ঠিকমতো মজুরি দেয়া হয় না, মজুরি আটকে রাখা হয় দীর্ঘদিন, দেয়া হয় না ছুটি, চুক্তি শেষেও ভাটা ছেড়ে যেতে দেয়া হয় না। কেউ চলে যেতে চাইলে করা হয় মারধর।
এসব অভিযোগ খুলনার বিভিন্ন ইটভাটার শ্রমিকের। রূপসা উপজেলায় ভাটার সংখ্যা সবচেয়ে বেশি হওয়ায় অভিযোগও এখানে বেশি।
তবে এ ধরনের অভিযোগ অস্বীকার করেছে ভাটার মালিক ও সরকারি কর্তৃপক্ষ।
জেলা প্রশাসনের দেয়া তথ্য অনুযায়ী, খুলনার নয় উপজেলায় ১৫৩টি লাইসেন্সধারী ইটভাটা আছে। আর জেলা ইটভাটা শ্রমিক ইউনিয়ন জানিয়েছে, সব মিলিয়ে খুলনায় ৩০০টি ইটভাটা আছে। এসব ভাটায় শ্রমিকের সংখ্যা ৫০ হাজারের বেশি।
বাগেরহাটের ৩০ বছর বয়সী রুহুল আমিন শেখ কাজ নিয়েছিলেন রূপসার শ্রীফলতলা ইউনিয়নের আজাদ ব্রিকসে।
২০২১ সালের নভেম্বরে তিনি এখানে কাজ শুরু করেন। মো. সালাম নামের এক শ্রমিক সর্দারের সঙ্গে ২০২২ সালের এপ্রিল পর্যন্ত ছয় মাসের কাজের চুক্তি হয়েছিল।
রুহুল নিউজবাংলাকে বলেন, ‘চুক্তি অনুযায়ী আমি আর আমার স্ত্রী আসমা বেগম কাজে যোগ দেই। ওই ভাটায় শ্রমিকদের জন্য অস্থায়ী বসতি আছে। সেখানেই আমাদের একমাত্র সন্তানকে নিয়ে থাকতাম।
‘ছয় মাস পর চুক্তির মেয়াদ শেষ হলেও সর্দার আমাদের ছাড়তে চাননি। তিনি বলেছিলেন, বর্ষাকাল না আসা পর্যন্ত আমাকে কাজ করতে হবে।’
রুহুল আরও বলেন, ‘একদিন সন্ধ্যায় স্ত্রী-সন্তানকে নিয়ে ভাটার বাইরে বের হওয়ায় সর্দারের লোকরা মনে করেছিল আমি পালিয়ে যাচ্ছি। তখন তারা আমাকে ভাটার একটি ঘরে ধরে নিয়ে যায়। রাতভর আমার ওপর নির্যাতন চালায়। একপর্যায়ে আমি জ্ঞান হারিয়ে ফেলি। তখন তারা আমার স্ত্রীকেও শারীরিক নির্যাতন করে।
‘তারা আমার মোবাইল কেড়ে নিয়েছিল যেন কাউকে নির্যাতনের কথা বলতে না পারি। পরদিনও ওই ঘরে আমাদের আটকে রাখা হয়। বিকেলে এক শ্রমিকের সহায়তায় আমার স্ত্রী সেখান থেকে পালিয়ে পুলিশের কাছে যায়। পুলিশ আমাকে উদ্ধার করে হাসপাতালে ভর্তি করে।’
আশিকুর রহমান নামের এক শ্রমিক বলেন, ‘আমি প্রায় আট বছর ধরে বিভিন্ন ইটভাটায় কাজ করছি। মৌসুমের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত কোনোদিনই ছুটি পাওয়া যায় না। খুব বেশি প্রয়োজন হলে এক থেকে দুই দিন ছুটি দেয়। এর বেশি নয়।
‘অনেক সর্দার শ্রমিকদের ভাটার বাইরেও যেতে দিতে চান না।’
ইটভাটায় যিনি বিভিন্ন কাজের জন্য শ্রমিক জোগাড় করেন তাকে বলে শ্রমিক সর্দার। তার তত্ত্বাবধানে শ্রমিকরা মাটি কাটা থেকে শুরু করে ইট বিক্রির আগ পর্যন্ত সব কাজ করেন।
সবুর আলী নামের এক শ্রমিক সর্দার বলেন, ‘মৌসুমের শুরুতে আমি গ্রামে গ্রামে ঘুরে শ্রমিক সংগ্রহ করি। আবার মৌসুম শেষে তাদের ছেড়ে দিই। কাজের শুরুতে শ্রমিকদের সঙ্গে মজুরির চুক্তি করে নিই।
