দুর্নীতির মামলায় ঢাকা-৭ আসনের আওয়ামী লীগ দলীয় সংসদ সদস্য হাজি সেলিমের জামিন আবেদন নামঞ্জুর করে কারাগারে পাঠিয়েছে ঢাকার বিশেষ জজ আদালত-৭।
নানামুখী আলোচনার অবসান ঘটিয়ে কারাগারেই যেতে হলো হাজি সেলিম এমপিকে। আদালতের নির্দেশের পর পুলিশ তাকে কারাগারে নিয়ে যায়।
রোববার ঢাকার বিশেষ জজ আদালত-৭ এর বিচারক শহিদুল ইসলাম হাজি সেলিমের জামিন আবেদন নামঞ্জুর করে তাকে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন।
আদালতে হাজি সেলিমের পক্ষে আইনজীবী ছিলেন সাঈদ আহমেদ রাজা। আর মামলার বাদী দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) পক্ষে ছিলেন মোশাররফ হোসেন কাজল।
হাজি সেলিমের আদালতে আত্মসমর্পণকে কেন্দ্র করে রোববার দুপুরের আগে থেকেই আদালত চত্বরে ছিল উপচেপড়া ভিড়। কর্মী-সমর্থকদের পাহারায় আদালতে প্রবেশ করেন তিনি। আর আদালতের রায়ের পর পুলিশ পাহারায় তাকে কারাগারে নিয়ে যাওয়া হয়।
আদালতে হাজি সেলিম
ঢাকা-৭ আসনের জাতীয় সংসদ সদস্য হাজি সেলিমের আদালতে হাজিরাকে কেন্দ্র করে রোববার দুপুরের আগে থেকেই তার কর্মী-সমর্থকরা আদালতে জড়ো হতে থাকে। বেলা ২টার পর থেকে আদালত এলাকায় উপচেপড়া ভিড় জমে যায়। সেই ভিড় ঠেলে বিকেল ৩টার দিকে ঢাকা বিশেষ জজ আদালত-৭ এর এজলাসে প্রবেশ করেন হাজি সেলিম।
ক্ষমতাসীন দলের এই এমপি এজলাসে প্রবেশ করে প্রথমে সামনের একটি বেঞ্চে বসেন। সঙ্গে সঙ্গে তার বেশকিছু কর্মী-সমর্থকও এজলাসে ঢুকে পড়েন। এ সময় তার সন্তানেরা পাশে গিয়ে দাঁড়ান।
আইনজীবী, সাংবাদিক, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য এবং কর্মী-সমর্থকদের উপস্থিতিতে পুরো এজলাজ কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে যায়। অধিক মানুষের উপস্থিতিতে এজলাস কক্ষে অনেকটা হ-য-ব-র-ল অবস্থার সৃষ্টি হয়। এ কারণে বিচারিক কাজ শুরু হতে বেশ কিছুটা বিলম্ব হয়।
বিকেল ৩টা ২০ মিটিনের দিকে বিচারক এজলাসে ওঠেন। আইনজীবী আর সাংবাদিক ও দায়িত্বরত পুলিশ সদস্যরা ছাড়া বাকিদের এজলাস কক্ষ থেকে বের হয়ে যেতে বলেন বিচারক। এ সময় হাজি সেলিম উঠে দাঁড়িয়ে তার কর্মী-সমর্থকদের এজলাস থেকে বের হয়ে যেতে বলেন। কর্মী-সমর্থকরা এজলাস থেকে বের হয়ে যাওয়ার পর শুনানি শুরু হয়। শুনানির শুরুতে হাজি সেলিম কাঠগড়ায় গিয়ে দাঁড়ান। পুরোটা সময় ধরে তিনি কাঠগড়াতেই দাঁড়িয়ে থাকেন।
এ সময় আদালতে দুদকের পক্ষে আইনজীবী মোশাররফ হোসেন কাজল এবং হাজি সেলিমের পক্ষে সাঈদ আহমেদ রাজা শুনানি করেন। উভয় পক্ষের বক্তব্য শুনে আদালত জামিন আবেদন নামঞ্জুর করে হাজি সেলিমকে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেয়।
বিচারক হাজি সেলিমকে বসতে বলেন। পরে তিনি এজলাস থেকে নেমে এসে আবার বেঞ্চে এসে বসেন। সেখানে কিছুক্ষণ বসে থেকে আইনজীবীদের সঙ্গে সঙ্গে কথা বলতে যান হাজি সেলিম। এই পর্যায়ে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। পরে আদালতের একটি বেঞ্চে শুয়ে পড়েন তিনি।
