ডিজিটাল ডিভাইসের মাধ্যমে কেন্দ্রে পরীক্ষার্থীর সঙ্গে সংযুক্ত থেকে প্রশ্ন জেনে সঠিক উত্তর বলে দেয়া হতো। তা শুনে শুনে উত্তর লিখে দিয়ে আসতেন পরীক্ষার্থীরা। আর এজন্য নির্দিষ্ট অর্থের চুক্তি হতো তাদের সঙ্গে।
দেশের বিভিন্ন সরকারি নিয়োগ পরীক্ষায় দীর্ঘদিন ধরে এমন ডিজিটাল জালিয়াতি করে আসছিল একটি চক্র। অবশেষে চক্রের মূল হোতাসহ চারজনকে গ্রেপ্তার করেছে র্যাব।
কারওয়ানবাজারে র্যাব মিডিয়া সেন্টারে বৃহস্পতিবার দুপুরে এক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন।
গ্রেপ্তাররা হলেন- চক্রের মূলহোতা মো. ইকবাল হোসেন, তার তিন সহযোগী রমিজ মৃধা, মো. নজরুল ইসলাম ও মো. মোদাচ্ছের হোসেন।
তিনি বলেন, ‘আগামী ২০ মে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষা রয়েছে। এজন্য প্রতারক চক্রগুলো তাদের তৎপরতা বাড়ায়। র্যাবও এ বিষয়ে নজরদারি বাড়ায়। এরই ধারাবাহিকতায় প্রাথমিকের নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস ও ডিজিটাল জালিয়াতি চক্রের মূলহোতাসহ চারজনকে গ্রেপ্তার করা হয়।’
তিনি জানান, তাদের কাছ থেকে বেশ কিছু ডিজিটাল ডিভাইস ও নগদ অর্থ জব্দ করা হয়।
খন্দকার আল মঈন জানান, গ্রেপ্তাররা প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে জানান, প্রথমে তারা বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি নিয়োগ পরীক্ষা সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করেন। পরে ওই নিয়োগ পরীক্ষা নেয়ার স্থান ও পরীক্ষার গার্ড সম্পর্কে তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করেন। এ সময় চক্রের অন্য সদস্যরা দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের সরকারি-বেসরকারি চাকরিপ্রত্যাশীদের খুঁজে বের করে ১০-১৫ লাখ টাকার বিনিময়ে পরীক্ষায় পাস ও চাকরি পাইয়ে দেয়ার নিশ্চয়তার কথা বলে তাদের প্রলোভন দেখান।
আগ্রহী পরীক্ষার্থীদের ডিজিটাল ডিভাইসগুলো দিয়ে এর ব্যবহারবিধি প্রশিক্ষণ দিয়ে প্রাথমিকভাবে এক-দুই লাখ টাকা জামানত হিসেবে নেয়া হয়। অবশিষ্ট টাকা চাকরি পাওয়ার পর পরিশোধ করা হবে বলে চুক্তি করা হয়। এভাবে তারা গত কয়েক বছর ধরে বিভিন্ন চাকরিপ্রার্থীর কাছ থেকে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নেন বলে জানায় র্যাব।
গ্রেপ্তারদের সম্পর্কে র্যাব জানায়, প্রতারক চক্রটির মূলহোতা ইকবাল হোসেন ২০০৮ সালে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পান। তিনি নিজ এলাকায় শিক্ষকতা করার সময় ২০১৫ সালে একই এলাকার অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মচারী আলতাফ হোসেনের সঙ্গে পরিচয় হয়। তার কাছ থেকে বিভিন্ন নিয়োগ পরীক্ষায় উত্তীর্ণের নিশ্চয়তা দিয়ে মোটা অংকের টাকা হাতিয়ে নেয়ার বিষয়টি রপ্ত করেন। পরে করোনা মহামারির সময় আলতাফ মারা গেলে ইকবাল প্রতারক চক্রটি পরিচালনা শুরু করেন। তার বিরুদ্ধে সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়া থানায় নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে মামলা ও বেশ কয়েকটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি) রয়েছে।
গ্রেপ্তার রমিজ এই প্রতারক চক্রের অন্যতম সহযোগী এবং একটি হত্যা মামলার পলাতক আসামি বলে জানায় র্যাব। গ্রেপ্তার এড়াতে পালিয়ে থাকাকালে ২০২০ সালে ইকবালের সঙ্গে তার পরিচয় হয়। পরে ইকবাল বিভিন্ন নিয়োগ পরীক্ষায় সহযোগিতা করার কথা বলে তাকে এই চক্রের সদস্য করে নেন।
গ্রেপ্তার রমিজ র্যাবকে জানান, যখন কোনো সরকারি নিয়োগ পরীক্ষা হতো তারা তখন পরীক্ষার্থীদের তাদের ডিজিটাল ডিভাইসগুলো দিতেন। পরে পরীক্ষার সময় তারা বাইরে অবস্থান নিয়ে রমিজের পরিচিত কিছু মেধাবী ছাত্রের মাধ্যমে দ্রুত উত্তরপত্র তৈরি করে পরীক্ষার হলে ওই সব ডিজিটাল ডিভাইসের মাধ্যমে জানিয়ে দেয়া হতো।
গ্রেপ্তার নজরুল ১৯৯৪ সালে সমাজসেবা অধিদপ্তরে অফিস সহকারী-কাম কম্পিউটার অপারেটর পদে যোগ দেন। নজরুল এবং রমিজের বাড়ি পাশাপাশি। চাকরিসূত্রে দেশের বিভিন্ন এলাকার মানুষের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে ওঠে নজরুলের। এ সুযোগে তিনি দেশের বিভিন্ন এলাকার মানুষকে চাকরি দেয়ার কথা বলে চাকরিপ্রার্থীদের ইকবাল ও রমিজের সঙ্গে যোগাযোগ করিয়ে দিতেন বলে জানায় র্যাব।
নজরুল র্যাবকে জানান, বিভিন্ন নিয়োগ পরীক্ষার সময়, স্থান ও পরীক্ষার গার্ডকে খুঁজে বের করার দায়িত্ব ছিল তার।
গ্রেপ্তার মোদাচ্ছের মেহেরপুর জেলার মুজিবনগর উপজেলার সমাজসেবা কার্যালয় থেকে ২০১৯ সালে অবসর নেন। তিনি ইকবালের ঘনিষ্ঠ সহযোগী হিসেবে কাজ করতেন।
তিনি সরকারি বিভিন্ন দপ্তরে চাকরি দেয়ার কথা বলে চাকরিপ্রার্থীদের খুঁজে বের করতেন। পরে ইকবাল ও রমিজের সঙ্গে তাদের যোগাযোগ করিয়ে দিতেন।
গ্রেপ্তারদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা প্রক্রিয়াধীন রয়েছে বলে জানিয়েছে র্যাব।