আওয়ামী লীগের অনেক প্রভাবশালী নেতাই বিভিন্ন সময়ে দল থেকে বেরিয়ে গিয়ে নতুন দল প্রতিষ্ঠা করেছেন। এদের কেউ দলের শীর্ষ নেতৃত্বের প্রতি আনুগত্য হারানোর কারণে আবার কেউ রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষ থেকে ভিন্ন পথে হাঁটা দিয়েছেন।
এমন নেতাদের মধ্যে সবার আগে নাম আসে প্রয়াত মিজানুর রহমান চৌধুরীর। তার ধারাবাহিকতায় আছেন ড. কামাল হোসেন, কাদের সিদ্দিকী, মোস্তফা মোহসিন মন্টু প্রমুখ। তবে প্রয়াত নেতা আব্দুর রাজ্জাক দল থেকে বেরিয়ে গেলেও পরে আবার ফিরে এসেছিলেন।
মিজানুর রহমান চৌধুরী
বঙ্গবন্ধুর হত্যা-পরবর্তী সময়ে আওয়ামী লীগ যে ভাঙ্গা-গড়ার মধ্য দিয়ে যায়, তার শুরুটা হয়েছিল মিজানুর রহমান চৌধুরীর হাত ধরে। তিনি আওয়ামী লীগের একটি নিজস্ব গ্রুপ তৈরি করেন, যা আওয়ামী লীগ (মিজান) নামে পরিচিত হয়েছিল।
পরে ১৯৮৪ সালে আওয়ামী লীগ ছেড়ে তিনি সামরিক শাসক হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের জাতীয় পার্টিতে যোগ দিয়ে তার মন্ত্রীও বনে যান। ২০০১ সালে পুনরায় তিনি আওয়ামী লীগে যোগদান করেন এবং মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত দলের উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ২০০৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ঢাকায় তার মৃত্যু হয়।
ড. কামাল হোসেন
১৯৯৩ সালে আওয়ামী লীগ থেকে বেরিয়ে গণফোরাম গঠন করেন ড. কামাল হোসেন। তিনি এখনও দলটির সভাপতি। আওয়ামী লীগের সঙ্গে তার সম্পর্ক ছিল প্রায় শুরু থেকেই।
১৯৭০ সালে পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদ নির্বাচনে পূর্ব পাকিস্তান থেকে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে জয়ী হন ড. কামাল। ১৯৭২ সালে আইনমন্ত্রী এবং ১৯৭৩ থেকে ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। পরে আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য হন, কিন্তু শীর্ষ নেতৃত্বের সঙ্গে দূরত্বের জেরে আওয়ামী লীগ ছেড়ে যান তিনি।
ড. কামাল হোসেন আনুষ্ঠানিকভাবে ১৯৯৩ সালে আওয়ামী লীগ ছাড়লেও তিনি কার্যত দলে ছিলেন না ১৯৯১ সালের নির্বাচনের পর থেকেই। সে নির্বাচনে আওয়ামী লীগ হেরে যাওয়ার পর দলটির সভাপতি শেখ হাসিনা নির্বাচনে ‘সূক্ষ্ম কারচুপির’ অভিযোগ তোলেন, কিন্তু দলের তৎকালীন সভাপতিমণ্ডলীর অন্যতম সদস্য হয়েও দলীয় প্রধানের বিরোধিতা করে বক্তব্য দেন ড. কামাল হোসেন।
তিনি বিবিসিকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘নির্বাচন সুষ্ঠু হয়েছে।’ এমনকি শেখ হাসিনার কাছে দেয়া চিঠিতে ড. কামাল নির্বাচনে পরাজয়ের পেছনে দলীয় কোন্দল ও অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাসকে দায়ী করেন।
একই সময় যুবলীগের তৎকালীন চেয়ারম্যান মোস্তফা মহসিন মন্টুকে বহিষ্কার করা নিয়েও তিনি ‘নোট অব ডিসেন্ট’ দেন। এরপরই দলীয় প্রধানের সঙ্গে তার দূরত্ব তৈরি হয়।
প্রয়াত ইমেরিটাস অধ্যাপক আনিসুজ্জামান তার আত্মজীবনী ‘বিপুলা পৃথিবী’ বইতে উল্লেখ করেন, সে সময় ড. কামাল হোসেনের বিরুদ্ধে সমালোচনামুখর হয়ে ওঠেন আওয়ামী লীগের অন্য নেতারা।
