চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের পূর্ণাঙ্গ কমিটি নিয়ে চলছে তোড়জোড়। তবে কমিটিতে ‘পদ ভাগাভাগি’ নিয়ে এরই মধ্যে সংঘর্ষে জড়িয়েছেন শাখা ছাত্রলীগের একই গ্রুপের সাবেক দুই নেতা।
রাজধানীর একটি আবাসিক হোটেলে শুক্রবার বিকেলে শাখা ছাত্রলীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক ও বিজয় গ্রুপের নেতা মো. ইলিয়াসকে মারধর করা হয়। অভিযোগ আছে, তাকে মারধর করেন একই গ্রুপেরই সাবেক নেতা ও শাখা ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক এইচ এম ফজলে রাব্বী সুজন। সুজন বর্তমানে যুবলীগের রাজনীতি করছেন এবং মহানগর যুবলীগের পদপ্রত্যাশী।
মারধরের ঘটনায় একটি সিসিটিভির দুটি ফুটেজ নিউজবাংলার হাতে এসেছে। সেখানে দেখা যায়, পাঞ্জাবি পরা ছাত্রলীগ নেতা সুজন বেশ কয়েকজন নিয়ে হোটেলের রেস্টুরেন্টে যান। সেখানে খাবার টেবিলে নীল টি-শার্ট পরা আরেক নেতা ইলিয়াস বসে ছিলেন। ফুটেজের শুরুতে দেখা যায়, সুজন ও তার অনুসারীরা ইলিয়াসের কাছে যান। পরে তাকে রিসিপশনের কাছে ডেকে নেয়া হয়। এ সময় সুজনের অনুসারীরা ইলিয়াসকে ধাক্কা দিতে থাকেন। পরে সুজনকে ইলিয়াসের কাঁধে হাত দিয়ে কথা বলতে দেখা যায়।
দ্বিতীয় ফুটেজে দেখা যায়, একপর্যায়ে সুজন ইলিয়াসকে থাপ্পড় মারেন। এর পরই সুজনের সঙ্গে আসা ছেলেরা তাকে মারধর শুরু করেন। সুজন পেছন থেকে ছেলেদের সামনে এগিয়ে দেন।
ছাত্রলীগ সূত্রে জানা যায়, সুজন ও ইলিয়াস দুজনই শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফলের অনুসারী। নেতৃত্বের দ্বন্দ্ব ও অভ্যন্তরীণ কোন্দলের কারণে সুজন বিজয় গ্রুপ থেকে ছিটকে পড়েন। ক্যাম্পাস ছেড়ে শহরে যুবলীগের রাজনীতি শুরু করেন তিনি। তবে তার অনুসারী অনেক কর্মী এখনও বিজয় গ্রুপে আছেন। দুজনই একই নেতার (নওফেল) অনুসারী হওয়ায় বর্তমান কমিটিতে পদ ভাগাভাগি নিয়ে সুজন ও ইলিয়াসের মধ্যে দ্বন্দ্ব চলছে। সুজন পক্ষের অনুসারীদের বক্তব্য, ইলিয়াস ইচ্ছা করে তাদের বঞ্চিত করার চেষ্টা করছেন। অন্যদিকে ইলিয়াস পক্ষের অনুসারীদের বক্তব্য, সুজন ক্যাম্পাস রাজনীতি ছাড়ার পরও কমিটি নিয়ে হস্তক্ষেপ করছেন। এ ছাড়া তাদের অভিযোগ, চট্টগ্রাম মহানগর যুবলীগের রাজনীতি ও শোডাউনেও সুজন ক্যাম্পাসের ছেলেদের ‘ব্যবহার’ করছেন। তবে দুই পক্ষের অনুসারীরা কমিটি ও নিজের নিরাপত্তার স্বার্থে কেউ সংবাদমাধ্যমে নাম প্রকাশ করতে চাননি।
পূর্ণাঙ্গ কমিটি নিয়ে চবি ছাত্রলীগের বিভিন্ন গ্রুপের নেতারা ইতোমধ্যে রাজধানীতে অবস্থান করছেন। সেখানে প্রায় ১০ দিন ধরে আছেন ছাত্রলীগ নেতা ইলিয়াস। আছেন মহানগর যুবলীগে পদপ্রত্যাশী সুজনও।
মারধরের শিকার ছাত্রলীগ নেতা মো. ইলিয়াসের সঙ্গে ফোনে বেশ কয়েকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হয়েছে। তবে তিনি কল রিসিভ করেননি। কল রিসিভের জন্য মেসেঞ্জারে বার্তা পাঠালে তিনি বলেন, রোববার বিকেলে কল দিয়ে সবার সঙ্গে যোগাযোগ করা হবে।
ছাত্রলীগ নেতা মো. ইলিয়াস ঢাকার শাহবাগ থানায় সুজনসহ ছয়জনের নাম উল্লেখ করে একটি অভিযোগ করেছেন। বাকিরা হলেন মো. সোহেল, মো. নোমান, এস এম মেহরাজ, আলমগীর ও রাজেশ চৌধুরী। অভিযোগের একটি কপি নিউজবাংলার হাতে এসেছে। সেখানে অজ্ঞাতপরিচয় হিসেবে চার-পাঁচজন উল্লেখ করা হয়।
