বিপুল পরিমাণ অর্থপাচারের অভিযোগে গ্রেপ্তার পি কে হালদারকে ভারত কবে বাংলাদেশে ফেরত পাঠাবে সেই বিষয়টি এখনও স্পষ্ট নয়।
বাংলাদেশে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা পাচার ও আর্থিক কেলেঙ্কারি মামলার মূল হোতা পি কে হালদারকে পশ্চিমবঙ্গে অভিযান চালিয়ে শনিবার গ্রেপ্তার করে কেন্দ্রীয় অর্থ মন্ত্রণালয়ের গোয়েন্দা সংস্থা এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট (ইডি)। তদন্তে নেমে ইডি জানতে পেরেছিল যে, হুন্ডির মাধ্যমে এ অর্থ ভারতে আনা হয়।
পশ্চিমবঙ্গের অনেক প্রভাবশালী ব্যক্তির সঙ্গে ঘনিষ্ঠ ছিলেন প্রশান্ত কুমার হালদার।
পশ্চিমবঙ্গের বনমন্ত্রী জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক বাংলাদেশে আর্থিক প্রতারণায় যুক্ত প্রশান্ত কুমার হালদারের অবৈধভাবে পশ্চিমবঙ্গ থাকার প্রসঙ্গে বলেন, ‘আইন আইনের পথে চলবে। আমরা অন্যায়কে প্রশ্রয় দিই না।’
ফলে ভারতের আইন অনুযায়ী এ দেশের পাসপোর্ট, ভোটার কার্ড, আধার কার্ড জাল করে বেআইনিভাবে এ দেশে থাকার জন্য যদি আলাদা মামলা হয়, সেই বিচার প্রক্রিয়া শেষ করে, শাস্তির মেয়াদ শেষ করে প্রশান্ত কুমার হালদারদের বাংলাদেশে প্রত্যাবর্তন করতে এক বছর সময় লাগতে পারে বলে মনে করছে সংশ্লিষ্ট মহল।
এখন নিয়ম অনুযায়ী, বাংলাদেশ সরকার বন্দি পি কে হালদার চক্রের প্রত্যর্পণ বিষয়ে ভারত সরকারকে অনুরোধ করলে বন্দিকে বাংলাদেশে পাঠানোর বিষয়ে আদালতের অনুমতি নিতে হবে। তারপরই প্রশান্ত কুমার হালদারদের বাংলাদেশের হাতে তুলে দেয়া যাবে।
২০১৩ সালের ভারত-বাংলাদেশ বন্দি প্রত্যর্পণ চুক্তি অনুযায়ী পি কে হালদারদের বাংলাদেশে ফেরানো যাবে বলে সংশ্লিষ্ট মহল মনে করছে। তবে তিনি ভারতে এসে জালিয়াতচক্র, অবৈধ ভোটার কার্ড, আধার কার্ড এমনকি পাসপোর্ট তৈরির মতো অপরাধ করে নাগরিক হিসেবে থাকছিলেন।
ভারতীয় আইনে এসবই এক একটি গুরুতর অপরাধ। এসব বিষয়ে ইডি যদি তার বিরুদ্ধে মামলা করে এবং তার বিচারপ্রক্রিয়া ভারতের মাটিতে শুরু হয় তবে সে ক্ষেত্রে শাস্তির মেয়াদ শেষ করে পি কে হালদারদের বাংলাদেশে ফিরিয়ে নেয়া সম্ভব হবে। তবে এটি সময়সাপেক্ষ হবে।
এ বিষয়ে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ও আইনজীবীরা জানান, এসব অপরাধে কমপক্ষে ১ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড হতে পারে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক শর্তে নিউজবাংলাকে তারা এমন তথ্য জানান।
তাদের একজন বলেন, ‘যদি পি কে হালদারের বিরুদ্ধে ভারতে পাসপোর্ট জালিয়াতির মামলা হয়, তবে তার ফেরত প্রক্রিয়া এক বছর পিছিয়ে যেতে পারে। সেই সঙ্গে অবৈধভাবে এ দেশে থাকার জন্য শাস্তি হতে পারে তার। শাস্তির মেয়াদ ভারতে শেষ হলে তবেই বাংলাদেশে ফেরানো যাবে তাকে।’
পশ্চিমবঙ্গে পি কে হালদারচক্রের বহু সম্পত্তি চিহ্নিত করে, তার কাগজ ও প্রয়োজনীয় নথি বাজেয়াপ্ত করেছে এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট। ১১টি বাড়ি, জমির খোঁজ পেয়েছে ইডির তদন্তকারীরা।
পি কে হালদারকে সঙ্গে নিয়ে সোমবার বাকি সম্পত্তির খোঁজে তল্লাশি চালানো হবে বলে ইডি সূত্রে জানা গেছে।
২০১৯ সালে কয়েক হাজার কোটি টাকা বাংলাদেশ থেকে আত্মসাৎ করে ভারতে পালিয়ে এসে অবৈধ পরিচয়পত্র তৈরি করে এ দেশের নাগরিক হিসেবে থাকছিলেন তিনি। জালিয়াতির টাকা বিনিয়োগ করেছিলেন বিভিন্ন জমি-বাড়ির ব্যবসায়।
