বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

বিদেশি ফলে বাড়তি শুল্ক, দেশি ফলের সুদিন

  •    
  • ২৫ মে, ২০২২ ০৮:৩৪

দেশি ফলের যখন ভরা মৌসুম, সে সময় বিদেশি ফল আমদানির ওপর শুল্ক বাড়ল। এতে বাজারে বিদেশি ফলের দাম বাড়বে। তবে দেশি ফলের জন্য এটা সুখবর বলে মনে করা হচ্ছে। তাছাড়া দেশে-বিদেশি ফলের চাষ এতে উৎসাহিত হবে।   

দেশে যেসব ফল উৎপাদন হয় তার প্রায় ৬০ ভাগ উৎপাদিত হয় জুন-জুলাই ও আগস্ট মাসে। তরমুজের মৌসুম শেষ হওয়ার আগেই বাজারে গড়িয়েছে সুস্বাদু লিচু। আমও আসতে শুরু করেছে। এ ছাড়া কাঁঠাল, পেয়ারা, আমড়া, জামরুল, আমলকী, বরই, পেঁপে, কলা ও আনারসেরও দেখা মিলছে।

বাজারে দেশি ফলের ভরা মৌসুম থাকবে আরও তিন মাস।

ঠিক এ রকম সময়ে সরকার বিদেশি ফল আমদানির ওপর শুল্ক বাড়িয়েছে। ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের নেতিবাচক প্রভাবে দেশের রিজার্ভ সুরক্ষিত রাখতে এ উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। প্রতি বছর দেশে ফল আমদানির পেছনে চলে যায় গড়ে ১০ হাজার কোটি টাকার মতো।

এই আকালের দিনে বিদেশি মুদ্রা দেশের বাইরে যাওয়া ঠেকাতে সরকার অন্যান্য অপ্রয়োজনীয় পণ্যের পাশাপাশি সব ধরনের ফল আমদানিকেও নিরুৎসাহিত করার পদক্ষেপ নিয়েছে।

এত দিন বিদেশি ফল আমদানিতে যে পরিমাণ শুল্ক ধার্য ছিল, তার চেয়ে অতিরিক্ত ২০ শতাংশ নিয়ন্ত্রণমূলক শুল্ক বা রেগুলেটরি ডিউটি (আরডি) আরোপ করা হয়েছে। এত দিন এই নিয়ন্ত্রণমূলক শুল্কহার ছিল মাত্র ৩ শতাংশ।

মঙ্গলবার জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) বাড়তি শুল্ক আরোপ করে একটি প্রজ্ঞাপন জারি করেছে। এতে উল্লেখ করা হয়েছে, প্রজ্ঞাপন জারির দিন থেকেই তা কার্যকর হবে।

এনবিআর বলেছে, দেশে উৎপাদিত ফল খাওয়াকে উৎসাহিত করতে বিদেশি ফলের আমদানির ওপর এই বাড়তি শুল্ক আরোপ করা হয়।

বর্তমানে ফল আমদানিতে কাস্টমস ডিউটি (সিডি) ২৫ শতাংশ, ভ্যাট ১৫ শতাংশ, অগ্রিম আয়কর ৫ শতাংশ এবং অ্যাডভান্স ট্রেড ভ্যাট ৪ শতাংশ ধার্য রয়েছে। এখন ফল আমদানিকারকদের এর সঙ্গে বাড়তি ২০ শতাংশ নিয়ন্ত্রণমূলক শুল্ক পরিশোধ করতে হবে।

এ বিষয়ে এনবিআরের সংশ্লিষ্ট বিভাগের এক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমরা চাই দেশের মানুষ দেশি ফল খাক। এতে করে দেশি ফলের উৎপাদন বাড়বে এবং কৃষকরা এতে উপকৃত হবেন। অন্যদিকে এই নিয়ন্ত্রণমূলক শুল্ক আরোপের ফলে বিদেশি ফল আমদানির পরিমাণ কমবে এবং এতে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রার সাশ্রয় হবে।’

তিনি মনে করেন, ফল আমদানিতে এ শুল্ক সাময়িকভাবে বাড়ানো হয়েছে। এই সময়ের মধ্যে বিদেশি ফল না খেলেও কোনো অসুবিধা হবে না।

