কুষ্টিয়ায় ২০ দিনে ৯ জন খুন হয়েছেন। একের পর এক হত্যাকাণ্ড উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা ও আতঙ্ক ছড়িয়েছে। বেশির ভাগ খুনের ঘটনা ঘটেছে ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে। স্থানীয়দের অভিযোগ, পুলিশের গাফিলতিতে আবারও অস্থির হয়ে উঠেছে এ অঞ্চল। তবে পুলিশ বলছে, অপরাধ দমনে তারা তৎপর। কেউ যাতে আইন হাতে তুলে না নেয় সে জন্য প্রচারের পাশাপাশি নজরদারি বাড়ানো হয়েছে।
থানাসূত্রে জানা গেছে, ২ মে ঈদের আগের দিন বিকেলে কুষ্টিয়া সদরের ঝাউদিয়া-আস্তানগরে আধিপত্য বিস্তার নিয়ে দুই পক্ষের সংঘর্ষে কুপিয়ে খুন করা হয় চারজনকে। একপক্ষে তিনজন ও অপর পক্ষে একজন খুন হন। এ ঘটনায় উভয় পক্ষ মামলা করেছে। মামলায় গ্রেপ্তারের পর কারাগারে পাঠানো হয়েছে ঝাউদিয়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মেহেদী হাসান ও সাবেক চেয়ারম্যান কেরামত আলীকে। দুটি মামলার ৯৮ আসামির মধ্যে এরই মধ্যে জামিন পেয়েছেন ৭১ জন।
৫ মে কুমারখালীতে গড়াই ব্রিজের নিচ থেকে মাসুদ খাঁ নামে একজনের মরদেহ উদ্ধার করে পুলিশ। প্রথমে অপমৃত্যু মামলা হলেও পরে ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনে মেলে হত্যার আলামত। অপমৃত্যু মামলাটি হত্যা মামলায় রূপান্তর হয়।
১০ মে ভেড়ামারা উপজেলার ষোলদাগ গ্রামে জমিজমা নিয়ে বিরোধে খুন হন আব্দুল কুদ্দুস মল্লিক।
আলোচিত খুনের ঘটনা ঘটে ১১ মে কুষ্টিয়ার দৌলতপুরে। গভীর রাতে কুপিয়ে হত্যা করা হয় জাসদ যুবজোট নেতা মাহবুব খান সালামকে। এ ঘটনায় আওয়ামী লীগ নেতাদের আসামি করা হয়। বিচার দাবিতে মিছিল-সমাবেশ করেছে যুবজোট।
১৮ মে সদর উপজেলার দহকুলায় খুন হয় এক স্কুলছাত্র। জীবন আহমেদ নামে ওই এসএসসি পরীক্ষার্থী রাতে মোটরসাইকেলে করে বাড়ি থেকে বের হয়। পরদিন সকালে বাড়ি থেকে দেড় কিলোমিটার দূরে পুকুরপাড়ে তার বাইক আর পুকুরে মরদেহ পাওয়া যায়।
একই দিনে গভীর রাতে খোকসায় হেলথকেয়ার অ্যান্ড হাসপাতালের কর্মচারী মো. হিরনের মৃত্যু হয়। সে সময় বিদ্যুৎস্পৃষ্ট মনে হলেও পরে পরিবারের পক্ষ থেকে হত্যার দাবি করা হচ্ছে। তারা থানায় হত্যার অভিযোগও দিয়েছেন। বিচার দাবিতে ২২ মে বিক্ষোভ-সমাবেশ করেছে এলাকাবাসী।
২০ মে শহরের চরমিলপাড়ায় পারিবারিক কলহে খুন হয়েছেন বাবু শেখ নামে একজন। ছেলের কাছে খরচের টাকা চাওয়া ও বাড়িতে ঘর নির্মাণের জায়গা নিয়ে কথা-কাটাকাটি ও মারামারির মধ্যে ইটের আঘাতে তার মৃত্যু হয়।
