পর্যটননগরী কক্সবাজার সব সময়ই ভ্রমণপিপাসু মানুষের আকর্ষণীয় স্থান। বছরের প্রায় সব সময় এখানে পর্যটকদের আনাগোনা থাকে। সম্প্রতি মদপানে পর্যটকের মৃত্যুর ঘটনা ভাবিয়ে তুলেছে সংশ্লিষ্টদের।
গত বুধবার অতিরিক্ত মদপানে লাবণী আক্তার নামে এক পর্যটকের মৃত্যু হয়। একই দিন পৃথক হোটেলে আরও দুই পর্যটকের মৃত্যুর ঘটনায় রহস্য ঘনীভূত হয়েছে।
মাদকসেবনে ওই নারী পর্যটকের মৃত্যুর বিষয়টি পুলিশ নিশ্চিত হওয়ার পর আলোচনায় এসেছে অ্যালকোহলের সঙ্গে বিষাক্ত মিথানল মিশ্রণের বিষয়টি।
কক্সবাজার মেডিক্যাল কলেজের সহকারী অধ্যাপক (ক্লিনিক্যাল ট্রপিক্যাল মেডিসিন ও সংক্রামক রোগ বিশেষজ্ঞ) মোহাম্মদ শাহজাহান নাজির নিউজবাংলাকে বলেন, ‘পর্যটকদের অনেকেই যুবক-যুবতী। যাদের কেউ কেউ অ্যালকোহলের সঙ্গে ইয়াবা পান করায় বিষক্রিয়ায় অসুস্থ হয়ে পড়েন।
কোনো কোনো মদে মিলেছে মিথানলের উপস্থিতি। ময়নাতদন্ত না হওয়ায় এসব নিশ্চিত হওয়া যায় না তেমন।’
পুলিশ বলছে, প্রাথমিক তদন্তে তারা প্রমাণ পেয়েছেন মৃত ও অসুস্থ ব্যক্তিরা মদ পান করেছিলেন। মৃত ব্যক্তিদের স্বজন ও অসুস্থরা সামাজিক কারণে ঘটনাটি নিয়ে এগোতে চান না। তাদের অসহযোগিতার কারণে তদন্তে সামনে এগোনো যায় না। ময়নাতদন্ত করতেও রাজি হন না এসব মৃত ব্যক্তির স্বজনরা। যার ফলে তাদের মৃত্যুর আসল কারণ থেকে যায় আজানা।
তবে তিন পর্যটকের মৃত্যুর পর পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে কথা বলে ময়নাতদন্ত করা হয়েছে। এসব তদন্তের প্রতিবেদন পেলে মৃত্যুর কারণ হিসেবে আরও তথ্য মিলবে।
কক্সবাজার সদর মডেল থানার ওসি (তদন্ত) সেলিম উদ্দিন নিউজবাংলাকে বলেন, ‘তিনজনের মৃত্যু নিয়ে রহস্য রয়েছে। তাই পুলিশ অধিকতর তদন্তের স্বার্থে এবং মৃত্যুর সঠিক কারণ জানতে ময়নাতদন্ত করা হয়েছে। এখন প্রতিবেদনের অপেক্ষায়।
‘এসব ঘটনায় পরিবারপক্ষের লোকজন ময়নাতদন্ত করাতে রাজি থাকেন না। তাই এসব ঘটনার অন্তরালেও যাওয়া হয় না।’
মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের হিসাবে কক্সবাজারের অনুমোদিত বারের সংখ্যা ৯টি। নিয়ম না মেনে এসব বার থেকে পার্সেল যায় বাইরের হোটেলে। এ ছাড়া খালি বোতল সংগ্রহ করে সেই বোতলে মদ তৈরি হচ্ছে মেথিলেটেড স্পিরিট দিয়ে। সাধারণত দেশি-বিদেশি মদ তৈরিতে ব্যবহৃত হয় রেকটিফায়েড স্পিরিট।
