বাংলাদেশ

মতামত

খেলা

বিনোদন

জীবনযাপন

তারুণ্য

কিড জোন

অন্যান্য

রেস-জেন্ডার

ফ্যাক্ট চেক

স্বাস্থ্য

আন্তর্জাতিক

শিক্ষা

অর্থ-বাণিজ্য

বিজ্ঞান-প্রযুক্তি

আজ দিনটি মৌমাছিদের

  •    
  • ২০ মে, ২০২২ ১৩:২৮

এক পাউন্ড মধু উৎপাদনে মৌমাছিদের প্রায় ২০ লাখ ফুল থেকে মধু সংগ্রহ করতে হয়। আর এর পেছনে এই পতঙ্গগুলোকে পাড়ি দিতে হয় প্রায় ৮০ হাজার কিলোমিটার পথ। একটি মৌমাছি তার জীবদ্দশায় এক চা চামচ পরিমাণ মধু সংগ্রহ করে। আজ বিশ্ব মৌমাছি দিবস।

মৌমাছিদের আমরা কেবল মধু সংগ্রহকারী পতঙ্গ হিসেবে দেখি। আমরা ভুলে যাই, মধু সংগ্রহ করতে গিয়ে মৌমাছি অনেক শস্য এবং ফলমূলের পরাগায়ন ঘটিয়ে এগুলোর ফলন টিকিয়ে রেখেছে। মানবজাতির খাদ্য উৎপাদনব্যবস্থা মৌমাছি এবং এ ধরনের আরও অনেক পতঙ্গনির্ভর।

বিজ্ঞানী আইনস্টাইন একদা বলেছিলেন, ‘যদি মৌমাছি পৃথিবী থেকে বিদায় নেয়, তবে মানুষের জীবন পরবর্তী চার বছরে শেষ হয়ে যাবে।’

এ অত্যাবশ্যকীয় পতঙ্গটির প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশের দিন আজ। আজ বিশ্ব মৌমাছি দিবস।

১৭৩৪ সালের ২০ মে মৌমাছিবিশারদ অ্যান্টন জ্যাংজারের জন্মদিন। স্লোভেনিয়ার ব্রেঞ্জিকা গ্রামে তার জন্মদিনেই দেশটির প্রেসিডেন্টের উপস্থিতিতে প্রথম মৌমাছি দিবস উদযাপন করা হয়। সেই থেকে প্রতিবছর ২০ মে বিশ্ব মৌমাছি দিবস হিসেবে উদযাপিত হয়ে আসছে। জাতিসংঘও এ দিনটি উৎসর্গ করেছে মৌমাছিদের জন্য।

মানবজীবনকে টিকিয়ে রাখার নেপথ্যে রয়েছে মৌমাছির বিরামহীন পরিশ্রম। কীটতত্ত্ববিদদের মতে, এই মধুকররা তাদের বিচরণ এলাকার পুরো শস্যক্ষেত্র ছাড়াও চারপাশের গাছপালার ফুলে ফুলে প্রতি সেকেন্ডে ২০০ বার জাদুকরী পাখা নেড়ে ও শুঁড় বসিয়ে পরাগায়নে ভূমিকা রাখে।

মৌমাছি নিজেদের বসবাসের জন্য তৈরি করে মৌচাক। একটি মৌচাকে যত মৌমাছি বাস করে, তার চারপাশে ৪ বর্গকিলোমিটারের মধ্যে যত ফুল ফোটে, এক দিনে সেগুলোতে ঘুরে ঘুরে মধু সংগ্রহ ও পরাগায়ন করতে সাহায্য করে এসব মৌমাছি। এর ফলে বিভিন্ন শস্য ও ফলফলাদির উৎপাদন অব্যাহত থাকে।

বিশ্ব মৌমাছি দিবসের উদ্দেশ্য হলো, পৃথিবীতে মৌমাছিসহ অন্য যেসব পতঙ্গ পরাগায়নে ভূমিকা রাখছে, সেসব প্রাণীকে বিলুপ্তির হাত থেকে রক্ষায় জনসচেতনতা সৃষ্টি করা। তবে আজ দেশের কোথাও সরকারি কিংবা বেসরকারিভাবে দিনটি পালনে কোনো কর্মসূচির তথ্য পাওয়া যায়নি।