বিকেল ৫টার পর পুলিশের একটি পিকআপ ভ্যানে করে হাজি সেলিমকে আদালত থেকে কারাগারে নিয়ে যায় আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। এ সময় তার কর্মী-সমর্থকরা নানা স্লোগান দিতে থাকে। অনেককে তার জন্য কান্না করতেও দেখা যায়।
আইনজীবীদের বক্তব্য
দুদকের পক্ষের আইনজীবী মোশাররফ হোসেন কাজল সাংবাদিকদের বলেন, ‘উচ্চ আদালতের নির্দেশ অনুযায়ী আজ হাজি সেলিম আদালতে আত্মসমর্পণ করেছেন। একইসঙ্গে জামিন চেয়ে আবেদন করেছিলেন। আদালত তার জামিন আবেদন খারিজ করে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দিয়েছেন। আর চিকিৎসা এবং কারাগারে ডিভিশনের বিষয়ে জেল কোড অনুযায়ী কারা কর্তৃপক্ষকে ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দিয়েছেন।’
অন্যদিকে হাজি সেলিমের আইনজীবী সাঈদ আহমেদ রাজা সাংবাদিকদের বলেন, ‘আদালতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল থেকে তিনি আজকে আত্মসমর্পণ করেছেন। আদালত জামিন আবেদন নামঞ্জুর করেছেন। তবে ডিভিশন এবং চিকিৎসার বিষয়ে কারা কর্তৃপক্ষকে ব্যবস্থা নিতে বলেছেন।
‘আজ আদেশের সার্টিফায়েড কপি পাওয়ামাত্রই সর্বোচ্চ আদালতে আপিল দায়ের করব এবং আপিল বিভাগের চেম্বার আদালতে জামিন চেয়ে আবেদন করব। আশা করি সর্বোচ্চ আদালত থেকে জামিন পেয়ে আমার মক্কেল কারামুক্তি লাভ করবেন।’
হাজি সেলিম এই মামলায় এর আগে দেড় মাস জেল খেটেছেন বলেও জানান আইনজীবী।
হাইকোর্টের রায়
অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে গত বছরের ৯ মার্চ বিচারপতি মো. মঈনুল ইসলাম চৌধুরী ও বিচারপতি এ কে এম জহিরুল হকের হাইকোর্ট বেঞ্চ হাজি সেলিমকে ১০ বছরের কারাদণ্ড এবং ১০ লাখ টাকা অর্থদণ্ড দিয়ে রায় ঘোষণা করেন। রায়ের কপি পাওয়ার ৩০ দিনের মধ্যে বিচারিক আদালতে আত্মসমর্পণের নির্দেশ দেয় আদালত।
চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ হয়। ২৫ এপ্রিল রায়ের সার্টিফায়েড কপি পায় আসামি পক্ষ। সে হিসাবে ৩০ দিনের মধ্যেই রোববার বিচারিক আদালতে আত্মসমর্পণ করেন এই সংসদ সদস্য।
২০০৭ সালের ২৪ অক্টোবর হাজি সেলিমের বিরুদ্ধে লালবাগ থানায় অবৈধভাবে সম্পদ অর্জনের অভিযোগে মামলা করে দুদক। এ মামলায় ২০০৮ সালের ২৭ এপ্রিল দুটি ধারার একটিতে ১০ বছর এবং একটিতে তিন বছর করে মোট ১৩ বছরের কারাদণ্ড দেয় বিচারিক আদালত।
২০০৯ সালের ২৫ অক্টোবর এ রায়ের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে আপিল করেন হাজী সেলিম। এরপর ২০১১ সালের ২ জানুয়ারি হাইকোর্ট এক রায়ে তার সাজা বাতিল করে।
পরবর্তীতে হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করে দুদক। ওই আপিলের শুনানি শেষে ২০১৫ সালের ১২ জানুয়ারি হাইকোর্টের রায় বাতিল করে পুনরায় হাইকোর্টে শুনানির নির্দেশ দেয় আপিল বিভাগ।
দীর্ঘ শুনানি শেষে গত বছরের ৯ মার্চ রায় ঘোষণা করে হাইকোর্ট।