নরসিংদী রেলস্টেশনে তরুণীকে হেনস্তার ঘটনায় করা মামলায় আসামি মার্জিয়া আক্তারকে গ্রেপ্তার করার কথা জানিয়েছে র্যাব।
শিবপুরে এক আত্মীয়ের বাসা থেকে রোববার রাত ৩টার দিকে র্যাবের একটি দল তাকে গ্রেপ্তার করে।
নিউজবাংলাকে এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন র্যাব-১১-এর কোম্পানি কমান্ডার ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট তৌহিদুল মবিন খান।
তিনি বলেন, ‘রেলস্টেশনে তরুণীকে হেনস্তার ঘটনার ভিডিও ফুটেজ দেখে মার্জিয়া আক্তারকে শনাক্ত করা হয়। তাকে সোমবার র্যাব হেড কোয়ার্টারে পাঠানো হবে। ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা পরবর্তী বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবেন।’
মার্জিয়ার বড় মেয়ে লিজা আক্তার নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমার ষাটোর্ধ্ব বয়সী মা শিবপুর ইটাখোলার মুন্সি ভার্চর গ্রামে খালার বাড়িতে ছিলেন। রেলওয়ে স্টেশনে তরুণী হেনস্তার বিষয়ে নাকি মা সম্পৃক্ত ছিলেন।
‘রোববার রাত আড়াইটার দিকে আমি জানতে পারি মাকে র্যাব পরিচয়ে তুলে নিয়ে গেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষা বাহিনীর লোকজন।’
তিনি বলেন, ‘আমরা তিন বোন। এর মধ্যে দুই বোনের বিয়ে হয়ে গেছে। ছোট বোন অসুস্থ হওয়ায় মা তাকে নিয়েই উপজেলা মোড়ের পশ্চিম ব্রাহ্মদী এলাকায় ভাড়া বাসায় থাকতেন।’
স্টেশনে তরুণীকে হেনস্তাকারী নারী অন্য ব্যক্তি ছিলেন দাবি করে লিজা আক্তার বলেন, ‘তিনি ওই দিন রেলস্টেশনে ছিলেন তা ঠিক আছে। তবে আমি ভাইরাল ভিডিওটি দেখেছি, তাতে আমার মাকে দেখা যায়নি।’
তরুণী হেনস্তা মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ভৈরব থানার উপপরিদর্শক হারুনুজ্জামান রুমেল নিউজবাংলাকে বলেন, ‘র্যাব-১১-এর সঙ্গে যোগাযোগ করে এ বিষয়ে বিস্তারিত জানানো হবে।’
যা ঘটেছিল
ফেসবুকে হেনস্তার ভিডিওটি ভাইরাল হয় ১৯ মে বৃহস্পতিবার সকাল থেকে। ঘটনাটি নরসিংদী রেলওয়ে স্টেশনে তার আগের দিন ভোরে ঘটে।
স্টেশন ঘুরে ১৯ ও ২০ মে দুই দোকানদার মো. আমিনুল ও ইখলাস উদ্দিন এবং ভাসমান পণ্য বিক্রেতা মো. মেহেদীর সঙ্গে কথা হয় নিউজবাংলার। পুরো ঘটনা তারা দেখেছেন।
তারা জানান, ভোরে ঢাকামুখী ১ নম্বর প্ল্যাটফর্মে ট্রেনের জন্য দাঁড়িয়ে ছিলেন ওই দুই যুবক ও তরুণী। হঠাৎ পাশ দিয়ে যাওয়া এক বৃদ্ধ তরুণীকে দেখে বলে ওঠেন, ‘আপনার বাড়ি কই? কাল রাতেও এখানে এসেছেন। আজকেও আসছেন। এসব পোশাক পরে কেউ স্টেশনে আসে নাকি?’
