পদ্মা সেতু চলাচলের ক্ষেত্রে কী হারে টোল দিতে হবে তা নির্ধারণ করেছে সরকার। নদী পারাপারে যানবাহনভেদে টোল ঠিক করা হয়েছে সর্বনিম্ন ১০০ টাকা থেকে ৬ হাজার টাকার বেশি।
রাষ্ট্রপতির আদেশে মঙ্গলবার সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের সেতু বিভাগের উপসচিব আবুল হাসানের সই করা প্রজ্ঞাপনে এ কথা বলা হয়েছে।
বর্তমানে ফেরিতে নদী পারাপারে যে হারে মাশুল দিতে হয়, সেতুতে তা দেড় গুণ বা আশেপাশে বাড়ানো হয়েছে।
এতে বলা হয়, পদ্মা সেতু পাড়ি দিতে মোটরসাইকেলকে দিতে হবে ১০০ টাকা। ফেরিতে এই খরচ ৭০ টাকা।
প্রাইভেট কার ও সাধারণ জিপে টোল ঠিক করা হয়েছে ৭৫০ টাকা। ফেরিতে বর্তমানে এই ধরনের গাড়ি পারাপারে দিতে হচ্ছে ৫০০ টাকা।
পিকআপ ও বিলাসবহুল জিপ পারাপারে বর্তমানে দিতে হচ্ছে ৮০০ টাকা। সেটি বাড়িয়ে করা হয়েছে ১ হাজার ২০০ টাকা।
মাইক্রোবাস পারাপারে ফেরিতে লাগে ৮৬০ টাকা। সেটি বাড়িয়ে সেতুতে করা হয়েছে ১ হাজার ৩০০ টাকা।
৩১ আসন বা এর কম আসনের ছোট বাসের জন্য দিতে হবে ১ হাজার ৪০০ টাকা। ফেরিতে এসব গাড়িকে দিতে হচ্ছে ৯৫০ টাকা।
মাঝারি বাসের টোল ফেরিতে ১ হাজার ৩৫০ টাকা থেকে বাড়িয়ে করা হয়েছে দুই হাজার টাকা।
বড় বাসে ফেরি পারাপারে লাগছে ১ হাজার ৫৮০ টাকা। সেটি বাড়িয়ে করা হয়েছে ২ হাজার ৪০০ টাকা।
৫ টনের ট্রাক এ সেতু পাড়ি দিলে গুনতে হবে ১ হাজার ৬০০ টাকা। ৫ টন পর্যন্ত এই ট্রাক পারাপারে ফেরিতে দিতে হচ্ছে ১ হাজার ৮০ টাকা।
৫ টন থেকে ৮ টনের মাঝারি ট্রাকের জন্য দিতে হবে ২ হাজার ১০০ টাকা, যা ফেরিতে লাগছে ১ হাজার ৪০০ টাকা।
৮ টন থেকে ১১ টনের মাঝারি ট্রাকের টোল ধরা হয়েছে ২ হাজার ৮০০ টাকা। ফেরিতে এই ধরনের গাড়ি পারাপারে লাগছে ১ হাজার ৮৫০ টাকা।
থ্রি এক্সেলের ট্রাক পারাপারে টোল ঠিক করা হয়েছে সাড়ে ৫ হাজার টাকা। ফেরিতে এই ধরনের গাড়ি পারাপারে লাগছে ৩ হাজার ৯৪০ টাকা।
মালবাহী ট্রেইলারের (চার এক্সেল) ৬ হাজার টাকা। ফেরিতে এই ধরনের গাড়ি পারাপারে লাগে ৪ হাজার টাকা।
চার এক্সেলের ওপরে মালবাহী ট্রেইলারের জন্য প্রতি এক্সেলে দেড় হাজার টাকা যোগ হবে।
দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের বাসিন্দাদের সড়কপথে রাজধানীর সঙ্গে যোগাযোগের দুর্ভোগ লাঘবে এক যুগেরও বেশি সময় ধরে অপেক্ষায় আছে মানুষ। সেতুর নির্মাণ প্রায় শেষ। জুনের শেষে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যেদিন সময় দেবেন, সেদিনই সেতু উদ্বোধন করা হবে বলে জানিয়েছেন সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের।
সেতুতে শেষ স্প্যানটি বসানো হয়েছে প্রায় দেড় বছর আগে। এখন চলছে সেতুর ওপরের সড়কে পিচ ঢালাইয়ের কাজ।
৬ দশমিক ১৫ কিলোমিটারের মূল সেতু ছাড়াও ৩ দশমিক ৬৮ কিলোমিটারের ভায়াডাক্ট বা সংযোগ সেতু মিলিয়ে সেতুর মোট দৈর্ঘ্য ৯ দশমিক ৮৩ কিলোমিটার।
প্রকল্পের অগ্রগতি
