ফরিদপুর সদরপুর উপজেলার ঢেউখালী ইউনিয়নে চেয়ারম্যান মিজানুর রহমানের শিশুপুত্র আল রাফসানকে কুপিয়ে হত্যার ঘটনার সাড়ে ৩ ঘণ্টা পর পাশের ইউনিয়নের একটি টাওয়ারের নিচ থেকে উদ্ধার করা হয়েছে এক ব্যক্তির মরদেহ। এর আধাঘণ্টা আগে পাশের ভাঙ্গা উপজেলায় এক ইউনিয়নে নিহত ব্যক্তির ভাইকে পিটুনি দিয়েছে স্থানীয় লোকজন।
এসব ঘটনা বুধবার বিকেলে ও সন্ধ্যায় ঘটেছে বলে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (ভাঙ্গা সার্কেল) ফাহিমা কাদের চৌধুরী নিশ্চিত করেছেন।
তিনি জানিয়েছেন, নিহত ব্যক্তি চেয়ারম্যানের ছেলের হত্যাকাণ্ডে জড়িত বলে অভিযোগ উঠেছে। তিনি টাওয়ার থেকে পড়ে মারা গেছেন। তাকে স্থানীয়রা ধাওয়া করেছিল বলে জানা গেছে। তবে ঘটনাটি হত্যা না আত্মহত্যা, তা তিনি নিশ্চিত করেননি।
মিজানুর রহমান সদর উপজেলার ঢেউখালী ইউপির চেয়ারম্যান। তিনি সাতরশি ইউনিয়নের সদরপুর পোস্ট অফিসের কাছে নতুন বাড়ি করেছেন। সেখানেই পরিবার নিয়ে বসবাস করেন। সেই বাড়িতেই বুধবার বিকেলে রক্তাক্ত অবস্থায় পাওয়া যায় তার ৯ বছরের ছেলে রাফসান ও স্ত্রী দিলজান বেগমকে।
অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ফাহিমা জানান, প্রাথমিকভাবে জানা গেছে, এক ব্যক্তি বাড়িতে ঢুকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে রাফসানকে কুপিয়েছে। তাকে বাঁচাতে গিয়ে হামলার শিকার হয়েছেন তার মা। গুরুতর অবস্থায় তাদের উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নেয়া হয়। সেখানে চিকিৎসক রাফসানকে মৃত ঘোষণা করেন।
উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ওমর ফয়সাল নিউজবাংলাকে জানান, স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নেয়ার আগেই রাফসানের মৃত্যু হয়। দিলজান বেগমের অবস্থা গুরুতর হওয়ায় তাকে ফরিদপুর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়।
আরও পড়ুন: বাড়িতে ঢুকে চেয়ারম্যানের শিশুসন্তানকে কুপিয়ে হত্যা
চেয়ারম্যানের বাড়িতে হামলার পর সন্ধ্যা ৭টার দিকে পাশের ভাঙ্গা উপজেলার নাছিরাবাদ ইউনিয়নের বালিয়াহাটি বাজারে স্থানীয়রা ইমরান মোল্লা নামের এক ব্যক্তিকে পিটুনি দেয়। ভাঙ্গা থানা পুলিশ গিয়ে তাকে উদ্ধার করে ভাঙ্গা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করে।
এরপর সাড়ে ৭টার দিকে সদর উপজেলার আটরশি ইউনিয়নে একটি মোবাইল নেটওয়ার্কের টাওয়ারের নিচে পাওয়া যায় ইমরানের ভাই এরশাদ মোল্লার মরদেহ।
অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ফাহিমা নিউজবাংলাকে জানান, এরশাদের বিরুদ্ধে চেয়ারম্যান মিজানের ছেলে রাফসানকে হত্যার অভিযোগ উঠেছিল। এর জেরে স্থানীয়রা এরশাদকে ধাওয়া দেয়। ধারণা করা হচ্ছে, জনরোষ থেকে বাঁচতে তিনি টাওয়ারে ওঠেন। তবে তিনি নিজ থেকে ঝাঁপ দিয়েছেন নাকি তাকে ফেলে দেয়া হয়েছে, তা এখনও বোঝা যাচ্ছে না।
ক্ষোভের জেরেই তার ভাইকে আরেক এলাকায় পেয়ে স্থানীয়রা পিটুনি দিয়েছে বলে ধারণা পুলিশের এই কর্মকর্তার।
এরশাদ কেন সন্দেহভাজন?
