নেত্রকোণা সদর উপজেলার এক গৃহবধূকে ‘যৌতুকের জন্য’ মারধর করে ক্ষতস্থানে মরিচের গুঁড়া দিয়ে নির্যাতন করা হয়েছে। তাকে নির্যাতনের একটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও ছড়িয়ে পড়েছে। এ ঘটনায় ওই গৃহবধূ ময়মনসিংহের ঈশ্বরগঞ্জ থানায় তার স্বামীসহ দুজনের নামে মামলা করেছেন। পুলিশ তার স্বামী রাজন মিয়াকে গ্রেপ্তার করেছে।
ঈশ্বরগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোস্তাছিনুর রহমান ও নেত্রকোণা মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) খন্দকার শাকের আহমেদ নিউজবাংলাকে এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন।
গত ১৩ মে নেত্রকোণা সদর উপজেলার আমতলা ইউনিয়নের ঝগড়াকান্দা গ্রামে রাজন মিয়ার বাড়িতে নির্যাতনের এ ঘটনা ঘটে।
নির্যাতিত গৃহবধূর নাম শিউলী আক্তার। ১৯ বছর বয়সী শিউলী ময়মনসিংহের ঈশ্বরগঞ্জ উপজেলার চরশিহারি গ্রামের রিকশাচালক সাইদুল ইসলামের মেয়ে। ২০২১ সালের ৩ সেপ্টেম্বর নেত্রকোণার ঝগড়াকান্দা গ্রামের রাজন মিয়া ওরফে রফিকুল ইসলামের সঙ্গে তার বিয়ে হয়।
শিউলী আক্তার নিউজবাংলাকে জানান, বিয়ের সময় রাজন মিয়াকে ৫০ হাজার টাকা যৌতুক দেয়া হয়। কিন্তু গত রমজানের আগে রাজন আবারও তার কাছে মোবাইল ফোন কেনার টাকা দাবি করেন। তখন তার রিকশাচালক বাবা সাইদুল ইসলাম একটি মোবাইল ফোন কেনার টাকা পাঠান। এর কয়েক দিন পর রাজন ঘরের আসবাবপত্র বাবদ আরও ১ লাখ টাকার দাবিতে চাপ সৃষ্টি করেন। বাবার আর্থিক অবস্থার কথা উল্লেখ করে তিনি অপারগতা প্রকাশ করেন। আর তখন থেকেই শুরু হয় নির্যাতন।
নির্যাতনের ঘটনায় ১৫ মে শিউলী বাদী হয়ে ঈশ্বরগঞ্জ থানায় মামলা করেন। মামলায় রাজন ও তার ভাবি রুমা আক্তারকে আসামি করা হয়। রাজনকে ওইদিনই গ্রেপ্তার দেখিয়ে আদালতে তোলা হলে আদালতে তাকে জেলহাজতে পাঠানোর নির্দেশ দেয়।
শিউলী জানান, গত ১৩ মে রাজন, রাজনের মা জরিনা খাতুন ও তার ভাবি (শিউলীর জা) রুমা আক্তার মিলে শিউলীকে বেধড়ক মারপিট শুরু করেন। হাত-পা বেঁধে মারপিটের একপর্যায়ে নির্যাতনকারীরা তার মাথা ও বুকের ওপর উঠে দাঁড়ান। নির্যাতনে শরীরের ছিলে যাওয়া চামড়ায় মরিচের গুঁড়া লাগিয়ে দেন। যন্ত্রণাকাতর অবস্থায় শিউলী পানি খেতে চাইলে তাকে মরিচের গুঁড়া মেশানো পানি খেতে দেন।
মরিচ মেশানো পানি খেয়ে শিউলী যন্ত্রণায় ছটফট করতে করতে দৌড়ে বাড়ির পাশের পুকুরে ঝাঁপ দেন। কিন্তু তাতেও তার শেষ রক্ষা হয়নি। পুকুরে গিয়েও শিউলীর ওপর নির্যাতন চালান তারা। পুকুরের পাড়ে দাঁড়িয়ে রাজনের ভাবি রুমা আক্তার মোবাইল ফোনে নির্যাতনের ভিডিও দৃশ্য ধারণ করেন।
গৃহবধূ নির্যাতন মামলার প্রধান আসামি রাজন। ছবি: সংগৃহীত
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া ভিডিও দৃশ্যে দেখা যায়, রুমা আক্তার যখন বলেন, ‘ক্যামেরা অ্যাকশন’ তখন রাজন শিউলীকে লাঠি দিয়ে মারপিট করছেন। শিউলীর হাত-পা তখনও বাঁধা। কখনও পুকুরে দাঁড়িয়ে আবার কখনও পুকুরের ঘাটে শুয়ে নির্যাতন সহ্য করছেন শিউলী।
এ ঘটনার পরদিন রাজন শিউলীকে তার বাবার বাড়িতে রেখে আসতে চাইলে এলাকাবাসী শিউলীর শরীরে আঘাতের চিহ্ন দেখে রাজনকে আটক করে পুলিশে খবর দেন। তখন পুলিশ গিয়ে রাজনকে আটক করে এবং শিউলীকে উদ্ধার করে ঈশ্বরগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করার ব্যবস্থা করেন। তিন দিন পর শিউলী সুস্থ হয়ে বাবার বাড়িতে ফিরে যান।
ঈশ্বরগঞ্জ থানার ওসি মোস্তাছিনুর রহমান বলেন, ‘নির্যাতনের শুরু নেত্রকোণায় হলেও ঘটনাটির শেষ হয়েছে ঈশ্বরগঞ্জে এসে। তাই আমরা ঈশ্বরগঞ্জ থানায় মামলা গ্রহণ করেছি। রাজন আদালতের নির্দেশে জেল হাজতে আছেন। অপর আসামি রুমাকেও গ্রেপ্তারের চেষ্টা করছি। তিনি পলাতক আছেন।’ঘটনাটি খুবই রোমহর্ষক বলে মন্তব্য করেন তিনি।
শিউলীর বাবা সাইদুল ইসলাম বলেন, ‘রাজন ও তার বাড়ির লোকেরা এর আগেও দুইবার শিউলীকে নির্যাতন করে আমার বাড়িতে পাঠিয়েছেন। এবারও নির্যাতিত হয়ে সে নিজেই এখানে এসেছে। আমি গরিব মানুষ। আমি এ ঘটনার সর্বোচ্চ শাস্তি চাই।’মামলা পরিচালনায় মানবাধিকার সংস্থাগুলোর সহযোগিতাও চাচ্ছেন সাইফুল।
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে নেত্রকোণা মডেল থানার ওসি খন্দকার শাকের আহমেদ জানান, ‘বিষয়টি আমি শুনেছি। পুলিশ সুপার মহোদয়ও জানেন। ঈশ্বরগঞ্জ থানা থেকেও আমাদের কাছে অনুসন্ধান স্লিপ পাঠিয়েছে। আমরা খোঁজখবর নিচ্ছি। ভিকটিমের ন্যায়বিচার প্রাপ্তিতে সহযোগিতা করব।’