সেতুর কাজ হয়েছে কয়েকটি ভাগে। মূল সেতু, নদীশাসন, সংযোগ সড়ক ও প্রয়োজনীয় অবকাঠামো নির্মাণ, ভূমি অধিগ্রহণ ও পুনর্বাসন।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১৫ সালের ডিসেম্বরে মূল সেতুর নির্মাণ ও নদীশাসন কাজের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন। এরপর ২০১৭ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর ৩৭ ও ৩৮ নম্বর খুঁটিতে বসানো হয় প্রথম স্প্যান।
এর মধ্যে মূল সেতু ও নদীশাসন ছাড়া সব কাজ এরই মধ্যে শেষ হয়েছে। সংযোগ সড়ক খুলে দেয়া হয়েছে আরও আগে।
মূল সেতুসহ সব কাজ আগামী জুনের মধ্যে শেষ হলেও নদীশাসন কাজ শেষ হতে পারে বছরের শেষ নাগাদ, যদিও কাজ শেষ করার বিষয়ে সময় বেঁধে দেয়া রয়েছে। তবে সেতু প্রকল্পের মেয়াদ ২০২৪ সালের জুন পর্যন্ত। এতে ঠিকাদারের দেনাপাওনা বুঝিয়ে দেয়া এবং সেতুতে কোনো সমস্যা হলে ঠিকাদার যাতে ঠিক করে দিতে পারেন, এ জন্য শেষ এক বছর রাখা হয়েছে।
এপ্রিল শেষে পদ্মার মূল সেতুর কাজ শেষ হয়েছে ৯৮ শতাংশের বেশি। সব মিলিয়ে প্রকল্পের কাজ শেষ হয়েছে ৯৩ দশমিক ৫০ শতাংশ।
৩০ হাজার ১৯৩ কোটি টাকার এ প্রকল্পে এপ্রিল পর্যন্ত খরচ হয়েছে ২৭ হাজার ৩৪০ কোটি টাকা। অর্থাৎ আর্থিক অগ্রগতি হয়েছে ৯০ দশমিক ৫৬ শতাংশ।
আগামী জুনের মধ্যেই সেতুর কাজ শেষ হবে বলে আগামী অর্থবছরে এই প্রকল্পে বড় ধরনের বরাদ্দ রাখা হচ্ছে না।
সেতুর খরচের আদ্যোপান্ত
২০০৭ সালে একনেকে পাস হওয়া পদ্মা সেতু প্রকল্পের ব্যয় ছিল ১০ হাজার ১৬২ কোটি টাকা। তখন চার লেনের কংক্রিটের সেতু করার চিন্তা ছিল।
পরে ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে কংক্রিটের বদলে স্টিল স্ট্রাকচার দ্বিতল সেতু করার পরিকল্পনা করা হয়। সড়ক সেতুর নিচ দিয়ে যাবে ট্রেন।
২০১১ সালে ব্যয় বাড়িয়ে করা হয় ২০ হাজার ৫০৭ কোটি টাকা। ২০১৬ সালে দ্বিতীয় দফা সংশোধনের পর ব্যয় দাঁড়ায় ২৮ হাজার ৭৯৩ কোটি টাকা। বর্তমানে ব্যয় দাঁড়িয়েছে ৩০ হাজার ১৯৩ কোটি টাকা।
প্রকল্প শেষ হওয়ার আগে আরেক দফা প্রকল্প প্রস্তাব সংশোধন করতে হবে।
প্রকল্প গ্রহণের আগে এক সমীক্ষায় বলা হয়, পদ্মা সেতু প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে ১ দশমিক ২৩ শতাংশ হারে জিডিপি (মোট দেশজ উৎপাদন) বৃদ্ধি পাবে। দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জিডিপি বাড়বে অতিরিক্ত ২ দশমিক ৩ শতাংশ হারে। মোংলা বন্দর ও বেনাপোল স্থলবন্দরের সঙ্গে রাজধানী এবং বন্দরনগরী চট্টগ্রামের সরাসরি যোগাযোগ স্থাপিত হবে।
দেশের দক্ষিণ ও দক্ষিণ–পশ্চিমাঞ্চলের ১৯টি জেলাকে সারা দেশের সঙ্গে সরাসরি যুক্ত করবে এ সেতু।
শুরুতে বিশ্বব্যাংক, এডিবি, আইডিবিসহ দাতাদের কাছ থেকে ঋণ নিয়ে সেতু নির্মাণের পরিকল্পনা করা হয়। তবে সেতুর পরামর্শক নিয়োগে দুর্নীতি চেষ্টার অভিযোগ ওঠার পর বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে তৈরি হয় টানাপড়েন।
একপর্যায়ে দাতারা এই সেতু প্রকল্প থেকে সরে গেলে সরকার নিজ অর্থায়নে সেতু করার সিদ্ধান্ত নেয়। এই সেতু করতে সেতু বিভাগকে মোট ২৯ হাজার ৮৯৩ কোটি টাকা ঋণ দিয়েছে সরকার। ১ শতাংশ সুদ হারে ৩৫ বছরের মধ্যে সেটি পরিশোধ করবে সেতু কর্তৃপক্ষ।