ফল ব্যবসায়ীরা মনে করেন, ফল একটি অতি প্রয়োজনীয় পণ্য। এটি রোগী থেকে শুরু করে শিশুসহ সব শ্রেণির মানুষ খায়। তাছাড়া বিদেশি ফল হচ্ছে আমদানি পর্যায়ে রাজস্ব আহরণের দিক থেকে শীর্ষ দশ খাতের একটি। এ অবস্থায় সরকারের এ ধরনের পদক্ষেপ নেয়া ঠিক হয়নি।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বাংলাদেশ ফ্রেশ ফ্রুটস ইম্পোর্টার অ্যাসোসিয়েশনের (বিএফএফআইএ) মহাসচিব সিরাজুল ইসলাম নিউজবাংলাকে বলেন, ‘ফল কোনো বিলাসী বা অপ্রয়োজনীয় পণ্য নয়। এটা রোগীর পথ্য এবং শিশুসহ সব বয়সের মানুষের দৈনন্দিন খাদ্যতালিকায় ভাত-মাছ ও সবজির মতো গুরুত্বপূর্ণ। সুস্থ থাকার জন্য নিয়মিত ফল খায় মানুষ। কেন যে সরকার অন্যান্য অপ্রয়োজনীয় পণ্যের সঙ্গে এই অত্যাবশ্যকীয় পণ্যকেও নিয়ন্ত্রণমূলক শুল্ক বসিয়ে আমদানি নিরুৎসাহিত করার উদ্যোগ নিলো, সেটি আমাদের বোধগম্য নয়।’

অন্য এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘এটি যদি সাময়িক সময়ের জন্য হয়ে থাকে তাহলে ঠিক আছে। আমরাও তার বিরোধিতা করছি না। দেশে প্রতিদিন ফলের চাহিদা ১০ থেকে ১২ হাজার টন। সারা বছর ধরে ১০ হাজার কোটি টাকার বেশি ফল আমদানি হয়।

‘এর থেকে সরকারকে আমরা ৩ হাজার কোটি টাকার রাজস্ব দিতাম। এখন সেটি হবে না। একদিকে আমদানি কমে যাবে। এতে সরকার বাড়তি শুল্ক আরোপ করেও কম রাজস্ব পাবে। অন্যদিকে সিদ্ধান্ত পরিবর্তন না হওয়া পর্যন্ত ভোক্তাকে বর্তমানের চেয়ে আরও বেশি দামে বিদেশি ফল খেতে হবে।’

জানা গেছে, দেশে ফলের যে চাহিদা, তার ৩৫ শতাংশ অভ্যন্তরীণ উৎপাদন দিয়ে মেটানো যায়। বাকি ৬৫ শতাংশ ফলই বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়।

শরীরের আবশ্যকীয় বিভিন্ন ভিটামিন ও খনিজ পদার্থের উৎস হলো ফল। সাম্প্রতিক বছরগুলোয় দেশে পুষ্টি চাহিদা পূরণে ধনী-গরিব তথা সব শ্রেণি-পেশার মানুষের মধ্যে ফল খাওয়ার চাহিদা বেড়েছে। ফলে দেশে ফলমূল কেনাকাটা বা ভোগের একটা বড় বাজার তৈরি হয়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংক ও কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য মতে, আপেল, কমলা, আঙুর, নাশপাতি, মাল্টা, চেরি, আনার, বরই, আম ছাড়াও বেবি ম্যান্ডারিন, পাম, নেকটারিন, কিউইর, সুইট মিলান, এবাকাডোর মতো কিছু অপরিচিত ফলও আমদানি করা হয়।

দেশি ফলের উৎপাদন

চাহিদা বাড়ার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে প্রতি বছর বাড়ছে দেশি ফলে বাণিজ্যিক উৎপাদন। মৌসুমি ফল উৎপাদনে বিশ্বের শীর্ষ ১০ দেশের তালিকায় নাম লিখিয়েছে বাংলাদেশ। এখানে এখন ৭২ প্রজাতির ফলের চাষ হচ্ছে।

পুষ্টিমান বিশেষজ্ঞরা জানান, দেশি ফল রোগ প্রতিরোধ ছাড়াও হজম ও পরিপাকে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। এতে ক্যানসার প্রতিরোধী উপাদান অ্যান্থোসায়ানিন, লাইকোপেন ও অ্যান্টি অক্সিডেন্ট উপস্থিত থাকে।

জাতিসংঘের কৃষি ও খাদ্য সংস্থার (এফএও) মতে, ১৮ বছর যাবত বাংলাদেশে সাড়ে ১১ শতাংশ হারে ফল উৎপাদন বেড়েছে। কাঁঠাল উৎপাদনে বাংলাদেশ বিশ্বে দ্বিতীয়, আমে সপ্তম। পেয়ারা উৎপাদনে অষ্টম স্থানে।