চার খুনের ১৮ দিন পর ২১ মে ওই এলাকার ঝাউদিয়া-কালিতলায় পারিবারিক বিরোধে কুপিয়ে হত্যা করা হয় জসিম নামে একজনকে। ঝড়ে নুয়ে পড়া বাঁশ কাটতে গেলে নিজের দাবি করে জসিম বাধা দেন। এতে চাচাতো ভাই লালন ও তার ছেলেদের সঙ্গে মারামারি হয়। ধারালো অস্ত্রের আঘাতে জসিমের মৃত্যু হয়।
এই হিসাবে ২-২১ মে ২০ দিনে কুষ্টিয়ায় খুন হয়েছেন ৯ জন। এর মধ্যে সদর উপজেলাতেই ছয়জন। ভেড়ামারা, দৌলতপুর ও কুমারখালীতে একজন করে। এ ছাড়া খোকসার মৃত্যু নিয়ে ধোঁয়াশা কাটেনি।
একের পর এক খুনের ঘটনা নিয়ে উদ্বিগ্ন স্থানীয়রা। কুষ্টিয়া সচেতন নাগরিক কমিটির সভাপতি রফিকুল আলম টুকু নিউজবাংলাকে বলেন, ‘কুষ্টিয়ায় ইদানীং দু-এক দিন পর পরই মার্ডার হচ্ছে। এগুলো আমরা প্রত্যাশা করি না। একের পর এক খুনের কারণে পরিস্থিতি অস্থিতিশীল হচ্ছে। আমি মনে করি প্রশাসনকে তদারকি বাড়াতে হবে।’
জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল জাসদের কুষ্টিয়া জেলা শাখার প্রচার সম্পাদক কারশেদ আলম নিউজবাংলাকে বলেন, ‘স্বাধীনতার পর থেকেই এ জেলা চরমপন্থি-সন্ত্রাসীদের দাপট ছিল। বর্তমানে অপরাধ বাড়ার কারণে প্রশাসনের গাফিলতি আছে। সাধারণ মানুষের জানমালের নিরাপত্তা দেয়ার যে দায়িত্ব, সেটি তারা যথাযতভাবে করছে না বলে আমি মনে করি।’ কারশেদ বলেন, ‘যদি প্রশাসনিক কাজে কোনো বাধা থাকে তা অতিক্রম করতে হবে। না হলে ধারাবাহিকভাবে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি অবনতির দিকে যাবে।’
জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আসগর আলী নিউজবাংলাকে বলেন, ‘এসব খুনের ঘটনা ঘটছে সামাজিক দ্বন্দ্বের কারণে। এটি নিরসন করতে প্রশাসন, রাজনীতিবিদ, জনপ্রতিনিধি ও সামাজিক নেতাদের একসঙ্গে বসতে হবে। গ্রামে যারা দ্বন্দ্ব করে তাদের এই পথ থেকে সরাতে হবে।’
কুষ্টিয়া সরকারি কলেজের সমাজবিজ্ঞানের শিক্ষক অধ্যাপক শেখ মো. আবু শামীম বলেন, ‘মানুষ মানুষকে সম্মান করছে না। দ্রব্যমূলের ঊর্ধ্বগতির কারণেও তারা টেনশনে থাকছে। ভালো থাকার জন্য যা খুশি করার চেষ্টা করছে। এগুলো অস্থিরতার কারণ। আর এই অস্থিরতা থেকে অপরাধ বাড়ছে।’
পুলিশ বলছে, মানুষ অসহিষ্ণু হয়ে ওঠায় তুচ্ছ ঘটনাও খুনের পর্যায়ে যাচ্ছে। এ অবস্থায় বিট পুলিশের মাধ্যমে তৎপরতা বাড়ানোর কথা বলছেন জেলার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. মোস্তাফিজুর রহমান। তিনি বলেন, ‘আমরা তৎপরতা বাড়িয়েছি। আমাদের ৮৫টি বিট পুলিশ আছে। তাদের দিয়ে সবার কাছে খবর পৌঁছে দেব কেউ আইন হাতে তুলে না নেয়।’
প্রত্যেকটি খুনের ঘটনার উপযুক্ত বিচার হবে জানিয়ে তিনি বলেন, হতাশ না হয়ে পুলিশের প্রতি আস্থা রাখুন।’