃথকীকরণে আইন প্রণয়ন।
৬. বিদ্যমান সংবিধানের ‘স্থানীয় শাসন ব্যবস্থার বদলে স্থানীয় সরকারব্যবস্থার প্রতিষ্ঠা এবং স্থানীয় সকল উন্নয়ন কর্মকাণ্ড, আইনশৃঙ্খলা, শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও নাগরিক সেবা এবং এর প্রয়োজনীয় বাজেট প্রণয়ন, কর সংগ্রহ ও সংরক্ষণ নিশ্চিত করার লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় সাংবিধানিক সংস্কার।
৭. দেশের সমস্ত অর্থনৈতিক ও ব্যবস্থাপনাগত আয়োজনের ক্ষেত্রে প্রাণ-প্রকৃতির সুরক্ষা নিশ্চিত করতে আইনি বিধান। জাতীয় সম্পদ ব্যবহার ও জাতীয় নিরাপত্তা ব্যতীত সকল আন্তর্জাতিক চুক্তি সংসদে আলোচনা বাধ্যতামূলক করা। মুক্তিযুদ্ধের ঘোষিত অঙ্গীকার অনুযায়ী দেশের সকল নাগরিকের জন্য সাম্য, মানবিক মর্যাদা, সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার আইনি সুরক্ষা এবং ধর্ম, বর্ণ, ভাষা ও লিঙ্গীয় পরিচয় নির্বিশেষে সকল নাগরিকের জীবন সম্পদ মর্যাদার নিরাপত্তা বিধান।