রাজধানীর হাতিরঝিলকে মাছের অভয়ারণ্য হিসেবে গড়ে তুলতে ওয়াটার ট্যাক্সি সার্ভিস বন্ধে উচ্চ আদালত পরামর্শ দিলেও তা মানতে নারাজ রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক)। এ নিয়ে তারা আবারও আদালতের দ্বারস্থ হবেন বলে জানিয়েছে।
২০১৬ সালের বিজয় দিবসে হাতিরঝিলে আনুষ্ঠানিকভাবে ওয়াটার ট্যাক্সি চলাচল শুরু হয়। চারটি ওয়াটার ট্যাক্সি নিয়ে যাত্রা শুরু হলেও জনপ্রিয় হওয়ায় এখন চলছে ১৫টি ট্যাক্সি। শৌখিন বিনোদনপিপাসুদের পেরিয়ে এটি এখন জরুরি পরিবহন সেবায় পরিণত হয়েছে।
সকাল সাড়ে ৬টা থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত চলে ওয়াটার ট্যাক্সি। চারটি স্পট থেকে প্রতিদিন ১০ থেকে ১২ হাজার যাত্রী চলাচল করেন। এগুলো হচ্ছে এফডিসি মোড়, পুলিশ প্লাজা, গুদারাঘাট ও রামপুরা।
হাতিরঝিলকে ঘিরে ৩৬টি রেস্টুরেন্ট করা হয়েছে। প্রতিদিন এখানে ঘুরতে আসেন হাজারও মানুষ।
এফডিসি মোড়, পুলিশ প্লাজা, গুদারাঘাট ও রামপুরাসহ চারটি স্পট থেকে ওয়াটার ট্যাক্সিতে প্রতিদিন ১০ থেকে ১২ হাজার যাত্রী চলাচল করেন। ছবি: নিউজবাংলা
ওয়াটার ট্যাক্সির সঙ্গে মাছের কী সম্পর্ক এমন প্রশ্ন তুলছেন যাত্রীরা। তারা ওয়াটার ট্যাক্সির সেবা পেতে আগ্রহী।
সজিব দাশ নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমার অফিস গুলশান-১ নম্বরে। বাসা এফডিসির পাশে। মহাখালী হয়ে গুলশান যেতে অনেক যানজট পোহাতে হয়। আর ওয়াটার ট্যাক্সিতে গুদারাঘাট নেমে দুই মিনিট হাঁটলেই আমার অফিস। এ কারণে ওয়াটার ট্যাক্সিতে সুবিধা হয় আমার।
‘হাতিরঝিল একটা পার্কের মতো। এখানে অনেক মানুষ ঘুরতে আসেন। তারা হাতিরঝিলের পানিতে বর্জ্য ফেলে পরিবেশ নষ্ট করছেন। কিন্তু লেক মাছের অভয়ারণ্য করতে ওয়াটার ট্যাক্সি কেন বন্ধ করতে হবে বুঝলাম না। ওয়াটার ট্যাক্সির সঙ্গে মাছের কী সম্পর্ক? এখানের পচা পানিতে এমনিতেই মাছ নাই।’
এফডিসি মোড়, পুলিশ প্লাজা, গুদারাঘাট ও রামপুরাসহ চারটি স্পট থেকে ছাড়ে ওয়াটার ট্যাক্সি। ছবি: নিউজবাংলা
আরেক যাত্রী মো. হেলাল বলেন, ‘আমার বাসা বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায়। অফিস বসুন্ধরা সিটিতে। অফিস থেকে বাসায় যেতে গাড়িতে যে ভোগান্তিতে পড়তে হয়, সেই ভোগান্তি ওয়াটার ট্যাক্সিতে পোহাতে হয় না। আর ওয়াটার ট্যাক্সিতে অনেক শান্তিতে যাতায়াত করতে পারি। ওয়াটার ট্যাক্সি চললে মাছের কোনো ক্ষতি হয় বলে আমার মনে হচ্ছে না। যদি ময়লা আবর্জনা সঠিক স্থানে ফেলতে পারি, তাহলে মনে হয় না মাছের কোনো ক্ষতি হবে। গাড়ির চেয়ে ওয়াটার ট্যাক্সিই বেস্ট।’
ওয়াটার ট্যাক্সি চলাচলে যদি মাছের ক্ষতি হয় বা ওয়াটার ট্যাক্সি বন্ধে যদি ভালো কিছু হয় তবে হাইকোর্টের আদেশ মানতে রাজি টিচার্স ট্রেনিং কলেজে বিএড পড়ুয়া ছাত্রী সুলতানা রাজিয়া।
তিনি বলেন, ‘কারওয়ান বাজার, বিজয় সরণিতে এত জ্যাম থাকে, এই কারণে ওয়াটার ট্যাক্সিতে যাওয়া-আসা করি। এক ঘণ্টার রাস্তা অনেক সময় আড়াই ঘণ্টা লেগে যায়। ওয়াটার ট্যাক্সিতে সময় বাঁচে। পাশাপাশি আরামদায়ক।