এসব মদ যতটা না ‘বারে’ বিক্রি হচ্ছে, তার চেয়ে বেশি হোটেল-মোটেল জোনে মিলছে। প্রশাসনের বিভিন্ন অভিযানে এমন মদ ধরাও পড়েছে।
মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের এক কর্মকর্তা বলেন, ‘শিল্পে ব্যবহৃত মিথানল দেখতে ও গন্ধে অনেকটা রেকটিফায়েড স্পিরিটের মতোই। এটির দাম কম হওয়ায় ভেজাল হিসেবে মিথানল মিশিয়ে কালোবাজারির মাধ্যমে পর্যটকদের কাছে বিক্রি করে ভেজাল মদের ব্যবসায়ীরা।
‘১০ মিলিলিটার বিশুদ্ধ মিথানল একজন মানুষের মৃত্যুর জন্য যথেষ্ট। আর পানি বা অন্য পদার্থ মিশ্রিত ২৫ থেকে ৯০ মিলি মিথানল সেবনের পর যথাসময়ে চিকিৎসা না পেলে মৃত্যু ঘটতে পারে। মিথানল শরীরের কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্রে আঘাত করে রক্তে অক্সিজেনের পরিমাণ কমিয়ে দেয়। যার কারণে মৃত্যু হয়।‘অনেক সময় ভেজাল হিসেবে ডিএস অর্থাৎ ডিনেচার্ড স্পিরিটও (উড বার্নিস নামে পরিচিত-কাঠের দোকানে পাওয়া যায়) ব্যবহার করে। মূলত এই দুটোই অনেক সময় ভেজাল হিসেবে ব্যবহার করে। কক্সবাজারে বারের চেয়ে খোলাবাজারের মদগুলোয় এসবের ব্যবহার বেশি। বিশেষ করে হোটেলের নিরাপত্তাকর্মী, অটোরিকশা ও ইজিবাইকচালকরা পর্যটকদের কাছে এসব মদ সরবারহ করে থাকেন।
এই কর্মকর্তার দেয়া তথ্যের সূত্র ধরে অনুসন্ধান করেছে নিউজবাংলা। মিলেছে সত্যতাও।
একটি আবাসিক হোটেলের নিরাপত্তাকর্মী রিফাত (ছদ্মনাম) বলেন, ‘৯টি বারের যেকোনোটিতে গেলে পার্সেল হিসেবে মদ দেয়া হয়। সেই মদে বিষাক্ত মিথানল যুক্ত করা হয়। পার্সেলের সঙ্গে দেয়া হয় ইয়াবাও।‘রেখে দেয়া আসল মদ বারে ফেরত দেয়ার সুযোগ রয়েছে। এই সুযোগে অতিরিক্ত টাকার লোভে অনেকে এই কাজ করছে।’
রিফাতের মতো আরও দুই ইজিবাইকচালকের কাছেও মিলেছে একই ধরনের তথ্য।
সৈকতের লাবনী পয়েন্টের বার ‘কয়লা’র ব্যবস্থাপক আসাদুজ্জামান বিদ্যুৎ নিউজবাংলাকে বলেন, ‘লাইসেন্সধারীরাই বারে বসে মদ পান করার সুযোগ পান। পার্সেল কিংবা অনুমোদনহীন ব্যক্তি মদ পান না।’
একজন ব্যক্তি প্রতিদিন কী পরিমাণ মদ নিতে পারবেন জানতে চাইলে তিনি জানান, এ তথ্য তার কাছে নেই।
কক্সবাজার জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট (পর্যটন সেল) সৈয়দ মুরাদ ইসলাম বলেন, ‘একঘেঁয়ে কর্মজীবন থেকে একটু ছাড় পেলেই পর্যটকদের স্বস্তির নিঃশ্বাসের জায়গার নাম কক্সবাজার। আর এসব পর্যটদের হাতে অবৈধভাবে যারা মাদক তুলে দিচ্ছেন তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।’