নোয়াখালীর দ্বীপ উপজেলা হাতিয়া থেকে জলপথে প্রায় সাত লাখ মানুষের চলাচল দুই বছর ধরে ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে আছে। নিরাপদে চলাচলের জন্য দুটি সি-ট্রাক থাকলেও যান্ত্রিক ত্রুটির কারণ দেখিয়ে সেগুলো বন্ধ রাখা হয়েছে দুই বছর ধরে। এই সুযোগে সাবেক এক সংসদ সদস্যের মাছ ধরার নৌকা ও স্পিডবোটে বাড়তি ভাড়ায় নদী পারাপারে বাধ্য করার অভিযোগ পাওয়া গেছে।
স্থানীয় বাসিন্দা, আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মী এমনকি সরকারি সংস্থা বিআইডব্লিউটিসি ও স্থানীয় প্রশাসনও একই সুরে কথা বললেও সব অভিযোগ অবশ্য বেমালুম অস্বীকার করেছেন সাবেক সংসদ সদস্য মোহাম্মদ আলী।
মোহাম্মদ আলী নৌকা না পেয়ে হাতিয়া থেকে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন ২০০১ সালে। ২০০৮ সালে তাকে নৌকা দেয়া হলেও খেলাপি ঋণের কারণে প্রার্থিতা বাতিল হয়ে যায়। পরের দুই বার ২০১৪ ও ২০১৮ সালে আওয়ামী লীগ মনোনয়ন দেয় তার স্ত্রী আয়েশা ফেরদৌসকে।
নোয়াখালী-হাতিয়ার মধ্যে চেয়ারম্যান ঘাট-নলচিরা রুটের সি-ট্রাক শেখ ফজলুল হক মণি আর শহীদ আবদুর রব সেরনিয়াবাত নামের সি-ট্রাকটি চেয়ারম্যান ঘাট- চরচেঙ্গা-তমরুদ্দি রুটে চলত। দুই বছর ধরে সেগুলো বন্ধ রয়েছে।
ইজারাদারের ভাষ্য, মেরামত করা হলেও আবার নষ্ট হয়ে পড়ে। তাই সি-ট্রাক চলাচল বন্ধ আছে। স্থানীয়দের অভিযোগ সি-ট্রাক বিকল থাকার সুযোগে মোহাম্মদ আলীর ইঞ্জিনচালিত মাছ ধরার ট্রলার ও স্পিডবোটে সি-ট্রাকের চেয়ে কয়েকগুণ বেশি ভাড়া দিয়ে নদী পার হতে হয়।
কী বলছেন যাত্রীরা
যাত্রীদের অভিযোগ, সি-ট্রাকটি ইচ্ছা করে মেরামত না করে তাদের বেশি টাকা দিতে বাধ্য করা হচ্ছে। মানববন্ধনসহ নানা কর্মসূচিতে নিরাপদ যাতায়াতে নৌপথে সি-ট্রাক চালুর দাবি তুলেছে হাতিয়ার বিভিন্ন সংগঠন।
হাতিয়ার সোনাদিয়া ইউনিয়নের বাসিন্দা সাইফুল্লাহ মনির বলেন, ‘উনার (মোহাম্মদ আলী) প্রয়োজন হলে সি-ট্রাক ভালো হয়ে যায়, আর মানুষের প্রয়োজন হলে বন্ধ হয়ে যায়। সি-ট্রাকের জনপ্রতি ভাড়া ১০০ টাকা হলেও ইঞ্জিনচালিত ট্রলারে ২০০ টাকা ও স্পিডবোটে চার থেকে পাঁচ শ টাকা দিতে হয়।’