অভিযোগপত্রে তিনি বলেন, শাহবাগ থানার তোপখানা রোডের হোটেল রয়েল প্যালেসের ষষ্ঠতলার ৬০৯ নম্বর রুমে ইলিয়াস অবস্থান করছিলেন। পূর্বশত্রুতার জেরে সুজন ও তার অনুসারী কয়েকজন গত ২০ মে রাত সাড়ে ৩টার সময় বেআইনিভাবে প্রবেশ করে রুমের দরজা ভাঙার চেষ্টা করেন। তাকে গালাগাল করলে আতঙ্কিত হয়ে তিনি রুমের ইন্টারকমের মাধ্যমে ফোন করেন। তখন হোটেল কর্তৃপক্ষ তার রুমের সামনে এসে তাদের (সুজন ও তার অনুসারীদের) সরিয়ে দেন। এরপর হোটেল কর্তৃপক্ষ তার রুম পরিবর্তন করে পঞ্চম তলার ৫১০ নম্বর রুমে নিয়ে যান।
একই দিন বিকেল অনুমান সাড়ে ৪টার সময় হোটেলের রেস্টুরেন্টে খেতে বসলে তাকে হত্যার উদ্দেশ্যে গলা চেপে ধরে এলোপাতাড়িভাবে কিলঘুষি, লাথি মারা হয়। এতে তিনি গুরুতর আহত হন। এ সময় ফজলে রাব্বী সুজন তার iphone12 Promax, যার বাজারমূল্য ১ লাখ ২০ হাজার টাকা এবং আরেকজন তার সামসাং এ সেভেন্টি ওয়ান মডেলের সেট আছাড় মেরে ভেঙে ফেলেন।
পরে হোটেল কর্মচারীরা তাকে উদ্ধার করেন ও তার বন্ধু জাহিদুল আউয়ালের সহায়তায় তিনি ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের জরুরি বিভাগে প্রাথমিক চিকিৎসা নিতে যান।
বক্তব্যের জন্য বিজয় গ্রুপের আরেক নেতা ও শাখা ছাত্রলীগের সাবেক অর্থ সম্পাদক জাহেদুল আওয়ালের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি প্রথমে বিষয়টি অস্বীকার করেন। পরে সিসিটিভি ফুটেজ ও জিডির কথা উল্লেখ করলে মিটিং শেষ করে কথা বলবেন বলে জানান। এরপর বেশ কয়েকবার ফোন দিলেও তিনি আর ফোন রিসিভ করেননি।
মারধরের বিষয়টি স্বীকার করে শাখা ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক ফজলে রাব্বী সুজন নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমি নিজে ওকে (ইলিয়াস) রাজনীতিতে আনছি, রাজনীতি শিখিয়েছি। আমি ওকে ছাত্রলীগের সাংগঠনিক সম্পাদক বানিয়েছি। ইলিয়াস আমার ছোট ভাই। আমার ছোট ভাই যদি বেয়াদবি করে বড় ভাইয়ের সঙ্গে, তাকে আমি যেমন স্নেহ করে রাজনীতিতে ওপরে তুলছি, আমি তাকে শাসন করারও অধিকার আছে বলে আমি মনে করি।’
তিনি বলেন, ‘ঢাকাতে আমি যখন ওর সঙ্গে কথা বলছিলাম, তখন সে বাজেভাবে রিঅ্যাক্ট করে। ছোট ভাই হিসেবে বেয়াদবি করেছে, আমার নেতা আমাদের কখনও বেয়াদবি শেখান নাই। বেয়াদবি যারা করবে তাদের কঠিনভাবে দমন করতে হবে। যাতে রাজনৈতিক শিষ্টাচার বজায় থাকে।’
কমিটি নিয়ে দ্বন্দ্ব কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘কমিটি নিয়ে কোনো কিছু না। চবি ছাত্রলীগের কমিটির সঙ্গে আমার কোনো সম্পর্ক নাই। ওই কমিটি তো আমি করব না। আমি আমার সম্মেলন নিয়ে ব্যস্ত। ওকে শাসনের সঙ্গে বিজয় গ্রুপ বা অন্য ব্যাপার জড়িত না।’
এ বিষয়ে শাহবাগ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মওদুত হাওলাদার নিউজবাংলাকে বলেন, ‘এটি একটি হাতাহাতি, মারামারি ঘটনা। আমরা সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করে ব্যবস্থা নেব।’