যেভাবে মৌমাছি পালনের সূচনা

মৌমাছি সামজবদ্ধ পতঙ্গ হলেও খ্রিষ্টের জন্মের ৬ হাজার বছর আগের শিলালিপিতে মৌমাছি পালনের ইতিহাস পাওয়া যায়। ব্যাবিলনীয় সাম্রাজ্যে অর্থাৎ খ্রিষ্টপূর্ব চতুর্থ সহস্রাব্দের শেষে ও তৃতীয় সহস্রাব্দের শুরুতে বিপুলভাবে মৌমাছি পালন করা হতো।

মৌমাছি চাষের ইতিহাস অনেক প্রাচীন হলেও পদ্ধতিগতভাবে প্রথম ১৬৩৮ সালে যুক্তরাষ্ট্রে মৌমাছি চাষ শুরু হয়। পরবর্তী সময়ে ১৮৪০ সালে ‘মোস্সে কুইনবি’ নামে এক বিজ্ঞানী মৌচাষ শুরু করেন। ১৮৫১ সালে আধুনিক পদ্ধতিতে মৌচাষ শুরু করেন ল্যাংস্ট্রোথ নামক আরেক বিজ্ঞানী যাকে আধুনিক মৌচাষের জনক বলা হয়।

ভারতবর্ষে আধুনিক পদ্ধতিতে মৌমাছি পালন কার্যক্রম শুরু হয় ১৮৮৩ সালে। বাংলাদেশে আকতার হামিদ খান ১৯৬১ সালে কুমিল্লার পল্লী উন্নয়ন একাডেমিতে প্রথম মৌচাষ শুরু করেন। এরপর ১৯৬৩ সালে সাতক্ষীরায় বিসিক প্রথম মৌচাষের উদ্যোগ নেয় এবং এখনও বিসিকের এ প্রচেষ্টা অব্যাহত আছে, যা সারা দেশে বিস্তৃত হয়েছে। বিসিকের প্রচেষ্টার সাথে পরবর্তীতে আশির দশকে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরও সম্পৃক্ত হয় এবং এর মাধ্যমে বর্তমানে মৌপালন সম্প্রসারণে ব্যাপক উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।

উদ্ভিদের ৮০ শতাংশ পরপরাগায়ন মৌমাছিতে

কৃষি তথ্য সার্ভিসের (এআইএস) তথ্য মতে, প্রতিদিন আমরা যে খাবার খাই, তার তিন ভাগের এক ভাগ আসে মৌমাছির পরাগায়ন থেকে। অন্যদিকে, কীটপতঙ্গের মাধ্যমে যেসব উদ্ভিদের পরপরাগায়ন হয়, তাতে শুধু মৌমাছির অবদান ৮০ শতাংশ। এ ছাড়া বর্তমানে মানুষ খাবার হিসেবে যেসব ফলমূল, শাকসবজির ওপর বেশি নির্ভরশীল, সেগুলোর ৭০ শতাংশ উৎপন্ন হয় মৌমাছির পরাগায়নের মাধ্যমে। পৃথিবীতে প্রতি বছরে যে পরিমাণ খাদ্য মৌমাছির পরাগায়নের মাধ্যমে উৎপাদিত হয় সেগুলোর আর্থিক মূল্য আনুমানিক ২২ হাজার কোটি ডলার। এ অর্থনীতির সঙ্গে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে জড়িয়ে আছে বিশ্বব্যাপী ১৪০ কোটি মানুষের জীবিকা।

যেভাবে মধু সংগ্রহ করে মৌমাছি

শস্য, ফলদ ও বনজ সব গাছের ফুল থেকেই মধু সংগ্রহ করে মৌমাছি। দেশে প্রাকৃতিকভাবে মধুর বড় একটি উৎস সুন্দরবন। এখানে কেওড়া ও খলিসা ফুল মৌমাছিদের প্রথম পছন্দ।

শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের কীটতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক ড. এস এম মিজানুর রহমান নিউজবাংলাকে জানান, প্রাকৃতিক পরিবেশে মৌচাকে মৌমাছির বসবাস। তবে আধুনিক ও বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে তাদের প্রাকৃতিক পরিবেশ থেকে এনে মৌচাকের উপযোগী পরিবেশ সৃষ্টি করে পালন করা হয়। একে বলে মৌচাষ বা মৌমাছি পালন। এই মৌমাছিরা ঘন ঘন পাখা নেড়ে ফুলে ফুলে শুঁড় বসিয়ে মধু ও পরাগ রেণু সংগ্রহ করে। এরপর তা চাকে এনে জমা করে তারা মধু উৎপাদন করে।

