ছাত্রলীগকর্মীদের বিরুদ্ধে টাকা না দিয়ে জোর করে জামা নিয়ে যাওয়ার অভিযোগ করেছেন রাজধানীর শাহবাগের আজিজ কো-অপারেটিভ সুপার মার্কেটের ব্যবসায়ীরা।
ঘটনা ঈদের আগের। মূলত বিষয়টি আলোচনার বাইরে থেকে যায় সে সময়ে ঢাকা কলেজ শিক্ষার্থী ও নিউ মার্কেট ব্যবসায়ীদের মধ্যে সংঘর্ষ ও হতাহতের ঘটনায়।
আজিজ সুপার মার্কেটের ছয়টি দোকান থেকে অর্ধ লাখ টাকার পোশাক জোর করে নিয়ে যাওয়ার এ অভিযোগ সম্প্রতি প্রকাশ করেন ব্যবসায়ীরা, তবে তারা মামলা করেননি।
ছাত্রলীগ কর্মীরা দুটি গ্রুপে ভাগ হয়ে আজিজ সুপার মার্কেটের ছয়টি দোকানে চাঁদাবাজির ঘটনা ঘটায় বলে জানান ব্যবসায়ীরা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৯ শিক্ষার্থীর বিরুদ্ধে এ অভিযোগ নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন নিশ্চুপ। অভিযুক্তরা সবাই হল ছাত্রলীগের রাজনীতিতে জড়িত থাকলেও তাদের ‘কর্মের’ দায় নিতে রাজি নন নেতারা। লিখিত অভিযোগ পাননি জানিয়ে তারা প্রসঙ্গ এড়িয়ে যাচ্ছেন।
অভিযোগ দীর্ঘদিন গোপন রাখার বিষয়ে ব্যবসায়ীরা জানান, ঈদুল ফিতরের আগে ২১ এপ্রিল রাতে এই তোলাবাজির ঘটনা ঘটে। তখন ঢাকা কলেজ-নিউ মার্কেটের মতো সংঘর্ষের আশঙ্কায় দোকানিরা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষকে অভিযোগ দেননি; মামলাও করেননি। আর সবাই ঈদের ছুটিতে ঢাকার বাইরে থাকায় পরে এ নিয়ে আলোচনা হয়নি।
সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সমালোচনা হলে অনেকে তথ্য যাচাইয়ে আসেন। তখন দোকানিরা ‘প্রকৃত ঘটনা’ তুলে ধরেন।
সেই রাতের বর্ণনা দিয়ে ‘ইজি’ নামের একটি দোকানের এক কর্মকর্তা নিউজবাংলাকে বলেন, ‘রাত আনুমানিক সাড়ে ৯টায় পাঁচ-ছয়জন শোরুমে ঢোকেন। তুই-তোকারি করে কথা বলেন। তারা ১৩টি পোশাক নিয়ে প্যাক করতে বলেন।
‘১৮ হাজার টাকার জিনিস তারা ৪ হাজার ৯০০ টাকায় দিতে বললে আপত্তি জানাই। তখন তারা ঢাকা ভার্সিটির ছাত্রলীগ নেতা বলে দাবি করেন। এরপর প্যাক করা পোশাক বিল না দিয়েই নিয়ে যান।’
‘ব্যতিক্রম’ শোরুমের এক্সিকিউটিভ অর্ণব অভিযোগ করেন, ছাত্রলীগকর্মীদের কয়েকজন তাদের শোরুম থেকে প্রায় ৫০ হাজার টাকা দামের কাপড় নিয়েছেন টাকা পরিশোধ না করেই।
তিনি বলেন, ‘রাত পৌনে ৯টার দিকে সাত-আটজন এসে দোকানের মালগুলো ঘাঁটাঘাঁটি করেন। তারা একটা একটা করে প্যান্ট দেখে পছন্দ না হলে নিচে ফেলে দেন। যেগুলো পছন্দ হয়, সেগুলো এক পাশে জমা করেন। ২৭ থেকে ২৮ পিস প্যান্টসহ ৫০ থেকে ৬০ হাজার টাকার পণ্য নিয়ে তারা দোকান থেকে বের হয়ে যান। এক টাকাও দেননি।’
কর্মচারীদের গালাগালি করার সময় শিক্ষার্থীরা নিজেদের বঙ্গবন্ধু হলের ছাত্রলীগ নেতা বলে দাবি করেন বলে জানান অর্ণব।
‘খেয়া’ শো-রুমের এক কর্মচারী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘সেদিন সাড়ে ১১টার দিকে পাঁচজন আসেন। এরপর যে যার মতো পছন্দ করে জিনিস নেন। তারা ১০টা শার্ট, ২-৩টা পাঞ্জাবি নিয়েছেন। অর্ধেকের কম পেমেন্ট দিয়ে তারা চলে যান।’
‘প্লাস পয়েন্ট’ শো-রুমের সহকারী ম্যানেজার জাকির হোসেন বলেন, ‘রাত ১১টার দিকে পাঁচ থেকে ছয়জন ছেলে কিছু পণ্য পছন্দ করে ৫০ শতাংশ ডিসকাউন্ট চান। রাজি না হলে তারা জোর করে অর্ধেক দামে পণ্য নিয়ে চলে যান।’
‘কে ক্রাফট’ এর লোটাস নামের এক কর্মকর্তা বলেন, ‘সেদিন অন্য দোকানগুলোতে বেশি ঝামেলা করেছে। আমার এখানে তারা পেমেন্ট কম করেছে, তবে ঈদের ব্যস্ততার মাঝে সময় নষ্ট করেছে বেশি।’
অভিযুক্ত যারা