দেশে প্রতি বছর ফল চাষের জমি ১০ শতাংশ হারে বাড়ছে। গত ১০ বছরে আম ও পেয়ারার উৎপাদন দ্বিগুণ, পেঁপে আড়াই গুণ, লিচু ৫০ শতাংশ বেড়েছে। এ ছাড়া কমলার উৎপাদন প্রতি বছর ৫ শতাংশ হারে বাড়ছে। মাল্টার উৎপাদন বাড়ছে ১৫-২০ শতাংশ হারে।

গত কয়েক বছর ধরে নতুন ফল ড্রাগন, এভোকাডো এবং দেশি ফল বাতাবি লেবু, তরমুজ, লটকন, আমড়া ও আমলকীর উৎপাদন ব্যাপক হারে বাড়ছে। নতুন করে ড্রাগন ফলের ২৩টি, খেজুরের ১৬টি, নারকেলের দুটি এবং কাঁঠালের তিনটি জাত এখন বছরব্যাপী উৎপাদন ও সম্প্রসারণের কাজ চলমান। এ প্রকল্পের মাধ্যমে সীমিত জমিতে অধিক ফল উৎপাদনের ওপর গুরুত্ব দেয়া হয়েছে।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য মতে, ২০১৪-১৫ থেকে ২০১৮-১৯ অর্থবছরে দেশে ফল আমদানি ৭২ শতাংশ বেড়েছে। এই সময়ে অভ্যন্তরীণ উৎপাদন বেড়েছে ২১ শতাংশ। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে দেশে স্থানীয় ও বিদেশি জাত মিলিয়ে মোট ১ কোটি ১০ লাখ টন ফল উৎপাদিত হয়েছে। ২০১৬-১৭ অর্থবছরে তা বেড়ে ১ কোটি ২০ লাখ টন হয়। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে উৎপাদন আরও বৃদ্ধি পেয়ে ১ কোটি ২১ লাখ ১১ হাজার টন এবং ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ১ কোটি ২১ লাখ ১৫ হাজার টনে দাঁড়ায়। সবশেষ পূর্ণাঙ্গ অর্থবছরের (২০১৯-২০) উৎপাদন তথ্য অনুযায়ী, স্থানীয় ফলমূলের উৎপাদন ১ কোটি ২৩ লাখ টনে পৌঁছায়।

‘বছরব্যাপী ফল উৎপাদনের মাধ্যমে পুষ্টি উন্নয়ন প্রকল্প’ এর প্রকল্প পরিচালক ড. মো. মেহেদী মাসুদ জানান, একজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের প্রতিদিন ২০০ গ্রাম ফল খাওয়া প্রয়োজন। তবে আমরা প্রতিদিন প্রায় গড়ে ৭০-৮০ গ্রাম ফল খাই।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের হর্টিকালচার উইং ও উদ্ভিদ সঙ্গনিরোধ কেন্দ্রের তথ্য বলছে, প্রতি বছর প্রায় ২ লাখ টনের বেশি আপেল, দেড় থেকে ২ লাখ টন কমলা, ৫০ হাজার টনের বেশি আঙুর আমদানি হয়। তবে মাল্টার আমদানিতে কোনো ধারাবাহিকতা লক্ষ করা যায়নি। কোনো বছর কম, কোনো বছর বেশি। গত পাঁচ বছরে এই চার ধরনের ফল আমদানিতে ব্যয় বেড়েছে দ্বিগুণ। দেশে মোট আমদানীকৃত ফলের প্রায় ৮৫ শতাংশই আপেল, কমলা, মাল্টা ও আঙুরের দখলে। বাকি অংশ পূরণ হয় অন্যান্য ফল আমদানিতে।

২০১৫-১৬ অর্থবছরে ফল আমদানির পরিমাণ ছিল মোট ৪ লাখ ৭৩ হাজার টন। করোনায় আমদানি দীর্ঘ সময় বন্ধ থাকা সত্ত্বেও ২০১৯-২০ অর্থবছরে ফল আমদানি ৬ লাখ ২৬ হাজার টনে পৌঁছায়।

বিশ্বের ৪৬টি দেশ থেকে ফল আমদানি করা হয়। এর মধ্যে ভারত, চীন, ব্রাজিল, নিউজিল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া, আর্জেন্টিনা, ফ্রান্স, যুক্তরাষ্ট্র, ভুটান, মিশর ও দক্ষিণ আফ্রিকা অন্যতম। তবে ভারত থেকে সবচেয়ে বেশি ফল আসে।

চট্টগ্রাম বন্দর, ঢাকা বিমানবন্দর, ভোমরা, সোনামসজিদ, হিলি ছাড়াও বেশ কটি সীমান্ত এলাকা দিয়ে এসব ফল আসে।

এ বিভাগের আরো খবর