‘যদি ওয়াটার ট্যাক্সি বন্ধ করে জায়গাটা মাছের অভয়ারণ্য করা যায়, যদি ভালো কিছু হয়, সে ক্ষেত্রে হাইকোর্টের সিদ্ধান্ত আমাদের মানতে হবে। আমি দেশের একজন নাগরিক হিসেবে বলব, পরিবেশ সংরক্ষণের জন্য যদি ভালো কিছু হয় তাহলে অবশ্যই আমরা ওয়াটার ট্যাক্সি পরিহার করব।’
হাতিরঝিলে ওয়াটার ট্যাক্সি ও চারটি রেস্টুরেন্ট রাজউকের কাছ থেকে ইজারা নিয়ে পরিচালনা করছে করিম গ্রুপের অঙ্গ প্রতিষ্ঠান ‘হাতিরঝিল হসপিটালিটিস’। ওয়াটার ট্যাক্সি নিয়ে আনুষ্ঠানিক কোনো চিঠি এখনও রাজউক থেকে দেয়া হয়নি বলে জানান এটির মহাব্যবস্থাপক ড্যারিল ফ্রেসার।
নিউজবাংলাকে তিনি বলেন, ‘করিম গ্রুপ রাজউকের কাছ থেকে ওয়াটার ট্যাক্সি ও চারটি রেস্টুরেন্ট ইজারা নিয়েছে। রাজউক ওয়াটার ট্যাক্সি বন্ধের বিষয়ে অফিশিয়ালি আমাদের কিছু জানায় নাই। বুধবার আমাদের শুধু বলেছে, হাইকোর্টের আদেশ ও পরামর্শের বিষয়ে কেউ কিছু জিজ্ঞাসা করলে তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে। আমাদের রেস্টুরেন্টে এসে বলে গেছেন বিষয়টা। রেস্টুরেন্ট থেকে আমাদের জানিয়েছে। এ বিষয়ে আমি কোনো মন্তব্য করতে পারব না। কিছু জানতে হলে রাজউকে যোগাযোগ করেন।’
হাতিরঝিল প্রকল্পের প্রধান প্রকৌশলী রায়হানুল ফেরদৌসের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানান, তারা এ বিষয়ে উচ্চ আদালতে যাবেন।
নিউজবাংলাকে তিনি বলেন, ‘হাইকোর্টের রায়ের বিপক্ষে রাজউক আপিল করবে। খুব শিগগিরই এই আপিল করা হবে। আপিল শুনানি শেষে যে রায় আসবে তার ওপর নির্ভর করে পরবর্তী পদক্ষেপ নেয়া হবে।’
উচ্চ আদালতের পরামর্শে যা ছিল
গত বছরের ৩০ জুন হাতিরঝিল নিয়ে একটি রিটের শুনানি শেষে রায় প্রকাশ করে হাইকোর্টের একটি বেঞ্চ। ৫৫ পৃষ্ঠার রায়টি মঙ্গলবার সুপ্রিম কোর্টের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়েছে। বিচারপতি মো. আশরাফুল কামাল ও বিচারপতি রাজিক আল জলিলের হাইকোর্ট বেঞ্চ এ রায় দেয়।
রায়ে হাতিরঝিল এবং বেগুনবাড়ি সম্পূর্ণ প্রকল্পটি সংরক্ষণ, উন্নয়ন এবং পরিচালনায় প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ের সরাসরি অধীনে একটি পৃথক কর্তৃপক্ষ গঠন করতে বলা হয়। এতে আরও বলা হয়, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) প্রকৌশল বিভাগ এবং বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর ২৪তম ইঞ্জিনিয়ারিং কনস্ট্রাকশন ব্রিগেডকে যৌথভাবে হাতিরঝিল প্রকল্প এলাকার স্থায়ী পরামর্শক নিয়োগ করতে হবে।
জনসাধারণের ব্যবহারের জন্য মাটির নিচে আন্তর্জাতিক মানের টয়লেট স্থাপন ও নির্ধারিত দূরত্বে বিনা মূল্যে জনসাধারণের জন্য বিশুদ্ধ পানির ব্যবস্থা করার পরামর্শ দেয়া হয় রায়ে।
এতে বলা হয়, পায়ে চলার রাস্তা, বাইসাইকেল লেন এবং শারীরিক প্রতিবন্ধীদের জন্য পৃথক লেন তৈরি করতে হবে। এ ছাড়া লেক মাছের অভয়ারণ্য করার জন্য ক্ষতিকর সব ধরনের যান্ত্রিক যান বা ওয়াটার ট্যাক্সি সার্ভিস ব্যবহার নিষিদ্ধ করার পরামর্শও দেয়া হয় রায়ে। পাশাপাশি প্রকল্পটি বিজ্ঞানী স্যার জগদীশ চন্দ্র বসুর নামে নামকরণ করার পরামর্শ এসেছে রায়ে।