বিবিসির একটি প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ১৯৯২ সালে আওয়ামী লীগের বর্ধিত সভাকে কেন্দ্র করে আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা দলের ভেতর ষড়যন্ত্রকারীদের সম্পর্কে সজাগ থাকার জন্য জেলার সভাপতি এবং সাধারণ সম্পাদকদের চিঠি দেন।
সে বছরের মার্চে অনুষ্ঠিত দলের বর্ধিত সভায় ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়েন ড. কামাল হোসেন। পরে জুনে ড. কামাল হোসেন ‘গণতান্ত্রিক ফোরাম’ নামের একটি সামাজিক সংগঠন গড়ে তোলেন।
১৯৯২ সালের ১৯ এবং ২০ সেপ্টেম্বর আওয়ামী লীগের কাউন্সিল হয়। সে কাউন্সিলে দলের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্যপদ হারিয়ে উপদেষ্টা পরিষদে স্থান পান ড. কামাল হোসেন।
আওয়ামী লীগের তৎকালীন আরেক সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য এবং বিরোধীদলীয় উপনেতা আব্দুস সামাদ আজাদ ভোরের কাগজ পত্রিকাকে দেয়া সাক্ষাৎকারে অভিযোগ করেন, সম্মেলনের সময় ড. কামাল বিদেশে চলে গিয়েছিলেন। তা ছাড়া ড. কামালের গণতান্ত্রিক ফোরাম গঠন নিয়েও প্রশ্ন তোলেন তিনি।
এদিকে সম্মেলনের পর ড. কামাল হোসেন ‘ভয়েস অব আমেরিকা’কে দেয়া সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘নেতৃত্ব নির্বাচনের বিষয়টি গণতন্ত্রায়ণের মাধ্যমে হলে ভালো হতো।’
প্রায় কাছাকাছি সময় ঢাকার মিরপুরে একটি সংসদীয় আসনের উপনির্বাচনের ডামাডোল শুরু হয়। ১৯৯১ সালের নির্বাচনে পরাজিত ড. কামাল আশা করেছিলেন, দল উপনির্বাচনে তাকেই মনোনয়ন দেবে, কিন্তু শেষ পর্যন্ত মনোনয়ন পান কামাল আহমেদ মজুমদার।
এরপর ১৯৯৩ সালের আগস্টে আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার কাছে পদত্যাগপত্র পাঠিয়ে ড. কামাল হোসেন ২৯ আগস্ট রাজনৈতিক দল গণফোরাম গঠন করেন।
এসব বিষয়ে বর্ষীয়ান এ রাজনীতিকের বক্তব্য জানার জন্য তাকে কয়েক দফা ফোন করা হলেও সেগুলো রিসিভ হয়নি। এসএমএস দিয়েও তার উত্তর পাওয়া যায়নি।
কাদের সিদ্দিকী
নিজের প্রতিষ্ঠিত দল কৃষক শ্রমিক জনতা লীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি তিনি। ‘বঙ্গবীর’ হিসেবেই সমধিক পরিচিত। আওয়ামী লীগে রাজনৈতিক ক্যারিয়ার অল্প দিনের হলেও দলটির নেতা হিসেবে ছিলেন প্রভাবশালী। মুক্তিযুদ্ধে একমাত্র বেসামরিক ব্যক্তি যিনি ‘বীর-উত্তম’ খেতাবপ্রাপ্ত। মুক্তিযুদ্ধে তার যেমন অভাবনীয় ভূমিকা ছিল, তেমনি বঙ্গবন্ধু হত্যার পর সাহসী, প্রকাশ্য এবং সশস্ত্র প্রতিবাদটাও তিনিই করেছিলেন।
মুক্তিযুদ্ধে কাদের সিদ্দিকী গড়ে তুলেছিলেন কাদেরিয়া বাহিনী। পরে সেই বাহিনীর সদস্যদের নিয়ে বঙ্গবন্ধু হত্যার পর প্রতিবাদ করতে গিয়ে শেরপুর-ময়মনসিংহ অঞ্চলের পাহাড়ে চলে যেতে বাধ্য হন। একপর্যায়ে ভারতে চলে যান। ১৯৯০ সালে দেশে ফিরলে আওয়ামী লীগের ১ নম্বর কার্যনির্বাহী সংসদের সদস্য হন।
১৯৯৬ সালের নির্বাচনে ২১ বছর পর আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসে। কাদের সিদ্দিকী সংসদ সদস্য হন। কিন্তু এর দুই বছরের মাথায় সংসদ থেকে পদত্যাগ করেন তিনি। ছাড়েন আওয়ামী লীগও।