চেয়ারম্যানের বাড়ির সামনের সড়কের পাশে মুদির দোকান আছে স্থানীয় আদেল ব্যাপারীর। হামলার ঘটনার সময় তিনি দোকানে ছিলেন।
নিউজবাংলাকে তিনি বলেন, ‘চেয়ারম্যানের বাড়িতে হামলা হয়েছে বলে আশপাশে চেঁচামেচি হচ্ছিল। তখন আমি এরশাদকে চাপাতি হাতে দৌড়ে যেতে দেখি। বিষয়টি বুঝতে পারিনি, সবার সঙ্গে আমিও দৌড়ে চেয়ারম্যান বাড়িতে গিয়ে দেখি রক্তাক্ত পড়ে আছে চেয়ারম্যানের ছেলে ও স্ত্রী।’
উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান সিকদার নিউজবাংলাকে জানান, আদেলের মতো এলাকার অনেকেই এরশাদকে পালিয়ে যেতে দেখেছে। ইউপি চেয়ারম্যান মিজানের ওপর এরশাদ ক্ষিপ্ত ছিলেন। এ কারণে এই হামলা চালিয়েছেন বলে ধারণা ভাইস চেয়ারম্যানের।
কী কারণে এরশাদ ক্ষিপ্ত ছিলেন?
ভাইস চেয়ারম্যান জানান, এরশাদ ও ইমরান সদরপুরের ঢেউখালী ইউনিয়নের মোল্লা বাড়ির ছেলে। এরশাদ দুই সন্তানের বাবা। তার স্ত্রীর নাম রাহিমুন। স্ত্রীর সঙ্গে এরশাদের অনেক দিন ধরে কলহ চলছিল। রাহিমুনকে তিনি তালাক দিতে চেয়েছেন। রাহিমুন তাতে নারাজ ছিলেন।
ভাইস চেয়ারম্যান আরও জানান, তালাকের এই ইস্যুটি সালিশ পর্যন্ত গড়ায়। উপজেলা পরিষদ কার্যালয়ে গত সোমবার এই সালিশ বসে। তাতে ভাইস চেয়ারম্যান মিজানুর ও ঢেউখালী ইউপির চেয়ারম্যান মিজান দুজনই উপস্থিত ছিলেন।
সালিশে এরশাদকে তালাক দিতে মানা করেন ইউপি চেয়ারম্যান মিজান। তবে এরশাদ জানান, স্ত্রীকে তিনি তালাক দিবেনই। এরপর চেয়ারম্যান তাকে শর্ত দেন, তালাক দিতে হলে আগে দুই দিনের মধ্যে স্ত্রীকে দেনমোহরের সাড়ে ৩ লাখ টাকা পরিশোধ করতে হবে।
ভাইস চেয়ারম্যানের ধারণা, সালিশে চেয়ারম্যান মিজানের এই শর্তে ক্ষুব্ধ ছিলেন এরশাদ। বুধবার তার দেনমোহর পরিশোধ করার কথা ছিল। সে দিনই চেয়ারম্যানের বাড়ি হামলা করেন এরশাদ।
তবে এরশাদের ভাইকে পিটুনির বিষয়টি নিয়ে তিনি কোনো মন্তব্য করেননি।
এসব ঘটনার বিষয়ে চেয়ারম্যান মিজানের মন্তব্য জানতে তাকে একাধিকবার মোবাইল ফোনে কল করা হয়। তবে তিনি কল রিসিভ করেননি।
অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ফাহিমা জানান, শিশু রাফসানের মরদেহ সদর থানায় আছে। সকালে ময়নাতদন্তের জন্য বঙ্গবন্ধু মেডিক্যালে পাঠানো হবে। আর রাফসানের মাকে উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢাকা পাঠানো হচ্ছে। চেয়ারম্যান মিজান ঘটনার সময় ঢাকায় ছিলেন। হামলার খবর শুনে তিনি ফরিদপুর আসেন। তবে স্ত্রীকে নিয়ে তিনি আবার ঢাকায় যাচ্ছেন।
এদিকে ঢেউখালী ইউপির ৮ নম্বর ওয়ার্ডের সদস্য শহীদ সরদার রাত সাড়ে ১১টার দিকে জানিয়েছেন, ক্ষুব্ধ স্থানীয়রা নিহত এরশাদের বাড়িঘরে আগুন দিয়েছে।
তিনি আরও জানান, রাত ১০টার দিকে আগুন দেয়া হয় এরশাদের বাড়িতে। তবে সেখানে কেউ ছিলেন না বলে হতাহতের ঘটনা ঘটেনি। বাড়িটি আগুনে বেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।