চট্টগ্রামে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের চাকরিজীবী চর ঈশ্বরের বাসিন্দা আশরাফ উদ্দিন বলেন, ‘সি-ট্রাকের ইজারাদার গোলাম মাওলা কাজল সাবেক এমপি মোহাম্মদ আলীর ব্যাবসায়িক পার্টনার। তিনিই ঘাট নিয়ন্ত্রণ করেন। গত দুই বছরে কোনো ঈদে সি-ট্রাক চলাচল করে নাই। তারা সি-ট্রাক বন্ধ রেখে তাদের মাছ ধরার বোটে দুই শ ও স্পিডবোটে পাঁচ শ টাকায় মেঘনা নদী পাড়ি দিতে বাধ্য করেন। অথচ সি-ট্রাকে অনেক কম ভাড়ায় নিরাপদে পার হওয়া যায়।’
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক হাতিয়ার সাবেক এক ইউপি সদস্য বলেন, 'হাতিয়ার মানুষ জীবনের ঝুঁকি নিয়ে নদী পার হয়। এখানে এমপির স্বামী মোহাম্মদ আলীর একচেটিয়া দাপট। উনি যা বলেন তাই হয়।'
মাহমুদুল হাসান ফরহাদ নামের এক ব্যবসায়ী বলেন, 'আমরা নিরাপদ নৌ পারাপারের জন্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমসহ বিভিন্ন স্থানে মানববন্ধন করে সরকারের কাছে দাবি তুলে ধরেছি।'
আওয়ামী লীগের নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন নেতা বলেন, ‘ইজারাদার কাজল তার (মোহাম্মদ আলী) লোক হওয়ায় বিভিন্ন বাহানায় সি-ট্রাক বন্ধ রেখে ট্রলার ও কয়েকটি স্পিডবোটে গাদাগাদি করে নদী পারাপারে বাধ্য করে। তারা বিআইডব্লিউটিসিতে তদবির করে পুরনো সি-ট্রাকটি বন্ধ রেখে বিভিন্ন কারণ দেখিয়ে নতুন সি-ট্রাক যেন চলতে না পারে তার পাঁয়তারা করছে।’
ইজারাদারের ভাষ্য
ইজারাদার গোলাম মাওলা কাজল বলেন, ‘সি-ট্রাকটির বয়স হয়েছে ১৫ বছর। এটার ইঞ্জিন প্রায়ই নষ্ট হয়। তাই ঠিক করতে সময় লাগে। আগামী ৫ থেকে ৭ দিনের মধ্যে চালু হবে। নতুন সি-ট্রাকটি ভাসানচরের জন্য ঠিক করা হয়েছে। হাতিয়া রুট চার্টার আমাকে দেয়া আছে এটি এখানে কীভাবে চালাবে? আমি তো রুট ভাড়া দেই।’
সব অভিযোগের অস্বীকার মোহাম্মদ আলীর
আওয়ামী লীগ নেতা বলেন, ‘আমার কোনো ট্রলার ও স্পিডবোট নাই, আমার কোনো ইজারা নাই, ঘাটের সঙ্গে আমার বা আমার পরিবারের কোনো সম্পৃক্ততা নাই।
‘আমাদের ভিন্ন ব্যবসা আছে। আমাদের মাছের ব্যবসা আছে, মাছের ট্রলার আছে, নৌকা আছে, কনস্ট্রাকশনের ব্যবসা আছে। এটা দিয়ে কোনোভাবে আমরা চলি।’
সি-ট্রাক কেন চলছে না- এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘সি-ট্রাকের তলা ছিদ্র হয়ে গেছে। মেশিনগুলো পুরোনো। গত ২৫ বছর সরকারের কোনো নতুন সি-ট্রাক নাই। সি-ট্রাক যদি চলত, তাহলে প্যাসেঞ্জার আরও ডবল হতো। মানুষ জানে সি-ট্রাক নাই, তাই ঢাকা-চট্টগ্রাম থেকে জাহাজে চলে আসে। সি-ট্রাক চললে বরং ইজারাদার আরও বেশি টাকা পেত।’
কী বলছেন সংসদ সদস্য
