কেউ হারিয়েছেন ভিটেমাটি, কেউ দেখেছেন পুরো গ্রাম নদীর বুকে হারিয়ে যেতে। সব হারিয়ে স্বচ্ছল পরিবারের মানুষরা এখন দিনমজুর হিসেবে কাজ করছেন।
রংপুরের গংগাচড়া উপজেলার কোলকোন্দ ইউনিয়নের পশ্চিম বিনবিনিয়া নারকেল তল এলাকার মানুষের এমন দুর্দশার কারণ তিস্তার ভাঙন।
এ অবস্থায় তিস্তা নদীতে নিজেরাই বাঁধ তৈরির উদ্যোগ নিয়েছে গংগাচড়া উপজেলার ১০ গ্রামের মানুষ। তাদের আশা, বাঁধা হলে শেখ হাসিনা সেতু ও পার্শ্ববর্তী লালমনিরহাটের কালিগঞ্জ উপজেলাও ভাঙনের হাত থেকে রক্ষা পাবে।
স্থানীয়রা বলছেন, ৫ শ মিটার বাঁধ দিলেই টিকে যাবে গ্রামগুলো। বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হবে না অন্তত ১০ হাজার পরিবার।
বিনবিনিয়া চরের পাঙ্গারটারীতে গিয়ে দেখা যায়, স্থানীয় লোকজন নদী থেকে বালু তুলে বাঁধ নির্মাণের কাজ করছে। এ কাজে কেউ দিয়েছেন বস্তা, কেউ বাঁশ আবার কেউ কেউ দিচ্ছেন স্বেচ্ছাশ্রম। প্রায় এক মাস ধরে প্রতিদিন তারা বাঁধের কাজ করছেন।
এই কাজের ইনচার্জ মাহফুজুর রহমান বলেন, ‘এখন পর্যন্ত ৮ হাজার বস্তায় বালু ভরে বাঁধ দেয়া হয়েছে। প্রতিদিনই বস্তা ভরে ফেলা হচ্ছে।’
তবে বালুর এই বাঁধ খুব বেশি টেকসই হবে না বলে জানান স্থানীয়রা।
তারা বলছেন, বালুর বাঁধ পানির স্রোতে ভেসে যেতে পারে। তবুও বস্তায় বালু ভরে বাঁধের নিচে দেয়া হচ্ছে যেন একেবারে ধসে না যায়। বাড়িঘরগুলো টেকে।
পশ্চিম বিনবিনিয়া নারকেল তল এলাকার সুকুমার চন্দ্র বর্মন বয়সের ভারে নুয়ে পড়েছেন। কাজে সাহায্য করতে না পারলেও তিনি এসেছেন কাজ দেখতে।
সুকুমার নিউজবাংলাকে বলেন, ‘চার বছর আগোতও (আগেও) ১৫ দোন (২৪ শতকে ১ দোন) জমি আছিল আমার। হালের গরু, গোয়াল, কামলা-কিষান সবই আছিল। ছৈলপৈলরা (ছেলেমেয়েরা) ভালোভাবে চলছিল। এখন সেই জমিত পানি আর পানি। তিনবার বাড়ি ভাঙ্গি নিয়ে গেছি।
‘এলা (এখন) কোনোমতে নদীর ওপরে একটা ঘর করি আছি। চার ছেলে ঢাকায় খাটে। একটা মে বিয়ে দিছি। আমরা বুড়াবুড়ি নদীর ওপর কোনো মতে ঘর করি আছি। নিজের বাড়ি-ঘর তো নাই। বাকিদেরটা যেন টেকে সেই জন্য কাজ দেখপের (দেখতে) আসছি।’
একই এলাকার আশরাফুল ইসলাম বলেন, ‘তিস্তা মারেও না, বাঁচতেও দেয় না। কত দুঃখ হামার! চারবের (চার বার) বাড়ি ভাঙ্গি আনছি। ফির ভাঙ্গে, ফির আগায়, ফির পাচায় (পেছায়)।’
আশরাফুলের প্রশ্ন, স্থানীয়দের চেষ্টায় কি গ্রামগুলো রক্ষা পাবে? বালুর বস্তা কি আদৌ পানি আটকাতে পারবে?
তিনি বলেন, ‘মনের ডাকোত (ডাকে) বাঁধ দিতেছি। যদি এবার ঘরগুলো টেকে! যতক্ষণ সরকার বোল্ডার না দেয় বা খোঁড়ন (খোঁড়া) না দেয় কিছু হবার নয়। পানি উন্নয়ন বোর্ডের স্যারদের কই, ওমরা (তারা) কিছু কয় না।’
বাঁধের কাজ করতে থাকা মশিউর রহমান বলেন, ‘নদী থাকি শ্যালোমেশিন দিয়ে বালু তুলতেছি, বস্তাত ভরাইতেছি, ফেলাইতেছি। বস্তা না দিলে তো বাঁধটা টিকবে না। যার যতটুকু সামর্থ্য ততটুকু দিয়ে কাজ করতেছি।’
মইনুল ইসলাম জানান, বাঁধ দিলে এই এলাকার মানুষ আবাদ করতে পারবে। নাহলে আমন ধানের চাষ হবে না। পুরো এলাকা প্লাবিত হয়ে থাকবে।
তিনি বলেন, ‘বাঁচার জন্যই এই বাঁধটা তৈরি করতেছি। সবাই যেন বাঁচি, একসঙ্গে বাঁচি। এই মুহূর্তে দরকার বস্তার। ১ হাজার বস্তার দাম নেয় ১০ হাজার টাকা। আমাদের হাজার হাজার বস্তার প্রয়োজন।
‘গ্রামের মানুষ এত টাকা কই পাবে? পানি উন্নয়ন বোর্ডের সঙ্গে বারবার যোগাযোগ করতেছি। তারা পাত্তা দিচ্ছে না। নিরুপায় হয়ে প্লাস্টিকের বস্তা কিনে এনে কাজ করতেছি।’
পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) কোনো সহযোগিতা করেনি বলে জানান কোলকোন্দ ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আব্দুর রউফও।
তিনি নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমি কিছু অনুদান দিয়ে এই এলাকা রক্ষার চেষ্টা করতেছি। এলাকার সাধারণ মানুষ, দিনমজুর অনুদান দিচ্ছে, যারা টাকাপয়সা দিতে পারতেছে না তারা স্বেচ্ছায় শ্রম দিচ্ছে। তবে এ পর্যন্ত পানি উন্নয়ন বোর্ড কোনো সহযোগিতা করল না। এই বাঁধটা যদি ভেঙে যায় তাহলে কমপক্ষে ১০ হাজার পরিবার উচ্ছেদ হয়ে যাবে।
‘আমি অনুরোধ করে বলেছি, একবার আসেন। বোল্ডার না দেন অন্তত কিছু বস্তা দেন। তাও দিচ্ছে না।’
এ বিষয়ে রংপুর পাউবোর নির্বাহী প্রকৌশলী আহসান হাবিব বলেন, ‘অপরিকল্পিতভাবে সরকারি ফান্ড ব্যবহারের সুযোগ নেই। এ কারণে এখানে কোনো হেল্প করতে পারছি না। তবে বাঁধ নির্মাণের জন্য প্রকল্প প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে। পাস হলে কাজ করা হবে।’