বাংলাদেশকে জ্বালানি ও গম দিতে চায় রাশিয়া। কিন্তু নিষেধাজ্ঞার ভয়ে এখনো এ ব্যাপারে কোনও সিদ্ধান্ত নেয়নি ঢাকা। অবশ্য প্রতিবেশী দেশ ভারত রাশিয়া থেকে জ্বালানি কিনছে। এ অবস্থায় রাশিয়া থেকে প্রয়োজনীয় এ দুটি পণ্য কিনতে বুদ্ধি-পরামর্শ চেয়েছে বাংলাদেশ।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন সোমবার সাংবাদিকদের এ কথা বলেছেন।
আসামের গুয়াহাটিতে নদী বিষয়ক আন্তর্জাতিক কনক্লেভে যোগদান শেষে রোববার দেশে ফিরে পরদিন সাংবাদিকদের সঙ্গে কথা বলেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী।
ইউক্রেনে রাশিয়ার সামরিক অভিযান ও উদ্ভূত পরিস্থিতির উল্লেখ করে ড. মোমেন বলেন, ‘বাংলাদেশ শান্তি চায়, স্থিতিশীলতা চায়। আমরা বরাবরই যুদ্ধের বিপক্ষে। করোনার পর আবার নতুন কোনো ঝামেলা নিতে চায় না বাংলাদেশ। যত তাড়াতাড়ি এর শেষ হয় তত ভালো।’
পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘রাশিয়া আমাদের জ্বালানি ও গম দিতে চায়। আমরা এখনো তা নেইনি। আমরা তো ভয়ে। নিষেধাজ্ঞার ভয়ে। আমি তাদের কাছে (জয়শঙ্করের কাছে) ফন্দি-ফিকির জানতে চাইলাম। বললাম- তোমরা তো নিচ্ছ। কিভাবে নিচ্ছ! তারা জানাল, ফাঁক-ফোকর বের করেছে। আমিও বুদ্ধি চাইলাম।
‘আমাদের তো এনার্জি দরকার। এটা আমাদের বড় সমস্যা। তারা (পশ্চিমারা) কথায় কথায় নিষেধাজ্ঞা দেয়। দেখেন না, তারা প্রতিদিনই কিছু না কিছু আবদার নিয়ে আসে। আমরা তাদেরকে বলতাম ডেভেলপমেন্ট পার্টনার। এখন উন্নয়নের জন্য এক পয়সাও দেয় না। ডেভেলপমেন্ট যাতে বাধাগ্রস্ত হয়, সেজন্য চেষ্টা করছে। খালি আসে বুদ্ধি দিতে। আপনারাও তাদেরকে উৎসাহ দিতে থাকেন।’
মোমেন বলেন, ‘ভারত বড় দেশ। তাদের সবাই ভয় পায়। আমরা দরিদ্র, ছোট দেশ। আমাদের ভয়েই থাকতে হয়।
‘আমরা আলোচনা করেছি। আঞ্চলিক কিছু সংস্থা গড়ে তুলতে চাই, যাতে কোনো সমস্যা দেখা দিলে সবাই মিলে মোকাবেলা করা যায়। আমরা মাল্টি রিলেশনে বিশ্বাস করি। জোট নিয়ে ভাবি না। আমরা সার্ক করেছিলাম। তারা বলেছিল, এটা পুওর মেন ক্লাব। এখন তারা এই পুওর মেন ক্লাবের দিকেই নজর দিচ্ছে।’
পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, আমেরিকা এখানে কী একটা করছে। পশ্চিমারা, ইউরোপিয়ানরা আগে নিজেদের ঘর সামলাক। তাদের দেশে মুদ্রাস্ফীতি চার গুণ বেড়েছে। আমাদের প্রবাসীরা, যারা আমেরিকায় আছেন, তারাও সামলাতে পারছেন না।’
তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশ শান্তিপ্রিয় দেশ। ইউক্রেন যুদ্ধের জন্য চারদিকে হাহাকার শুরু হয়েছে। আমরা যুদ্ধ বন্ধ চাই। রাশিয়া গম ও জ্বালানি দিতে চায়। আমরা নিলে পশ্চিমারা নিষেধাজ্ঞা দেয়, মাতব্বরি করতে থাকে। বড় দেশ হিসেবে ভারত এসব কীভাবে ম্যানেজ করছে সে সম্পর্কে তাদের সঙ্গে কৌশলগত আলোচনা হয়েছে।
‘গম দেবে ভারত’
গুয়াহাটিতে নদী সম্মেলনে যোগদানের ফাঁকে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্করের সঙ্গে সাইড লাইনে বৈঠক করেন মোমেন। এ সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘জয়শঙ্করের সঙ্গে দেখা হলো। আমাদের ইমিডিয়েট ইস্যু ছিলো গম। জয়শঙ্কর বললেন, গম নিয়ে সমস্যা হবে না। সরকারের সঙ্গে যেসব চুক্তি হয়েছে বা বেসরকারি খাতেও আমদানিতে সমস্যা নেই। কেবল বেসরকারি খাত যদি তৃতীয় দেশে গম পাঠাতে চায়, সেটা তারা দেবে না।’
‘বাংলাদেশের কারণেই সেভেন সিস্টার্সে উন্নতি হচ্ছে’
বাংলাদেশের কারণেই ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের সেভেন সিস্টার্স খ্যাত সাত রাজ্যের উন্নতি হচ্ছে বলে মন্তব্য করেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. একে আব্দুল মোমেন।
তিনি বলেন, ‘আসামের মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্বশর্মা বলেছেন যে তার রাজ্য তথা এ অঞ্চলের উন্নতি হয়েছে বাংলাদেশের কারণে। সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জিরো টলারেন্সের সুবাদে আসাম, মিজোরামসহ ওই অঞ্চলের উন্নতি হয়েছে।
‘আগে আসামে একটি বিশ্ববিদ্যালয় ছিলো। এখন সেই সংখ্যা ১৯টি। আগে একটি হাসপাতাল ছিলো এখন বিশ্ব মানের হাসপাতালের সংখ্যা ৬টি। ৫০ বছর আগে সেখানে কিছুই ছিল না। সন্ত্রাস দমন করার কারণেই এটি সম্ভব হয়েছে।’
জেসিসি বৈঠক ১৯ জুন
জেসিসি বৈঠক পিছিয়ে যাওয়া প্রসঙ্গে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘পাওয়ার শেয়ারিং বিষয়ে আমাদের সচিব পর্যায়ের মিটিং এখনও শেষ হয়নি। সড়ক এবং রেল যোগাযোগ বিষয়েও মিটিং শেষ হয়নি। এগুলো সম্পন্ন না হলে আমরা গিয়ে কী করবো?