মোহাম্মদ আলীর স্ত্রী ও নোয়াখালী-৬ (হাতিয়া) আসনের সংসদ সদস্য আয়েশা ফেরদৌস সি-ট্রাকসংক্রান্ত অভিযোগের বিষয়ে বলেন, ‘অনেকেই অনেক মন্তব্য করছেন। ব্যাপারটা আসলে সেটা নয়। যিনি এটার ইজারা নিয়েছেন তিনি নিজের খরচে ঠিক করতেছেন। আমি ও আমার স্বামী মোহাম্মদ আলী সাহেব বারবার তাগাদা দিচ্ছি।
‘সি-ট্রাক এখনো ডকে আছে। এক সপ্তাহ পরে আবার চলবে। শুধু ইজারাদার কেন, হাতিয়া ছোট একটি দ্বীপ, সবাই তো আমাদের লোক।’
সি-ট্রাক বন্ধের সুবিধাভোগী তো আপনারা- এই প্রশ্নে আয়েশা বলেন, ‘শুধু আমাদের না, ট্রলার স্পিডবোট সবার আছে। যেহেতু আমি এখানকার প্রতিনিধি, তাই একটা পক্ষ আমার ওপর দোষ চাপানোর চেষ্টা করছে।
‘অনেকেই না জেনে বাহির থেকে কথা বলে। আমাদের ইশিতা-১. ২. ৩ নামের তিনটি ফিশিং ট্রলার আছে, কোনো যাত্রীবাহী ট্রলার নেই। সি-ট্রাক বন্ধ থাকলে মানুষ নদী পার হতে হলে ট্রলার বা স্পিডবোট ছাড়াতো উপায় নাই।’
প্রশাসনের বক্তব্যে স্থানীয়দের অভিযোগের প্রমাণ
বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন করপোরেশনের (বিআইডব্লিউটিসি) পরিচালক (বাণিজ্য) এস এম আশিকুজ্জামান যা বলেছেন, তাতে স্থানীয়দের অভিযোগের সত্যতা উঠে আসে।
নিউজবাংলাকে তিনি বলেন, ‘শেখ ফজলুল হক মনি নামে সি-ট্রাকটি হাতিয়ার এমপি সাহেবের লোকজন ভাড়া নিয়েছেন। যেটা প্রবলেম, সেটা সাংবাদিক হিসেবে আপনারা ভালো জানেন। ওই জাহাজটার রিপেয়ারসহ সব দায়িত্ব ওনাদের দেয়া আছে। তারা এত দিন ধরে বলতেছে, জাহাজ নষ্ট রিপেয়ার করবে, কিন্তু করে নাই।
‘এখন আমরা যখন প্রেশার দিয়েছি, তারা রিপেয়ার শুরু করেছে। আগামী এক সপ্তাহের মধ্যে রিপেয়ার শেষে সি-ট্রাকটি চলাচল শুরু হবে আশা করি।’
নতুন সি-ট্রাক চালু প্রসঙ্গে তিনি বলেন, ‘ভাষাসৈনিক জব্বার নামের নতুন সি-ট্রাক বিআইডব্লিউটিসির ব্যবস্থাপনায় আগামী এক সপ্তাহের মধ্যে চালু হবে। কিছু লোকবল নিয়োগ দিতে হবে। তা দুয়েক দিনের মধ্যে শেষ করা হবে। কোনো অজুহাত দেখিয়ে যেন সি-ট্রাক চলাচল বন্ধ করতে না পারে, সে জন্যই সরকারি ব্যবস্থাপনায় চলবে।’
নোয়াখালীর জেলা প্রশাসক দেওয়ান মাহবুবুর রহমান বলেন, ‘এ বিষয় নিয়ে গত সপ্তাহে ঘাটের ইজারাদারসহ একটি সভা হয়েছে। ভাসানচর ও হাতিয়ায় চলাচলের সময় নির্ধারণ করে দেয়া হয়েছে। আমি চট্টগ্রামে বিআইডব্লিউটিসিতে কথা বলেছি। জনবলসহ অতিদ্রুত সি-ট্রাক চলাচলের ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে।’