‘অনেক সময় ছয় মাসেও মৌসুম শেষ হয় না। বর্ষা না আসা পর্যন্ত ইট তৈরির কাজ চলে। তখন নতুন করে আর শ্রমিক পাওয়া যায় না। সেজন্য আগের শ্রমিকদেরই থাকতে বলা হয়। তবে জোরাজুরি বা মারধর করা হয় না।’
বেতনের বিষয়ে ভাটার শ্রমিকরা জানান, কাজভেদে শ্রমিকদের মজুরি ভিন্ন ভিন্ন হয়। ভাটা ভেদেও পার্থক্য আছে।
মাটি কাটা শ্রমিকদের কোথাও মজুরি দেয়া হয় দিন হিসেবে, কোথাও কাজের পরিমাণ হিসেবে। যারা বর্গফুট হিসেবে মজুরি পান, তারা প্রতি এক হাজার ফুট মাটি কাটলে পান সাড়ে ৩ হাজার টাকা। যারা দিনমজুর তারা সকাল ৬টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত মাটি কেটে পান ৪০০ থেকে ৫০০ টাকা।
ইট বানানোর জন্য যারা কাদামাটি তৈরি করেন তারা ভোর ৪টা থেকে কাজ শুরু করেন। প্রতি হাজার ইটের সমপরিমাণ কাদামাটি তৈরি করে ৩০০ থেকে ৩৫০ টাকা পান।
ইট প্রস্তুতকারী কারিগররা প্রতি হাজার ইটে ১৫০ টাকা থেকে ২০০ টাকা মজুরি পান। কারিগরের সহযোগীরা পান, প্রতি হাজারে সর্বোচ্চ ১০০ টাকা।
যেসব শ্রমিক কাঁচা ইট চুল্লি পর্যন্ত বহন করেন তারা প্রতি হাজার ইটে ১৫০ থেকে ২০০ টাকা পান। ভাটার চুল্লি থেকে পোড়া ইট যারা বের করেন তাদের দেয়া হয় ১৮০ থেকে ২০০ টাকা।
প্রতি হাজার ইট তৈরির জন্য শ্রমিক সর্দাররা ভাটার মালিকের কাছ থেকে পাঁচ থেকে সাত হাজার টাকা নেন। টিকিট মাস্টার, রাবিশ ম্যান এবং ফায়ার ম্যানরা কাজ করেন মাসিক বেতনের ভিত্তিতে। তাদের বেতন ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকা।
লিয়াকত আলী নামের এক শ্রমিকের অভিযোগ, মৌসুম শেষের দিকে শ্রমিক সর্দাররা কিছু টাকা আটকে রাখে যেন মৌসুম শেষ হওয়ার আগে কোনো শ্রমিক চলে যেতে না পারে।
ইটভাটা শ্রমিক ইউনিয়নের রূপসা থানা শাখার সভাপতি জলিল মোড়ল বলেন, ‘অধিকাংশ ভাটায় শ্রমিকরা ঠিকমতো মজুরি পায় না। একদিকে ইট বিক্রি না হওয়া পর্যন্ত মালিকরা টাকা দিতে চায় না অন্যদিকে সর্দাররা দীর্ঘদিন বেতন আটকে রাখে।
‘এখন বাজারে সবকিছুর দাম অনেক বেশি। শ্রমিকরা পর্যাপ্ত মজুরি তো পায়ই না, সেই সঙ্গে শারীরিক-মানসিক নির্যাতনের শিকার হন।’
এমন অভিযোগের বিষয়ে জেলা ইটভাটা মালিক সমিতির সভাপতি জলিল খান কালাম বলেন, ‘আমরা শ্রমিকদের মজুরি কম দেই এটা সঠিক না। প্রতি বছর মজুরি পর্যালোচনা করা হয়। এবারও বিভিন্ন পর্যায়ের শ্রমিকদের মজুরি বাড়ানো হয়েছে।’
কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদপ্তরের খুলনা কার্যালয়ের উপমহাপরিদর্শক আরিফুল ইসলাম নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আগে এক সময় ছুটি দেয়া হতো না। শ্রমিদের নানা রকমের নির্যাতন করা হতো। এখন আমরা ইটভাটা মালিক সমিতির সঙ্গে নিয়মিত আলোচনা করি। শ্রমিকদের সুবিধা বাড়ানোর চেষ্টা করি।’