‘আমরা দেখলাম ওইসব মিটিং শেষ হতে দুই সপ্তাহ লাগবে। আমরা তা তাদের জানালাম। কিন্তু দেখা গেলো, ওই সময় তাদের আবার অন্য মিটিং আছে। তারপর তারা বললেন, তাহলে এটা ১৯ তারিখ করা হোক। আমরা তাতে রাজি হলাম। ১৮ তারিখে অন্য কিছু হয়তো আছে। তাই বলা যায় ১৯ তারিখে জেসিসি মিটিং হবে। ১৮ তারিখে আরো কিছু বাইলেটারাল মিটিং আছে। আমরা এবার কোনো ফরমাল মিটিং করিনি।’
‘অন্য মন্ত্রণালয়গুলোকে তাগাদা দিয়েও কাজ হচ্ছে না’
আব্দুল মোমেন বলেন, ‘পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় আসলে পোস্ট বক্স। অন্য মন্ত্রণালয় কাজ এগিয়ে নিলে আমরা এসে তা ফিট করে দিতে পারি। এ ক্ষেত্রে মন্ত্রণালয়গুলো কাজ করতে পারছে না। এসব ক্ষেত্রে আমরা তাগাদা দিতে পারি। কিন্তু তাগাদা দিয়েও সুবিধা হচ্ছে না।
‘আমাদের প্রধানমন্ত্রী ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী মোংলা ও চট্টগ্রাম বন্দর থেকে জাহাজ চলাচল উদ্বোধন করবেন। কিন্তু তা হচ্ছে না। কেন হচ্ছে না জানতে চাইলে তাদের উত্তর- ওইখানে ড্রেজিং লাগবে।’
‘জাতিসংঘ মনে করে রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশেই থাকা উচিত’
মোমেন বলেন, ভারত থেকে রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে ঠেলে পাঠানোর বিষয়টি আনুষ্ঠানিকভাবে দিল্লি মানতে নারাজ। ভারত থেকে রোহিঙ্গা আসার বিষয়টি আমি সেদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জয়শঙ্করকে বলেছি। তারা অফিশিয়ালি এটা স্বীকার করেননি। তারা বলেছেন, এটা দালালের মাধ্যমে হয়ে থাকতে পারে।
‘সাম্প্রতিক সফরে রোহিঙ্গা ইস্যুতে ইউএনএইচসিআর প্রধান ফিলিপ গ্রান্ডি আমাকে বলেছেন, তারা (রোহিঙ্গা) বাংলাদেশে ভালো আছে। তাদের বাংলাদেশেই থাকা উচিত। আমি বলেছি, এটা আমরা মানতে পারছি না। আপনারা মিয়ানমারে নজর দিন। বিগত পাঁচ বছর মিয়ানমারে কোনো সহিংসতা নেই। সেখানে পরিবেশ উন্নত করে তাদের সেখানে নিয়ে যান।’
নদী সম্মেলন
শিলংভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান ও থিঙ্কট্যাঙ্ক এশিয়ান কনফ্লুয়েন্স আসামের গুয়াহাটিতে ২৮-২৯ মে নদী বিষয়ক আন্তর্জাতিক কনক্লেভের আয়োজন করে। এতে যোগ দেন ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এস জয়শঙ্কর। আমন্ত্রিত হিসেবে এতে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেনও যোগ দেন।
এই সম্মেলনে অংশগ্রহণ শেষে রোববার দেশে ফেরেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী। পরদিন সোমবার ঢাকায় সাংবাদিকদের সঙ্গে ওই সম্মেলন নিয়ে কথা বলেন তিনি।
মোমেন জানান, এই অঞ্চলে বন্যা সম্পর্কে আগাম সতর্কতা জানিয়ে দিতে ভারতকে আহ্বান জানিয়েছেন তিনি।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘আমরা বাংলাদেশ-ভারত নির্বিশেষে সব নদী সচল চাই। আমরা সবাই বন্ধু-রাষ্ট্র। ভারত নদী নিয়ে এ অঞ্চলে আসিয়ান দেশগুলোকেও সম্পৃক্ত করতে চায়।