পাকিস্তান আমলে কুড়িগ্রাম জেলার ৯৮ ভাগ মানুষই ছিল গরিব। স্বাধীনতার পরও প্রায় প্রতি বছরই মঙ্গাপীড়িত হয়ে এক বেলা, আধবেলা খেয়ে না খেয়ে দিন কাটাতে হয়েছে এই জেলার অসংখ্য মানুষকে। তবে নানামুখী প্রচেষ্টা ও উদ্যোগের ফলে এখান থেকে মঙ্গা ঘুচে গেছে দুই দশক আগেই। তবুও দারিদ্র্যের সঙ্গে কুড়িগ্রামবাসীর লড়াই এখনও থামেনি।
ভৌগোলিকভাবে বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলে অবস্থিত সীমান্তবর্তী এবং বৃহৎ নদ-নদী যুক্ত জেলা কুড়িগ্রাম। আয়তন প্রায় ২ হাজার ২৫৫ দশমিক ২৯ বর্গকিলোমিটার আর জনসংখ্যা প্রায় সাড়ে ২৪ লাখ। জেলার ৯ উপজেলার মধ্যে ৭ উপজেলার সঙ্গেই ভারতের তিন রাজ্যের সীমান্ত প্রায় ২৭৮ দশমিক ২৮ কিলোমিটার। এর মধ্যে প্রায় ৩২ কিলোমিটার সীমানাজুড়ে কোনো কাঁটাতারের বেড়া নেই।
জেলা সদরের সঙ্গে ব্রহ্মপুত্র নদ দ্বারা বিচ্ছিন্ন ৬টি ইউনিয়ন নিয়ে রৌমারী এবং ৩টি ইউনিয়ন নিয়ে চর রাজিবপুর উপজেলা গঠিত। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর সর্বশেষ জরিপ অনুযায়ী, চর রাজিবপুরই দেশের সবচেয়ে দরিদ্র উপজেলা। এই উপজেলার প্রায় ৭৯.৮ ভাগ মানুষই হতদরিদ্র। এমনকি কুড়িগ্রামের সবচেয়ে কম দরিদ্র ফুলবাড়ি উপজেলায়ও ৬৯ ভাগ মানুষ হতদরিদ্র জীবন-যাপন করে।
কুড়িগ্রামে গরিব মানুষের এমন ছড়াছড়ির জন্য প্রধানত নদ-নদীর ভাঙন আর কর্মসংস্থানের অভাবকেই দায়ী করা হয়। সারা বছরই নদ-নদীর ভাঙনে গৃহহীন হয় এই জেলার কয়েক হাজার পরিবার।
বছরের বেশির ভাগ সময়ই বেকার থাকতে হয় এখানকার মানুষদের। এর মধ্যে নারী শ্রমিকরা কোনো কাজ পায় না বললেই চলে। কোনো শিল্পপ্রতিষ্ঠান না থাকায় এখানকার প্রায় ৮০ ভাগ মানুষ কৃষিনির্ভর। কিন্তু সারা বছরে তাদের ফসল হয় মাত্র একটি। তাই বছরে বড়জোর ৩ থেকে ৪ মাস তাদের হাতে কাজ থাকে।
অন্যদিকে এই জেলার ওপর দিয়ে প্রবাহিত তিস্তা নদীর ভারত অংশে বাঁধ দেয়ার কারণে বিস্তীর্ণ অঞ্চলে চর পড়েছে। ফলে শুষ্ক মৌসুমে প্রচণ্ড খরা দেখা দেয় সেসব অঞ্চলে। নদীটির নাব্যতা না থাকায় বর্ষা মৌসুমে দেখা দেয় বন্যা। এ ছাড়া প্রচণ্ড শীতল আবহাওয়াসহ বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগ সামলাতে হয় এই জনপদকে।
নিজেদের দারিদ্র্যের জন্য রাজনৈতিকভাবে অবহেলিত থাকাকেও দায়ী করে কুড়িগ্রামবাসী। তবে জেলার একটি মহলের মতে, মাঠপর্যায়ে দুর্নীতির কারণেই সরকারের উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ড সেখানে খুব বেশি ফলপ্রসূ হয় না। অন্যান্য জেলার তুলনায় কুড়িগ্রামে এখনও যোগাযোগ ব্যবস্থা, শিক্ষা, কর্মসংস্থান, অবকাঠামো উন্নয়নে বিনিয়োগ পিছিয়ে থাকায় এর সুফল প্রত্যন্ত জনপদে পৌঁছায় না। ফলে দারিদ্র্য হ্রাস পায় খুবই কম।
বিভিন্ন জরিপ অনুযায়ী, এ জেলার একটি পরিবারের মাসিক গড় আয় বড়জোর ১০ থেকে ১২ হাজার টাকা। বর্তমানে এই আয়ে একটি পরিবারের পর্যাপ্ত খাবার নিশ্চিত করাও সম্ভব হয় না। ফলে স্বাস্থ্য, শিক্ষা ও বস্ত্রের মতো মৌলিক চাহিদার খরচ মেটাতেও হিমশিম খেতে হয় কুড়িগ্রামবাসীকে।
নিজের দুরবস্থার কথা বলতে গিয়ে চর রাজিবপুর উপজেলার মোহনগঞ্জ ইউনিয়নের বাসিন্দা রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘হামার এডে নদীভাঙনে সহায়সম্বল শেষ। এলা দিন আনে দিন খাওয়া নাগে। কামলার দামও নাই। ধান কাটার মৌসুমে আড়াই-তিন শ টাকা পাওয়া যায়। জিনিসের যে দাম, তাতে ৫ জনের সংসার চলে না। চাল-ডাল আনতেই টাকা শেষ।’