নিউজবাংলার পক্ষ থেকে কাদের সিদ্দিকীর সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, “বঙ্গবন্ধুর আদর্শ ধারণ করি, লালন করি, তার আদর্শে জীবনযাপন করি। যে দলই করি, ‘পিতা পিতাই’। তার আদর্শেই রাজনীতি করি। সেই দর্শন থেকেই আওয়ামী লীগ ছেড়েছিলাম।’’
মোস্তফা মহসিন মন্টু
একসময়ে রাজধানীতে আওয়ামী লীগের দাপুটে নেতা ছিলেন তিনি। বর্তমানে গণফোরামের সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। এর আগে একই দলের সাধারণ সম্পাদকও ছিলেন।
রাজনীতিতে মোস্তফা মহসিন মন্টুর হাতেখড়ি হয় ছাত্রলীগ দিয়ে। একসময় তার নামে ছাত্রলীগের একটি গ্রুপ ছিল। পরে যুবলীগ ও ঢাকা জেলা আওয়ামী লীগেরও শীর্ষ পদে ছিলেন।
১৯৯২ সালে মোস্তফা মহসিন মন্টু আওয়ামী লীগের সহযোগী সংগঠন যুবলীগের চেয়ারম্যান থাকা অবস্থাতেই বহিষ্কৃত হন। ১৯৯৩ সালে গণফোরাম প্রতিষ্ঠিত হলে সেই দলে যোগ দেন তিনি।
১৯৯১ সালে টিএসসিতে তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেতা বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মিটিং চলাকালে বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে গুলি করে হত্যা করা হয় ছাত্রলীগ নেতা মনিরুজ্জামান বাদলকে। আওয়ামী লীগের দলীয় তদন্তে মোস্তফা মহসিন মন্টু চিহ্নিত হন বাদল হত্যার মূল হোতা হিসেবে। এ কারণে আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা মন্টুকে বহিষ্কারের সিদ্ধান্ত নেন।
২৯ মিন্টো রোডে বিরোধীদলীয় নেত্রীর বাসভবনে দলের কার্যনির্বাহী সংসদের বৈঠকে মোস্তফা মহসিন মন্টুকে বহিষ্কার করা হয়। এ বহিষ্কারকে কেন্দ্র করে ঘটে নাটকীয় ঘটনা।
দলের তৎকালীন সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য তোফায়েল আহমেদ এবং ড. কামাল হোসেন এ সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করেন। এমনকি ড. কামাল মন্টুর পক্ষ নিয়ে বক্তব্য দেন। তার সে বক্তব্য খণ্ডন করে মতিয়া চৌধুরী সন্ত্রাসের বিপক্ষে এবং শেখ হাসিনার অবস্থানের পক্ষে জোরালো বক্তব্য দেন।
বৈঠকে উপস্থিত আওয়ামী লীগের অন্য নেতাদের ভাষ্য অনুযায়ী, মতিয়া চৌধুরীর বক্তব্যের উত্তর দিতে ব্যর্থ হয়ে ড. কামাল তখন ইংরেজিতে ‘স্ল্যাং’ (গালি) ব্যবহার করেন। এর প্রতিবাদ করেছিলেন আওয়ামী লীগের তৎকালীন যুগ্ম সম্পাদক (পরবর্তী সময়ে সাধারণ সম্পাদক) আব্দুল জলিল।
বহিষ্কারের পর মোস্তফা মহসিন মন্টু ঢাকা জেলা আওয়ামী লীগের একটি অংশের সম্মেলনের আয়োজন করলেও আওয়ামী লীগ ছাড়তে বাধ্য হন।
আওয়ামী লীগ থেকে বহিষ্কারের বিষয়ে নিউজবাংলার পক্ষ থেকে তার কাছে ফোনে জানতে চাওয়া হয়। মন্টু এ বিষয়ে বলেন, ‘অনেক দিন আগের ঘটনা তেমন মনে নেই। তখন সময়ের পরিপ্রেক্ষিতে অনেক ঘটনাই ঘটেছিল। আমার বিরুদ্ধে অন্যায় অভিযোগ তোলা হয়েছিল। লাভ-ক্ষতি কার হয়েছে সেটা সময় বিচার করবে, তবে আমি আজন্ম রাজনীতি করতে চেয়েছি, করছিও।’
এ ছাড়া প্রয়াত আওয়ামী লীগ নেতা আব্দুর রাজ্জাক দল থেকে বেরিয়ে বাকশাল পুনরুজ্জীবিত করলেও পরে ’৯২ সালে আওয়ামী লীগে ফিরে আসেন। পরবর্তী সময়ে তিনি আওয়ামী লীগ সরকারের মন্ত্রী এবং অন্যতম প্রভাবশালী নেতা হন।