পাহাড় থেকে দল বেঁধে নেমে আসে হাতি। গুঁড়িয়ে দেয় মানুষের ঘর-বাড়ি, নষ্ট করে ফসলি জমি। এমনকি হাতির আক্রমণে মানুষের মৃত্যুও ঘটে।
ক্ষতি থেকে বাঁচতে হাতির এমন উন্মত্ত পালকে সংঘবদ্ধ হয়ে, ভয় দেখিয়ে তাড়া করে মানুষও। তাড়া খেয়ে পালিয়ে যায় হাতিরা। মাঝেমধ্যে ঘটে তাদেরও প্রাণহানি।
শেরপুরের সীমান্তবর্তী গারো পাহাড় এলাকায় হাতি-মানুষের এমন দ্বন্দ্ব বহু বছর ধরেই চলছে। ভারতসংলগ্ন শেরপুর জেলার শ্রীবরদী, ঝিনাইগাতী ও নালিতাবাড়ী উপজেলার সীমান্তজুড়ে এই গারো পাহাড় অঞ্চল। এখানে ভারত থেকে নেমে আসা বন্য হাতিরা প্রায়ই বিচরণ করে।
বর্তমানে হাতির একাধিক দল ওই পাহাড়ি এলাকায় স্থায়ীভাবেই অবস্থান নিয়েছে। খাদ্যের সন্ধানে তারা ঘন ঘন নেমে আসছে লোকালয়ে। ক্ষিপ্ত হাতিদের তাড়াতে হিমশিম খাচ্ছে মানুষ। বর্তমানে আতঙ্কে দিন কাটছে সীমান্তবাসীর।
এমন ভীতিকর পরিস্থিতির জন্য হাতির খাদ্য সংকটকেই দায়ী করছেন বিশেষজ্ঞরা। এ ক্ষেত্রে পাহাড়ে ফলদ ও পরিবেশ সহায়ক বনজ বৃক্ষ নিধন এবং হাতির খাদ্য হিসেবে চিহ্নিত গাছপালা রোপণ না করে ক্ষতিকর আকাশমণি ও ইউক্যালিপটাসগাছ লাগানোকেই সবচেয়ে বেশি দায় দিচ্ছেন তারা। খাদ্য না পেয়েই জীবন বাঁচাতে লোকালয়ে চলে আসছে হাতির দল। মানুষ তাদের তাড়াতে ব্যস্ত হয়ে পড়ছে। এতে হাতিও ক্ষিপ্ত হচ্ছে। ক্ষিপ্ত হাতির আক্রমণে মারা পড়ছে মানুষ। এর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে মারা পড়ছে হাতিও।
পাহাড়ের নিচে আগুন জ্বালিয়ে হাতির পালকে ভয় দেখাচ্ছে গ্রামের মানুষ
সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য না থাকলেও বন বিভাগের একাধিক কর্মকর্তা এবং স্থানীয় মানুষজন দাবি করেছে, হাতি তাড়াতে গিয়ে এখন পর্যন্ত অন্তত শতাধিক মানুষের মৃত্যু ছাড়াও আহত হয়েছে সহস্রাধিক। এসব ঘটনায় অর্ধশতাধিক হাতিও মারা পড়েছে। হাতি-মানুষের এই দ্বন্দ্বের নিরসন চায় এখন সীমান্তবাসী।
সীমান্তবর্তী রাংটিয়া গ্রামের আলম হোসেন বলেন, ‘পাহাড়ে হাতি আইলে আমরা ঘুমাইতেও পারি না। কেমনে ঘুমাই? ঘুমের মধ্যে হাতি চইলা আইলে বাঁচুম কেমনে? হাতি আইলে কামেও যাইতে পারি না। কারণ রাতে হাতি পাহারা দিয়া সারা দিন ঘুমাই।’
ছোট গজনীর কাশেম মিয়া বলেন, ‘পাহাড়ে অনেক দিন ধরেই হাতি আছে। কিন্তু পাহাড় থেকে এরা এখন আমাদের গ্রামে চলে এসেছে। আমি লিচু আর কাঁঠালের বাগান করছি এক একর জমিতে। কিছুদিন পরই পেকে যেত লিচুগুলো। কিন্তু হাতির ভয়ে ভালো করে পাকার আগেই সব লিচু পেড়ে বেচে দিচ্ছি।’
তাওয়াকুচার তোতা মিয়া বলেন, ‘হাতি তো আইতে আইতে আমাদের গ্রামেও চলে আইছে। এইডাই ডর। আমাদের যেন জীবনের ক্ষতি না করে আবার।’
নওকুচি গ্রামের ফজেন মারাক জানান, পাহাড় থেকে নেমে তাদের পাড়ার খুব কাছেই ৩০ থেকে ৪০টি হাতি অবস্থান করছে। এ জন্য গ্রামের সবাই এখন আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছে।
তিনি বলেন, ‘পাহাড়ে এখন আসলে খাবারের অভাব। তাই আমগোর বাড়িঘরে হাতি নাইমা আহে। পাহাড়ে আগে পশুপাখির খাবারের অনেক গাছ আছিল। অহন নাইক্কা। পশুপাখির খাবারের গাছ থাকলে আমাদের ওপর আক্রমণ কম হতো।’
শেরপুরের রাংটিয়া রেঞ্জ কর্মকর্তা মুহাম্মদ মকরুল ইসলাম আকন্দ বলেন, ‘পাহাড়ে হাতির বিচরণ দেখা যাচ্ছে। রাংটিয়া রেঞ্জের তাওয়াকুচা ও গজনী এলাকাগুলো একসময় হাতির রাস্তা ও বিচরণ ভূমি ছিল। তাই সেই রাস্তা ব্যবহার করতে গিয়ে হাতি লোকালয়ে ঢুকে পড়ছে। আমরা সবাইকে নিয়ে চেষ্টা করছি যেন হাতিগুলো লোকালয়ে না আসে। তবে মানুষ-হাতি উভয়কে রক্ষা করতে গিয়ে আমাদের হিমশিম খেতে হচ্ছে।’
হাতি ও মানুষের দ্বন্দ্ব নিরসনের জন্য একটি অভয়ারণ্য তৈরির কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের কাজ চলছে বলেও জানান এই বন কর্মকর্তা।