একই এলাকার নারী শ্রমিক বুলবুলি আক্তার জানান, একে তো নারী, তার ওপর মিল-কারখানা না থাকায় খুব বেশি কাজের সুযোগ নেই তার। কৃষিকাজের মৌসুমে কদাচিৎ কাজের সুযোগ এলেও দুই-আড়াই শ টাকার বেশি হাজিরা পান না তিনি।
চর রাজিবপুরেরই বিচ্ছিন্ন কোদালকাটি ইউনিয়নের আনছের আলী বলেন, ‘সরকার যে রিলিফ দেয়, সেডা কখন আইসে কারে দেয় আমরা কবার পারি না। সব রিলিফ মেম্বার, চেয়ারম্যানরা ভাগাভাগি কইরা খায়। আমগোর পাকা রাস্তা নাইক্যা। কিছুদিন আগে সরকারে কারেন্ট দিছে, হেইডাও আবার এক দিন থাকলে ছয় দিন থাকে না। তবে নদীভাঙনই এখানে সবচেয়ে বড় সমস্যা।’
তিস্তার পানিতে তলিয়ে যাওয়া চরের ফসল
চররাজিবপুর উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান আকবর হোসেন হিরো বলেন, ‘বিবিএস যে তথ্য দিয়েছে, তা অনেকটাই সত্য। কারণ আমাদের রাজিবপুর উপজেলায় তিনটি নদ রয়েছে। তাই বছরের বেশির ভাগ সময় নদীভাঙন লেগেই থাকে। এতে আমাদের উপজেলাটি ছোট হয়ে যাচ্ছে। এই এলাকার মানুষ তাদের সহায়সম্পদ হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে যাচ্ছে।’
নিজ এলাকার মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনে সরকারের বিশেষ নজরের পাশাপাশি নদীশাসন, পর্যটন এলাকা তৈরি এবং তাঁতশিল্পসহ মিল-কারখানা স্থাপন প্রয়োজন বলে মনে করেন চেয়ারম্যান।
এই উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা অমিত কুমার চক্রবর্তী বলেন, ‘চর রাজিবপুর বাংলাদেশের সবচেয়ে দরিদ্র উপজেলা। ব্রহ্মপুত্র নদ পাড়ি দিয়ে জেলা শহরের সঙ্গে যোগাযোগ করতে নৌকাই এই এলাকার বাসিন্দাদের প্রধান ভরসা।’
বর্তমানে চর রাজিবপুর উপজেলার তিনটি ইউনিয়নের মানুষের ভাগ্যোন্নয়নে শিক্ষা, বাসস্থানসহ সরকারের কয়েকটি উন্নয়ন কর্মকাণ্ড পরিচালিত হচ্ছে বলেও জানান ইউএনও।
জেলা দুর্নীতি প্রতিরোধ কমিটির সাধারণ সম্পাদক হারুন অর রশীদ বলেন, ‘সরকারের বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ড জেলায় পরিচালিত হচ্ছে। এসব প্রকল্প তদারকি কিংবা দুর্নীতি রোধে নজরদারির অভাব রয়েছে। এ ছাড়া রাজনৈতিকভাবেও আমাদের জেলা পিছিয়ে আছে। দারিদ্র্য থেকে উত্তরণের জন্য প্রশাসন, রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গ, জনপ্রতিনিধি, গণমাধ্যমকর্মীসহ সর্বস্তরের মানুষকে সমন্বিতভাবে কাজ করতে হবে।’
জেলার দারিদ্র্যের বিষয়ে চিলমারী, রৌমারী, চররাজিবপুর নিয়ে গঠিত কুড়িগ্রাম-৪ আসনের এমপি ও প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী জাকির হোসেন বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা উন্নয়নের রোল মডেল। আমাদের দেশে পদ্মা সেতু নির্মাণ হয়েছে। সেখানে ব্রহ্মপুত্র নদের ওপর সেতু নির্মাণ অসম্ভব নয়। প্রধানমন্ত্রী কুড়িগ্রামবাসীকে অত্যন্ত ভালোবাসেন। দেশের উন্নয়নে মেগা প্রকল্পে ব্রহ্মপুত্র সেতু প্রকল্পটি অন্তর্ভুক্ত করে বাস্তবায়ন করা গেলে দারিদ্র্য থেকে উত্তরণের পাশাপাশি দেশের অর্থনীতিতেও অগ্রণী ভূমিকা রাখতে পারবে কুড়িগ্রাম।’
কুড়িগ্রামে ইতোমধ্যে স্থলবন্দর, নৌবন্দর, ঢাকার সঙ্গে সরাসরি ট্রেন চলাচল বাস্তবায়ন হয়েছে। এ ছাড়া কুড়িগ্রাম কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল বাস্তবায়ন হলেও এই জেলা থেকে দারিদ্র্য অনেকাংশে কমে যাবে বলেও দাবি করেন প্রতিমন্ত্রী।