পাঁচ দিন ধরে উদ্বাস্তু ছিলেন সায়রা বেগম। এত দিনে বাসা থেকে পানি নেমেছে। মঙ্গলবার নগরের মনিপুরী রাজবাড়ী এলাকায় স্বামীকে নিয়ে নিজের বাসা পরিচ্ছন্নতার কাজ করছিলেন তিনি। দুজনের নাক-মুখই কাপড়ে ঢাকা।
ঘর পরিষ্কার করতে করতেই সায়রা বেগম বলেন, ‘পাঁচ দিন পর বাসায় এসেছি। ঘরে দাঁড়ানোর মতো উপায় নেই। ময়লা পানির দুর্গন্ধে বমি আসার উপক্রম। ঘরজুড়ে আবর্জনার স্তূপ।’
দুর্গন্ধের কারণে দোকানেও বসা যায় না জানিয়ে তালতলা এলাকার ব্যবসায়ী রিয়াজ আহমদ বলেন, ‘এত দিন পানির কারণে ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ ছিল। পানি নামার পর দোকান ভালো করে পরিষ্কার করে আজ খুলেছি। কিন্তু গন্ধের কারণে বসতে পারছি না। চারদিক থেকে দুর্গন্ধ আসছে।’
সিলেটে কমতে শুরু করেছে বন্যার পানি। নগরের বেশির ভাগ অংশ থেকেই পানি নেমে গেছে। সুরমা নদীর পানিও এখন বিপৎসীমার নিচে। তবে পানি কমলেও দুর্ভোগ কমেনি নগরবাসীর। বাসায় ফিরতে পারছেন না অনেকে। যেসব এলাকায় পানি উঠেছিল সেসব এলাকায় তীব্র দুর্গন্ধ দেখা দিয়েছে।
মঙ্গলবার নগরের জলমগ্ন হয়ে পড়া কয়েকটি এলাকা ঘুরে দেখা যায়, বাসাবাড়ি থেকে পানি নেমে গেছে। সড়কের বেশির ভাগ অংশেও পানি নেই। তবে কিছু এলাকার সড়কে এখনও ময়লা ও দুর্গন্ধ যুক্ত পানি রয়ে গেছে। এসব এলাকায় নিজেদের বাসাবাড়ি পরিচ্ছন্নতার কাজ করতে দেখা গেছে বাসিন্দাদের। অনেকে শ্রমিক লাগিয়ে পরিচ্ছন্নতার কাজ করছেন।
নগরের বাসিন্দারা জানান, পানির সঙ্গে ড্রেনের ময়লা-আবর্জনা ছড়িয়ে পড়েছে পুরো এলাকায়। ঢুকে পড়েছে বাসাবাড়িতেও। স্যুয়ারেজ লাইনও লিক করে অনেকের বাসাবাড়িতে আবর্জনা ছড়িয়ে পড়েছে। এতে দুর্গন্ধ প্রকট আকার ধারণ করেছে।
পানি নেমে যাওয়ায় মঙ্গলবার নগরের জামতলা এলাকার নিজের বাসা পরিচ্ছন্নতার কাজ করতে গিয়েছিলেন রজতকান্তি গুপ্ত। তিনি বলেন, ‘পরিচ্ছন্নতার কাজ না করেই আমাকে ফিরে আসতে হয়েছে। কারণ দুর্গন্ধের কারণে বাসায় ঢোকার মতো কোনো অবস্থা নেই।’
তিনি বলেন, ‘পরিচ্ছন্নতা কাজের জন্য শ্রমিক খুঁজতেছি, তবে এখনও পাইনি। ফলে বাসা থেকে পানি নেমে গেলেও আমরা বাসায় ফিরতে পারছি না। হোটেলে থাকতে হচ্ছে।’
দুর্গন্ধ কমাতে সিটি করপোরেশন থেকে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে না বলে অভিযোগ করেছেন নগরের অনেকে। আর নগরকর্তারা বলছেন, পরিচ্ছন্নতা অভিযানের জন্য বরাদ্দ চেয়ে তারা মন্ত্রণালয়ে আবেদন করেছেন।
নগরের উপশহর এলাকার বাসিন্দা সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘নগরের ড্রেনগুলোর আবর্জনা আর স্যুয়ারেজ সিস্টেমে সমস্যার কারণেই এত দুর্গন্ধ। না হলে বন্যার পানিতে এত দুর্গন্ধ হতো না। পানি নেমে গেলেও দুর্গন্ধ কমাতে সিটি করপোরেশনের এখন পর্যন্ত কোনো উদ্যোগ নেই।’