তিনি জানান, গবেষণায় দেখা গেছে, মৌমাছি পরাগায়ন ঘটিয়ে বনজ, ফলদ ও কৃষিজ ফসলের উৎপাদন ২৫ থেকে ৩০ ভাগ পর্যন্ত বাড়িয়ে দেয়। ফসলের মাঠে কীটপতঙ্গ দ্বারা পরাগায়ন অধিক কার্যকর। এ কারণে বীজ ও ভালো ফসল উৎপাদনে মৌমাছির পরাগায়ন অত্যাবশ্যক।

মৌ বিজ্ঞানীদের মতে, এক পাউন্ড মধু উৎপাদনে মৌমাছিদের প্রায় ২০ লাখ ফুল থেকে মধু সংগ্রহ করতে হয়, যার জন্য প্রায় ৮০ হাজার কিলোমিটার পথ অতিক্রম করতে হয়। একটি মৌমাছি তার জীবদ্দশায় এক চা চামচ পরিমাণ মধু সংগ্রহ করে। মধু ছাড়াও মৌমাছি থেকে পাওয়া অন্যান্য পণ্যের মাঝে রয়েছে মোম, প্রোপোলিস, রাজকীয় জেলি, মৌবিষ ইত্যাদি।

মৌবাক্সে মৌমাছি পালন বাড়ছে

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মো. বেনজির আলম নিউজবাংলাকে বলেন, দেশের ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার জন্য খাবারের জোগান দিতে প্রয়োজন বাড়তি উৎপাদন। মৌমাছির সহায়তা ছাড়া এই বাড়তি উৎপাদন সম্ভব নয়। আমরা যদি তেল সংকট কাটাতে সরিষার আবাদ বাড়াতে চাই, চালের ঘাটতি দূর করতে ধানের আবাদ বাড়াতে চাই, এভাবে সব ধরনের খাদ্যশস্য, ফলদ শস্য, বনজ শস্যের উৎপাদন বাড়াতে চাই, তাহলে আমাদের মৌমাছি পালন বাড়াতে হবে। আর মৌমাছির জীবন হুমকির মুখে পড়লে মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাত্রাও হুমকির মুখে পড়বে। সে ধরনের পরিস্থিতি এড়াতে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর দেশে মৌ চাষকে প্রকল্পের মাধ্যমে এনে তা বিস্তারে উৎসাহিত করছে।

বেনজির আলম বলেন, মধু ও অন্যান্য পণ্যের উৎপাদন বাড়িয়ে রপ্তানি করা সম্ভব। মধু ও মৌপণ্যভিত্তিক শিল্প প্রতিষ্ঠায় প্রত্যক্ষ ভূমিকা পালনের মাধ্যমে কর্মসংস্থান বৃদ্ধি পাবে এবং জৈব বৈচিত্র্য ও প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষা হবে।

বিসিক জনসংযোগ কর্মকর্তা আব্দুল বারিক জানান, মৌমাছি পালন করার মাধ্যমে একদিকে যেমন দারিদ্র্য বিমোচন ঘটছে, তেমনি মৌমাছির সহায়তায় পরাগায়নের মাধ্যমে ফসলের উৎপাদন বাড়ছে। তা ছাড়া বাংলাদেশের ভৌগোলিক এলাকায় বসবাসরত মৌমাছি থেকে পাওয়া মধু বেশি মিষ্টি। এর চাহিদাও ব্যাপক।

বিসিকের উদ্যোগে দেশে প্রথম ১৯৭৭ সালে বাগেরহাট জেলার যাত্রাপুরে কাঠের বাক্সে দেশীয় মৌমাছির জাত ‘ফেরেনা’ চাষ শুরু হয়। এতে সাফল্য অর্জন করায় বিসিক পরবর্তীকালে আরও ছয়টি জেলায় স্থায়ী সেন্টার তৈরি করে। এই সেন্টারগুলোতে মানুষের প্রশিক্ষণ, ব্যাপক প্রচারণা ও বিভিন্ন মেলা আয়োজনের মাধ্যমে মানুষকে বাণিজ্যিকভাবে মধু চাষে উৎসাহিত করা হয়।