আজিজ সুপার মার্কেটে বিনা মূল্যে পণ্য নেয়া ও কম দাম দেয়ার বিষয়ে অভিযুক্তদের মধ্যে সাতজনই জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হল ছাত্রলীগের সভাপতি মেহেদী হাসান শান্তর অনুসারী। একজন ফজলুল হক মুসলিম হল ছাত্রলীগের সভাপতি আনোয়ার হোসেন নাঈমের অনুসারী।
ফুটেজ বিশ্লেষণ ও তথ্য যাচাইয়ে জানা যায়, প্রথম গ্রুপের নেতৃত্বে ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের শিক্ষার্থী মাসুদুর রহমান আলিফ এবং পরিসংখ্যান বিভাগের শিক্ষার্থী মোহাম্মদ রানা। তারা দুজনই ২০১৭-১৮ শিক্ষাবর্ষের।
অন্য গ্রুপের নেতৃত্বে ছিলেন ম্যানেজমেন্ট ইনফরমেশন সিস্টেমস বিভাগের শিক্ষার্থী আরিফুল ইসলাম শুভ, ম্যানেজমেন্ট বিভাগের শাহনেওয়াজ আরেফিন পল্লব এবং সমাজকল্যাণ গবেষণা ইনস্টিটিউটের শেখ শান্ত আলম।
এই গ্রুপের অন্য সদস্যরা হলেন ম্যানেজমেন্ট বিভাগের রায়হান, দর্শন বিভাগের আব্দুল মমিন, উইমেন অ্যান্ড জেন্ডার স্টাডিজ বিভাগের শফিকুল ইসলাম। তারা সবাই বঙ্গবন্ধু হলের ২০১৮-১৯ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী।
অভিযোগের বিষয়ে বক্তব্য দিতে রাজি হননি বঙ্গবন্ধু হল ছাত্রলীগের সভাপতি মেহেদী হাসান শান্ত।
অভিযুক্ত আলিফ নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমি সব পেমেন্ট করছি। যে বলছে, সে মিথ্যা কথা বলছে। আমি শুধু একটা শার্ট আর প্যান্ট কিনছি।’
পরিসংখ্যান বিভাগের রানা বলেন, ‘ক্যাম্পাসে রাজনীতি করি, অনেক শত্রু থাকতে পারে। সেদিন আমি যা যা শপিং করছি, সবগুলোরই পেমেন্ট করা হয়েছে। যেদিন আমি সেখানে গেছি, সেদিন যে যে পেমেন্ট করছি সেগুলোর স্ক্রিনশট আমার কাছে আছে।’
অভিযোগের বিষয়ে শাহ নেওয়াজ পল্লবকে ফোন করা হলে তিনি ‘রং নম্বর’ বলে লাইন কেটে দেন। অভিযুক্ত অন্যদের বক্তব্য জানতে চেষ্টা করেও পাওয়া যায়নি।
এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক সাদ্দাম হোসেন বলেন, ‘এ ধরনের ঘটনা যদি ঘটে থাকে, সেটি অনাকাঙ্ক্ষিত এবং দুঃখজনক। চাঁদাবাজির ঘটনায় ন্যূনতম প্রশ্রয় দেয়ার সুযোগ নেই। ঘটনার উপযুক্ত সত্যতা পেলে আমরা অবশ্যই সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেব।’
শিক্ষার্থীদের বিরুদ্ধে আসা অভিযোগ প্রসঙ্গে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হলের প্রাধ্যক্ষ অধ্যাপক ড. মো. আকরাম হোসেন বলেন, ‘এই বিষয়ে দোকানিরা আমাকে কিছু বলেননি। তারা আমাকে অভিযোগ না দিলে আমি কী করতে পারি? তারপরও আমি খোঁজ নিয়ে দেখব।’
প্লাস পয়েন্ট শোরুমের এক কর্মকর্তা বলেন, ‘ঘটনার পর আমরা মার্কেটের মালিক সমিতিকে সংবাদ দিই। তারা ঘটনার দুই দিন পর বিস্তারিত শোনেন। সব দোকানের সিসিটিভি ফুটেজ আমরা জমা দিয়েছি। তারা মীমাংসা করে ফেলেছেন বলে শুনেছি। আর নেতারা আমাদের এই ঘটনা ভুলে যেতে বলেছেন।
‘সবকিছু বিবেচনায় আমরা অভিযোগ দিইনি। কারণ এটা করলে হয়তো ফের নিউ মার্কেটের মতো কোনো ঝামেলা হবে। দোকানের মালিকরা অল্প টাকার জন্য বড় ঝামেলায় জড়াতে চান না।’
সার্বিক বিষয়ে আজিজ সুপার মার্কেট মালিক সমিতির ম্যানেজার জনি বলেন, ‘ঘটনার ব্যাপারে আমি কথা বলতে পারব না। এগুলো আমি দেখি না। ঘটনা তো ঘটেছে অনেক আগে।
‘এ বিষয়ে আমাদের সভাপতি-সাধারণ সম্পাদকের সঙ্গে কথা বলেন, তবে তাদের একজন দেশের বাইরে, অন্যজন ঢাকার বাইরে।’
বিষয়টি নিয়ে শাহবাগ থানার পরিদর্শক (অপারেশন) কামরুজ্জামান বলেন, ‘এ বিষয়ে ব্যবসায়ীরা আমাদের কোনো লিখিত অভিযোগ দেননি। মৌখিকভাবেও জানাননি। আমি শপিং করতে গিয়ে কয়েকজনের কাছে বিষয়টি শুনেছি।’
শাহবাগ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মওদুদ হাওলাদারকে কল করে পাওয়া যায়নি।