সুকুমার মৃধা, প্রণব হালদারের মতো সহযোগীরা প্রশান্ত হালদারের বেআইনি কাজের অংশ ছিলেন। অশোক নগরে তাদের পর পর বিলাসবহুল বাড়ি, জমি সম্পত্তি ও গাড়ির বহর দেখে স্থানীয় মানুষ সন্দিহান ছিলেন।
উত্তর ২৪ পরগনায় আত্মগোপন করে থাকা পি কে হালদারচক্র মাছের ভেড়ির ব্যবসা খুলে বসেছিলেন। এরই আড়ালে চলত বেআইনি কাজ কারবার।
হাজার হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ ও পাচার করে দেশ থেকে পালিয়ে যাওয়া বহুল আলোচিত প্রশান্ত কুমার হালদার (পি কে হালদার) শনিবার পশ্চিমবঙ্গে ধরা পড়েন। এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট (ইডি) পশ্চিমবঙ্গের উত্তর চব্বিশ পরগনা থেকে তাকে গ্রেপ্তার করে।
ঢাকা, কলকাতা ও নয়াদিল্লির একাধিক সূত্র নিউজবাংলাকে বিষয়টি নিশ্চিত করেছে।
সূত্রগুলো বলছে, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও কানাডা ঘুরে পি কে হালদার ভারতে গা ঢাকা দিয়েছেন- এমন খবর প্রথম ইডিকে জানান বাংলাদেশের গোয়েন্দারা। এরপর দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) ও বাংলাদেশ ব্যাংক তাকে গ্রেপ্তার করতে ইডিকে অনুরোধ জানায়।
পি কে হালদারের ঘনিষ্ঠ সহযোগীদের সন্ধানে শুক্রবার ভারতের বিভিন্ন স্থানে অভিযান শুরু করে ইডি। পশ্চিমবঙ্গের অন্তত ৯টি স্থানে একযোগে অভিযান চালানো হয়। তারা কয়েকটি পি কে হালদারের অভিজাত বাড়িসহ বিপুল সম্পত্তির খোঁজ পায়। বাড়িগুলো থেকে জমির দলিলসহ গুরুত্বপূর্ণ অনেক নথি উদ্ধার করা হয়।
ইডির বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, নাম বদলে কলকাতায় আত্মগোপনে ছিলেন আলোচিত পি কে হালদার। পশ্চিমবঙ্গে তার ২০ থেকে ২২টি বাড়ি আছে বলে প্রাথমিকভাবে তথ্য পাওয়া গেছে।
কলকাতায় বাংলাদেশের ডেপুটি হাইকমিশনার আন্দালিব ইলিয়াস নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমরা বিভিন্ন মাধ্যমে পি কে হালদারকে গ্রেপ্তারের বিষয়ে শুনেছি। কিন্তু ভারত সরকারের পক্ষ থেকে আমাদের এখনও অফিশিয়ালি কিছু জানানো হয়নি।’
পি কে হালদারের সঙ্গে আরও পাঁচজনকে গ্রেপ্তারের খবর জানাচ্ছে পশ্চিমবঙ্গের সংবাদমাধ্যম এই সময়। তাদের মধ্যে পি কে হালদারের স্ত্রী ও ভাইও আছেন।
ইডি এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানায়, প্রশান্ত কুমার হালদার পশ্চিমবঙ্গে শিবশঙ্কর হালদার পরিচয়ে ভারতীয় নাগরিকত্ব নিয়েছেন। তিনি জালিয়াতি করে রেশন কার্ড, ভারতীয় ভোটার আইডি কার্ড, প্যান কার্ড ও আধার কার্ড নিয়েছিলেন। তার সহযোগীরাও সেখানে জালিয়াতি করে ভারতীয় নাগরিকত্ব নিয়েছেন।
ইডি কর্মকর্তাদের ধারণা, পি কে হালদার ২০১৯ সালে কানাডায় পালিয়ে গেলেও তিনি ভারতে নিয়মিত যাতায়াত করতেন। স্থায়ীভাবে আত্মগোপন করে থাকার জন্যই তিনি জালিয়াতি করে ভারতীয় নাগরিকত্ব নিয়েছিলেন।
বাংলাদেশের বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে অন্তত ১১ হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ ও পাচারের পর কানাডায় পালিয়ে যান প্রশান্ত কুমার হালদার। দুদক পি কে হালদার ও তার সহযোগীদের বিরুদ্ধে ৩৪টি মামলা করেছে। এসব মামলায় এক ডজনেরও বেশি ব্যক্তিকে গ্রেপ্তারের পর আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। তাদের মধ্যে ১১ জন দোষ স্বীকার করে আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিও দিয়েছেন।