ছোট-বড় মিলিয়ে ৭০টির বেশি প্রতিষ্ঠান বোতলে করে এখন মধু বাজারজাত করছে। এ ছাড়া বিসিক মৌমাছি পালন কর্মসূচি নামক স্থায়ী প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর আওতায় উদ্যোক্তাদের আধুনিক বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে মৌ চাষ ও মধু উৎপাদনের ওপর প্রশিক্ষণ ও সহায়তাও প্রদান করছে। বর্তমানে ছয়টি মৌমাছি উৎপাদন কাম প্রদর্শনী কেন্দ্র ও ৬৪ জেলায় স্থাপিত বিসিক কার্যালয়ের মাধ্যমে মৌ পালন কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। এতে প্রতি বছর নতুন নতুন চাষি মৌ চাষে অন্তর্ভুক্ত হচ্ছেন।

তিনি আরও জানান, ২০২০-২১ অর্থবছরে বিসিক এলাকায় মোট ৪ হাজার ৬২২ টন মধু উৎপাদিত হয়েছে। ২০১৯-২০ অর্থবছরে এই উৎপাদন ছিল ২ হাজার ৭৬৬ টন।

কৃষক পর্যায়ে উন্নতমানের ডাল, তেল ও মসলা বীজ উৎপাদন, সংরক্ষণ (তৃতীয় পর্যায়) প্রকল্পের উপপরিচালক ও কৃষিবিদ ড. ফ. ম. মাহবুবুর রহমান জানান, আগে মৌমাছির মাধ্যমে বাক্স পদ্ধতিতে মধু চাষের বিষয়ে বাংলাদেশের কৃষকদের ধারণা স্পষ্ট ছিল না। তাই মধুভিত্তিক শস্য সরিষা, তিল, তিসি, লিচু ইত্যাদির কৃষিজ উৎপাদন বাড়াতে মৌ চাষ এবং মৌ চাষের উপকারিতা সম্পর্কে স্থানীয় কৃষি অফিস ও সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর মাধ্যমে কৃষক পর্যায়ে ব্যাপক প্রচারণা ও প্রশিক্ষণ দেয়া হচ্ছে।

সরকার ২০১২-১৭ মেয়াদে একটি প্রকল্প হাতে নেয়। এ প্রকল্পের আওতায় মৌ চাষ সম্পর্কে প্রশিক্ষণ এবং মৌচাষিদের সহজ শর্তে ও সরল সুদে ঋণ দেয়া হয়।

মধুশিল্প দেশে কতটা বিস্তৃত

বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশন (বিসিক) ও কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের (ডিইএ) তথ্য মতে, বর্তমানে দেশে আড়াই হাজার বাণিজ্যিক বা পেশাদার মৌ খামার রয়েছে। অপেশাদার বা শৌখিনভাবে মৌ পালন করছে আরও ২৫ হাজার। তবে ১ হাজার ১৫১ জন সক্রিয় মৌ খামারি মৌ পালনের সাথে সম্পৃক্ত। চাষি ছাড়াও বিভিন্নভাবে মধুশিল্পে কর্মরত প্রায় ২ লাখ মানুষ। বেসরকারি মধু প্রক্রিয়াকরণ কেন্দ্র রয়েছে সাতটি এবং সরকারিভাবে আছে একটি।

২০২০-২১ অর্থবছরে দেশে ১১ হাজার ৪০০ টন এবং ২০১৯-২০ অর্থবছরে ১০ হাজার টন মধু উৎপাদন হয়েছে। চলতি অর্থবছরে ১৩ হাজার টন মধু উৎপাদনের লক্ষ্য রয়েছে।

দেশে যত মধু উৎপাদন হয় তা অভ্যন্তরীণ চাহিদা মিটিয়ে কিছু পরিমাণ বিদেশেও রপ্তানি হয়। ভারত, জাপান ও মধ্যপ্রাচ্যসহ বেশ কিছু দেশে এই মধু রপ্তানি হচ্ছে। ২০১৯ সালে দেশ থেকে মধু রপ্তানির পরিমাণ ছিল ৫০০ টন।

বর্তমানে সারা দেশে মৌ চাষের আওতায় জমির পরিমাণ ৮৯ হাজার ৩৭ হেক্টর। এসব জমিতে ২ হাজার মৌ খামার ও ৫৬ হাজার ৬৮৮টি মৌবাক্স স্থাপিত রয়েছে। প্রকল্পের তত্ত্বাবধানে নতুন-পুরোনো মিলিয়ে আরও ৭০ হাজার কৃষককে মৌ চাষের সাথে সম্পৃক্ত করা হচ্ছে।

আধুনিক প্রযুক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে মৌ চাষে আগ্রহীর সংখ্যা দ্বিগুণ করা গেলে মধু উৎপাদন কয়েক গুণ বাড়ানো সম্ভব।

এ বিভাগের আরো খবর