যুক্তরাজ্যের লন্ডনের বার্নেট হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন প্রখ্যাত সাংবাদিক, লেখক ও অমর একুশে গানের রচয়িতা আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী। তাকে সেখানে দেখতে গিয়েছিলেন প্রবাসী বিপ্লব বহ্নি রায় চৌধুরী। শুক্রবার (২০ মে) হাসপাতাল থেকে লন্ডনের নিজ বাসায় ফেরার আশাও প্রকাশ করেছিলেন গাফ্ফার চৌধুরী। তবে বাসায় আর ফেরা হয়নি তার।
গাফ্ফার চৌধুরীর স্মৃতিচারণা করে বৃহস্পতিবার রাতে নিউজবাংলাকে এসব কথা জানিয়েছেন বিপ্লব। তিনি লন্ডনের রোমফোর্ডের গিদেয়াপার্কে থাকেন পরিবার নিয়ে। আর বাংলাদেশে তার বাড়ি বরিশালের বাকেরগঞ্জের শ্যামপুরে। তিনি মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক কুমুদ বন্ধু রায় চৌধুরীর ছেলে।
বিপ্লব বলেন, “১৩ মে স্থানীয় সময় বেলা ২টায় বার্নেট হাসপাতালে যাই আমি। হাসপাতালের জুনিপার ওয়ার্ডের ১৭ নম্বর বেডের কাছে গিয়ে প্রথমে কাকাকে (আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী) দেখতে পাইনি। প্রথমে ভাবছিলাম কাকা হয়তো কোথাও গিয়েছেন বা কোথাও নিয়ে গেছে। অনেকক্ষণ অপেক্ষার পরেও তাকে না পেয়ে হাসপাতালের স্টাফদের কাছে জিজ্ঞাসা করে জানলাম বেডের চাদর মুড়ি দিয়ে কাকা শুয়ে আছেন। আমি ডাকতেই চাদরটা মুখ থেকে সরিয়ে তাকালেন তিনি। আমাকে দেখে খুশি হয়ে বলেছিলেন ‘তুমি এসেছো’।”
গাফ্ফার চৌধুরীর মেয়ে বিনীতা চৌধুরীর মৃত্যুর পর তিনি খুব ভেঙে পড়েছিলেন বলে জানান বিপ্লব। বলেন, ‘কাকাকে দেখাশোনার দায়িত্বে ছিলেন ঝর্ণা নামে এক নারী। তিনি চলে যাওয়ার পর বিনীতা দিদিই তাকে দেখাশোনা করতেন। ক্যানসারে এপ্রিল মাসে মারা যান বিনীতা দিদি। দিদি মারা যাওয়ার পর কাকা পুরোপুরি ভেঙে পড়েন। দিদিকে হারানোর শোকে খুবই মানসিক কষ্টে ছিলেন তিনি। সেদিন অনেক কথাই বলছিলেন তিনি বিভিন্ন প্রসঙ্গে। কিন্তু দিদির কথা বলছিলেন বারবার।’
বিপ্লব বলেন, “আমার পরিবারের সবার খোঁজখবর নিতে শুরু করলেন কাকা। আমার বাবা-কাকাদের কথা বলেছিলেন। আমার মা কেমন আছেন, বাড়িতে কে কে আছেন- জিজ্ঞাস করছিলেন। তিনি গত বছর বলেছিলেন আমি যখন বরিশালে যাব তখন তিনিও আমার সঙ্গে যাবেন। আমাদের বাড়িতে যাওয়ার কথা ছিল তার। কিন্তু তা আর হলো না।
“আমার পরিবারের খোঁজ নেয়া শেষে আমাকে কাকা বললেন, ‘শুক্রবার আমি বাসায় ফিরব, তুমি রোববার বাসায় এসো। আমাকে তো হাসপাতাল থেকে ছাড়ছে না। শরীরটা এখন আগের চেয়ে ভালো। আমার মেয়েটা আর বাসায় নেই। আমি গিয়ে কী করব একা বাসায়। তুমি বাসায় এসো, অনেক কথা আছে’।”
বিপ্লব বলেন, ‘আমার স্ত্রী-মেয়েকে নিয়েও যেতে বলেছিলেন তিনি। বলেছিলেন, একটু সময় নিয়ে আমার বাবাকে নিয়ে একটা কলাম লিখবেন। কিন্তু শুক্রবার আর ফেরা হলো না তার। রোববার আর দেখাও হলো না আমাদের।
‘হাসপাতালে দেখা করার জন্য আমার নির্ধারিত সময় শেষ হয়ে ১০/১৫ মিনিট বেশি হয়ে যাওয়ায় স্টাফরা বারবার এসে রিমাইন্ডার দিচ্ছিলেন। কাকার সঙ্গে কথা বলার ফাঁকে হাসপাতালের নিষেধ থাকা সত্ত্বেও একটি ছবি তুলেছিলাম। কাকার কাছ থেকে আশীর্বাদ নিয়ে হাসপাতাল থেকে বেরিয়ে আসি।’
বিপ্লব বলেন, ‘২০২১ সালের ২১ মার্চ বিকেলে গাফ্ফার কাকার বাসায় গিয়েছিলাম। তখন আমি একটি কবিতার বই লেখার ইচ্ছার কথা বলি কাকাকে। তখন কাকা আমাকে উৎসাহ দিয়ে আমার বইয়ের জন্য মুখবন্ধ অংশটুকু লিখে দিয়েছিলেন। সেদিনের পর কাকার সঙ্গে আরও বেশ কয়েকবার দেখা করেছিলাম। শেষবার যখন হাসপাতালে গিয়েছিলাম তাকে দেখতে, ফেরার আগে তিনি বইয়ের কথা জিজ্ঞাস করেছিলেন। বলেছিলাম কাজ চলছে কাকা, প্রকাশ পেলে আপনাকেই প্রথম কপি দেব।
‘রোববারের জন্য অপেক্ষা করছিলাম মেয়ে-বউ সবাইকে নিয়ে কাকার বাসায় যাব। কিন্তু অপেক্ষার ইতি টানতে হলো তিন দিন আগেই।’
লন্ডনে স্থানীয় সময় বৃহস্পতিবার সকাল ৬টা ৪০ মিনিটে আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী মারা যান।
আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর মৃত্যুতে তার জন্মস্থান বরিশালের মেহেন্দিগঞ্জের উলানিয়ায় শুক্রবার মসজিদে দোয়া মোনাজাত ও মন্দিরে প্রার্থনার আয়োজন করা হয়েছে।