গন্ধের কারণে বাসার অনেকে অসুস্থ হয়ে পড়ছেন বলে জানান স্থানীয় আনোয়ার।
সিলেট নগরে খাওয়ার পানি সরবরাহ করে সিটি করপোরেশন। জলমগ্ন এলাকায় এত দিন এই পানি সরবরাহ বন্ধ ছিল। তবে পানি নেমে যাওয়া এলাকাগুলোতে খাওয়ার পানি সরবরাহ শুরু হয়েছে।
সিটি করপোরেশনের সরবরাহকৃত পানিতেও প্রকট দুর্গন্ধ জানিয়ে নগরের মাছুদিঘির পাড় এলাকার বাসিন্দা অনিল পাল বলেন, ‘এসব পানি খাওয়া তো দূর কথা হাতেও নেয়া যায় না, এমনই দুর্গন্ধ।’
বন্যার কারণে আশ্রয়কেন্দ্রে উঠেছিলেন নগরের তেররতন এলাকার একটি বস্তির বাসিন্দা সুলেখা বেগম। তবে পানি নামলেও বাসায় ফিরতে পারছেন না জানিয়ে সুলেখা বলেন, ‘বাসার ভেতর ও আশপাশ এলাকায় এত বেশি দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে যে তাতে কোনোভাবেই বাসায় ঢুকতে পারছি না। বাসার আসবাবগুলোও নষ্ট হচ্ছে।’
বাসার ভেতরে ময়লা-আবর্জনা ও কাদার স্তূপ লেগে আছে বলে জানান তিনি।
বাসাবাড়ি থেকে পানি নেমে গেলেও এখনও নগরের অনেকে আশ্রয়কেন্দ্রে রয়েছে বলে জানান সিলেট সিটি করপোরেশনের প্রশাসনিক কর্মকর্তা হানিফুর রহমান।
তিনি জানান, বন্যার কারণে সিটি করপোরেশনে ২৩টি আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছিল। গত শুক্রবার পর্যন্ত প্রায় তিন হাজার পানিবন্দি মানুষ ছিল সেখানে। এখন পর্যন্ত আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে হাজারের মতো আশ্রয়প্রার্থী আছে।
পানির দুর্গন্ধের বিষয়ে সিলেট সিটি করপোরেশনের প্রধান প্রকৌশলী নুর আজিজুর রহমান বলেন, ‘বন্যার সময় পানি বেড়ে যাওয়ায় সেফটিক ট্যাংকির পানি, খাওয়ার পানি, বন্যার পানি, ড্রেনের পানি সব একাকার হয়ে গেছে।
‘এ কারণে কিছুদিন খাবার পানি সরবরাহ বন্ধ রেখেছিলাম। এখন যেহেতু পানি আস্তে আস্তে কমছে তাই পানির রিজার্ভ ট্যাংক পুরোটা পরিষ্কার করব। এতে গন্ধ কমে যাবে।’
তিনি জানান, নগরের বিভিন্ন এলাকায় দুর্গন্ধ ছড়িয়ে পড়েছে। এ ছাড়া পানি নেমে গেলেও জীবাণু থাকতে পারে। এতে অনেকে পানিবাহিত রোগে আক্রান্ত হতে পারে। এ জন্য পুরো নগর ব্লিচিং পাউডার দিয়ে পরিষ্কার করা হবে। এ জন্য প্রচুর পরিমাণ ব্লিচিং পাউডার কিনতে হবে। এ জন্য বরাদ্দ চাওয়া হয়েছে।
সিটি করপোরেশনের প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. জাহিদুর রহমান বলেন, ‘দুর্গন্ধের কারণে ডায়রিয়া ও বিভিন্ন ধরনের চর্মরোগ দেখা দিতে পারে। এ ব্যাপারে সবাইকে সচেতন থাকতে হবে। আমরাও সতর্ক নজর রাখছি।’
সিলেট সিটি করপোরেশন মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী বলেন, ‘সাকার মেশিন দিয়ে পুরো নগর পরিষ্কার করা হবে। এ জন্য পানি পুরোপুরি নামতে হবে। নগরজুড়ে এখন পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট দেয়া হচ্ছে।’