পি কে হালদারের অর্থপাচারের সঙ্গে জড়িত ও ঘনিষ্ঠ হিসেবে অন্তত ৭০ জনের একটি তালিকা করেছিল বিএফআইইউ ও দুদক। তাদের অনেকেই ভারতে গিয়ে নামের আংশিক পরিবর্তন করে জালিয়াতি করে ভারতীয় নাগরিকত্ব নিয়ে বসবাস করছেন।
ইডি জানিয়েছে, বাংলাদেশ থেকে হুন্ডির মাধ্যমে ভারতে ১০ হাজার কোটি টাকা পাচারের অভিযোগ রয়েছে পি কে হালদারের বিরুদ্ধে। সেই জালিয়াতির টাকা আবার পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন শেল কোম্পানিতে বিনিয়োগ করা হতো।
এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংকের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক প্রশান্ত কুমার হালদারের জালিয়াতচক্রের সঙ্গে যুক্ত হিসেবে ভারতের উত্তর চব্বিশ পরগনার অশোকনগরের সুকুমার মৃধা নামের এক মাছ ব্যবসায়ীর নাম ইডির তদন্তে উঠে আসে।
সূত্র বলছে, ২০১৪ থেকে ২০১৯ সালের মধ্যে বাংলাদেশে এই জালিয়াতির ঘটনা ঘটানো হয়। এই চক্রের প্রধান পি কে হালদার। তাকে সহযোগিতা করতেন প্রণব কুমার হালদার ও ছোট ভাই প্রীতিশ কুমার হালদার।
সূত্র জানিয়েছে, ২০১৯ সালে বিভিন্ন ধরনের জালিয়াতির পর ভারতে পালিয়ে গিয়ে শিবশঙ্কর হালদার নামে পশ্চিমবঙ্গে ভারতীয় আধার কার্ড, ভোটার কার্ড, পাসপোর্ট গ্রহণ করেন পি কে হালদার। তাকে সাহায্য করেন অশোকনগরের সুকুমার মৃধা।
ইডির তদন্তকারীরা বলছেন, সুকুমারের সঙ্গে পি কের দীর্ঘদিনের পরিচয়। বাংলাদেশ থেকে জালিয়াতি করে পাওয়া টাকা পশ্চিমবঙ্গে নিতে মাছ ব্যবসার আড়ালে পি কে হালদারকে সাহায্য করতেন এই সুকুমার।
সুকুমার মৃধার বাড়িতে তার জামাতা সঞ্জীবকে জিজ্ঞাসাবাদ করেন তদন্তকারীরা। এ ছাড়া প্রণব কুমার হালদারের দুই ছেলেকেও জেরা করে ইডি। অভিযানে বেশ কিছু কাগজপত্র জব্দ করা হয়েছে।
এদিকে অর্থ জালিয়াতির ঘটনায় বহুল আলোচিত পি কে হালদারকে দেশে ফিরিয়ে আনার নির্দেশনা চেয়ে রুলের শুনানির জন্য মঙ্গলবার দিন ঠিক করেছে আদালত।
বিচারপতি মো. নজরুল ইসলাম তালুকদার ও বিচারপতি ইজারুল হক আকন্দের হাইকোর্ট বেঞ্চ সোমবার এ দিন ঠিক করে দেয়।
বিষয়টি আদালতে শুনানির জন্য উপস্থাপন করেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল এ কে এম আমিন উদ্দিন মানিক। ওই সময় দুদকের পক্ষে ছিলেন খুরশীদ আলম খান।
পি কে হালদারকে দ্রুত দেশে আনা হবে: পররাষ্ট্রমন্ত্রী
পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন বলেন, ‘পি কে হালদার ভারতে গ্রেপ্তার হওয়ার বিষয়ে আমরা এখনও আনুষ্ঠানিকভাবে কিছু জানি না। তবে জানামাত্র তাকে ফিরিয়ে আনতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে।’
রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে শনিবার জাতীয় অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের স্মরণসভা ও আলোকচিত্র গ্রন্থের প্রকাশনা অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যের পর সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি এসব কথা বলেন।
এক প্রশ্নের জবাবে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘অর্থপাচারকারীদের বিরুদ্ধে অবশ্যই ব্যবস্থা নেয়া হবে। এটা নিয়ে দুদক কাজ করছে। অনেকে নামে-বেনামে দেশ থেকে টাকা পাচার করছে। তারা দেশের শত্রু। তাদের ধরে নিয়ে আসা ভালো। পি কে হালদারের মতো ধরে নিয়ে আসার দু-একটি দৃষ্টান্ত হলে তা আরও ভালো হবে।’