মেয়েটির সঙ্গে থাকা হলুদ রঙের টি-শার্ট পরা তরুণ ওই বৃদ্ধকে তখন বলেন, ‘আপনি এসব কেন জিজ্ঞেস করছেন? আপনি এভাবে প্রশ্ন করতে পারেন না।’
এ নিয়ে বৃদ্ধের সঙ্গে ওই যুবকের বাগ্বিতণ্ডার মধ্যে আরেক নারী এসে মেয়েটির পোশাক নিয়ে কটাক্ষ ও গালমন্দ করতে থাকেন। ততক্ষণে চারপাশে কিছু লোক জড়ো হয়।
ওই বৃদ্ধ ও নারীর সঙ্গে আরও কয়েকজন যোগ হয়ে তরুণী ও যুবককে গালমন্দ করতে থাকেন। ওই যুবকও তাদের সঙ্গে তর্কে জড়িয়ে যান। একপর্যায়ে আরেক ব্যক্তি যুবককে ধাক্কা দেন। মেয়েটি তখন যুবককে নিয়ে সরে যেতে চেষ্টা করলে ওই নারী মেয়েটিকে টানাহেঁচড়া করতে থাকেন।
তরুণী ও সঙ্গে থাকা দুই যুবক সরে গিয়ে স্টেশন মাস্টারের কক্ষে আশ্রয় নেন।
প্রত্যক্ষদর্শী দুই দোকানদার আরও জানান, তখনই ঢাকাগামী চট্টগ্রাম মেইল ট্রেন চলে আসায় ওই তরুণী ও সঙ্গে থাকা প্রতিবাদকারী যুবক তাতে উঠে চলে যান। সব মিলিয়ে পুরো ঘটনাটি মিনিট দশেকের।
ভাসমান দোকানদার মেহেদী নিউজবাংলাকে জানান, ঘটনার সূত্রপাত এক নারীর কটাক্ষের জেরে।
তিনি জানান, ওই যুবক ও তরুণীকে গত মঙ্গলবার রাতে ঢাকার ট্রেনে করে নরসিংদী নামতে দেখেছেন। বুধবার ভোরে তারা আবার ঢাকা যাওয়ার ট্রেনের অপেক্ষায় ছিলেন। সে সময় এক নারী মেয়েটির পোশাক নিয়ে প্রথম মন্তব্য করেন।
মেহেদী বলেন, ‘ওই নারী মেয়েটাকে বলতে থাকে যে, এসব পোশাক পরে কেন ঘোরাঘুরি করছে, তার বাড়ি কই। ওই নারী মেয়েটার ভিডিও করতে নেয়। তখন মেয়েটার সঙ্গে থাকা একটা ছেলে প্রতিবাদ করতে থাকে।
‘সে সময় কালো শার্ট পরা একটা লোক ওই ছেলেকে ধাক্কা দেয়। মেয়েটা তখন মোবাইল বের করে কাউকে কল করতে থাকে। এসবের মধ্যে ওই নারী মেয়েটার দিকে তেড়ে যায়।’
ঘটনার সময় স্টেশন মাস্টারের দায়িত্বে ছিলেন নাইয়ুম মিয়া।
তিনি বলেন, ‘ভোরে আমি কন্ট্রোল রুমে বসে ছিলাম। সিলেটগামী উপবন এক্সপ্রেসকে সিগন্যাল দিচ্ছিলাম। তখন দেখি বাইরে কিছু লোক জড়ো হয়ে আছে।
‘আমি গেটের সামনে আসতেই বাঁচাও বাঁচাও করে আধুনিক পোশাক পরা এক তরুণী ও আরেক তরুণ আমার কক্ষে আসে। তাদের কাউকে ফোন দিতে দেখলাম। অল্প সময়ের মধ্যে স্টেশন ও থানা পুলিশ এসে হাজির।’
তিনি আরও বলেন, “তখন মেয়েটি বলছিল, ‘আমি এসব পোশাক পরাতে এদের সমস্যা কী? তারা আমাদের হেনস্তা করছে। বাংলাদেশের সবাই শাড়ি পরে বেড়াবে নাকি?” পুলিশ তাদের সঙ্গে কথা বলে। আমি চট্টগ্রাম থেকে ছেড়ে আসা মেইল ট্রেন থামানোর জন্য সিগন্যাল দিতে ব্যস্ত হয়ে যাই।’
প্রশাসনের তৎপরতা
ঘটনা ১৮ তারিখ ভোরে ঘটে, সে সময় মডেল থানা পুলিশের এক এএসআই সেখানে গিয়ে পরিস্থিতি সামলে নেন। তবে হেনস্তাকারীদের কাউকেই সে সময় আটক করা হয়নি।
এএসআই ইকবাল হোসেন পরে জানান, তিনি কারও নাম-পরিচয়ও নেননি। রেলস্টেশন কর্তৃপক্ষও সে সময় হেনস্তাকারীদের আটক করেনি, কোনো তথ্যও রাখেনি। যদিও একাধিক প্রত্যক্ষদর্শী নিউজবাংলাকে জানান, এএসআইকে তারা হেনস্তার শিকার তরুণী-তরুণ ও হেনস্তাকারীদের নাম-ফোন নম্বর টুকে রাখতে দেখেছেন।
ঘটনার পরদিন হেনস্তার ঘটনার মোবাইল ফোনে ধারণ করা ভিডিও ফেসবুকে ভাইরাল হয়। নিউজবাংলাসহ বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে সে খবর প্রকাশিত হয়। তারও এক দিন পর পুলিশ ও রেলস্টেশন কর্তৃপক্ষ ঘটনাটিকে গুরুত্ব দেয় ও হেনস্তাকারীদের খুঁজতে তৎপর হয়।
তারা জানায়, ঘটনায় জড়িতদের কাউকেই শনাক্ত করা যাচ্ছে না।
পরে ২০ মে রাতে হেনস্তাকারী সন্দেহে একজনকে আটক করে ডিবি পুলিশ। পরদিন ভৈরব রেলওয়ে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) ফেরদৌস আহমেদ বিশ্বাস জানান, আটক ব্যক্তির নাম ইসমাইল হোসেন। তার বাড়ি নরসিংদী সদরের নজরপুর ইউনিয়নের বুদিয়ামাড়া গ্রামে। তিনি একজন রাজমিস্ত্রি।
সেদিনই আদালতের মাধ্যমে তাকে কারাগারে পাঠানো হয়।
রেলওয়ে থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) ফেরদাউস আহমেদ বিশ্বাস নিউজবাংলাকে জানান, এ ঘটনায় পুলিশ বাদী হয়ে ২১ মে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনের ১০ ও ৩০ ধারা এবং দণ্ডবিধির ১৪৩, ৩২৩ ও ৫০৬ ধারায় মামলা করে। তাতে ইসমাইলকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়।