হাজার হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ ও পাচার করে দেশ থেকে পালিয়ে যাওয়া প্রশান্ত কুমার (পি কে) হালদারের ভারতে গ্রেপ্তার হওয়া নিয়ে দেশজুড়ে চলছে আলোচনা-সমালোচনা।
এ নিয়ে তার জন্মস্থান পিরোজপুরের নাজিরপুর উপজেলার দীঘিরজান গ্রামের বাসিন্দারা কী ভাবছেন, তা জানতে চেয়েছে নিউজবাংলা।
ওই গ্রামের একাধিক বাসিন্দা জানিয়েছে, তারা বিষয়টি নিয়ে লজ্জিত। পি কে হালদার যেন দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি পান, তবে পি কের এক আত্মীয় বলছেন, তাকে ফাঁসানো হয়েছে কি না, সেটি খতিয়ে দেখা উচিত।
দীঘিরজান গ্রামের যুবক দীপু বড়াল ও পিন্টু বড়াল জানান, পি কে বুয়েটে পড়াশোনা করে অনেক বড় চাকরি করেন। এ নিয়ে অনেক আগে গর্ব করতেন তারা,কিন্তু এখন তার কর্মকাণ্ডের জন্য গ্রামের লোকজন লজ্জা পাচ্ছেন।
পি কের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করেন দীঘিরজানের এ দুই বাসিন্দা।
পি কে হালদারকে নিয়ে তার জন্মস্থান পিরোজপুরের নাজিরপুর উপজেলার দীঘিরজান গ্রামের বাসিন্দারা জানিয়েছেন মিশ্র প্রতিক্রিয়া। ছবি: নিউজবাংলা
মাটিভাঙ্গা ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান জাহিদুল ইসলাম নিউজবাংলাকে বলেন, ‘এ ধরনের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের কারণে পি কে হালদারকে দেশে এনে কঠিন শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানাচ্ছি। এ ধরনের ঘটনা যেন আর কখনও না ঘটে।
‘শিক্ষিত হয়েও এমন জঘন্য কাজ কাম্য নয়। তার জন্য এখন আমাদের সম্মানহানি হচ্ছে। তাকে দেশে ফিরিয়ে আনতে পারলে পাচার হওয়া অর্থ ফিরিয়ে আনা যেতে পারে।’
ভিন্ন কথা বলেছেন পি কে হালদারের চাচাতো ভাইয়ের স্ত্রী আলো হালদার। তিনি বলেন, ‘দাদা (পিকে হালদার) গ্রামের অনেক মানুষকেই বিভিন্ন সময় বিভিন্নভাবে সাহায্য করেছেন।
‘দাদা এমন একটা ঝামেলায় পড়তে পারেন বা পড়েছেন সেটা মানতে কষ্ট হচ্ছে। সরকারেরও ক্ষতিয়ে দেখা উচিত এর পেছনে কারা জড়িত।’
পি কের জন্ম-বেড়ে ওঠা
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, এলাকায় দরিদ্র পরিবারের মেধাবী সন্তান হিসেবে সবাই চিনত পি কে হালদারকে। বাবা মৃত প্রণবেন্দু হালদার পেশায় ছিলেন দীঘিরজান বাজারের দর্জি। মা লীলাবতি হালদার ছিলেন স্কুলশিক্ষক। পি কে হালদার দীঘিরজান মাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে এসএসসি ও পাশের বাগেরহাটের সরকারি পিসি কলেজ থেকে এইচএসসি পাশ করেন।
এরপর বুয়েটের মেকানিক্যাল ডিপার্টমেন্ট থেকে ইঞ্জিনিয়ারিং ডিগ্রি নিয়ে বেক্সিমকো গ্রুপের জুট ফ্যাক্টরিতে চাকরি শুরু করেন। পরে পরিচিত পায় একজন বড় ব্যবসায়ী ও দানশীল মানুষ হিসেবে। তবে দুদকের মামলার পরে মানুষ তার প্রতারণার বিষয় জানতে পারে। সবশেষ শনিবার ভারতের পশ্চিমবঙ্গের অশোকনগর এলাকা থেকে দুই ভাইসহ গ্রেপ্তার হওয়ার পর স্থানীয়দের মধ্যে দেখা দেয় মিশ্র প্রতিক্রিয়া।
দরিদ্র পরিবারে জন্ম ও বেড়ে ওঠা পি কে হালদারের। ছবি: নিউজবাংলা
সরেজমিনে গ্রামবাসীর তথ্যে জানা যায়, পি কের মা লীলাবতি হালদারের নামে কলেজ প্রতিষ্ঠার পর ২০০২ সালে তিনি এলাকায় এসেছিলেন। সে সময় স্থানীয় এক ব্যক্তির কাছে কলেজ সংক্রান্ত বিষয় দিয়ে লাঞ্চিত হওয়ার পর আর আসেননি দীঘিরজানে। তবে গ্রামের অনেকের সঙ্গে তার যোগাযোগ হতো নিয়মিত।
অর্থপাচারের কেলেঙ্কারি ফাঁস হওয়ার পর শিক্ষিকা মা আরেক ছেলে প্রীতিশ হালদারের বাড়ি ভারতের অশোকনগরে চলে গেছেন। পি কে হালদারের আরেক ভাই প্রাণেশ হালদারও কানাডায় অবস্থান করছেন বলে জানা গেছে। আপন আত্মীয় বলতে তার চাচাতো ভাইয়ের বউ (কাকাতো ভাইয়ের বৌ) আলো হালদার থাকেন সেখানে গ্রামে। আত্মীয় আলো হালদার কোনো ভাবেই মানতেই পারছেন না তিনি এ ধরনের কাজ করতে পারেন।
ভারতে গ্রেপ্তার ও রিমান্ড
দেশের আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা আত্মসাৎ ও পাচার করে দেশ থেকে পলাতক পি কে হালদারকে শনিবার পশ্চিমবঙ্গের উত্তর চব্বিশ পরগনা থেকে গ্রেপ্তার করেছে ভারতের কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট (ইডি)। এ সময় পি কেসহ ছয় জনকে গ্রেপ্তার করে সংস্থাটি। ওই দিনই আদালতে তুলে তাকে তিন দিনের হেফাজতে নেয় তারা।
রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী বলেন, ‘বাংলাদেশের ওই ব্যাংকের ১০ হাজার কোটি টাকা প্রতারণার ঘটনা ঘটেছে। মূল অভিযুক্ত প্রশান্ত কুমার হালদার, তার ভাই গণেশ হালদারসহ বাংলাদেশের বাসিন্দা ইমাম হোসেন, স্বপন মৈত্র, উত্তম মৈত্র এবং আমানা সুলতানা ওরফে শর্মি হালদারকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।’
বিচারক শর্মিকে ১৭ মে পর্যন্ত জেল হেফাজতের নির্দেশ দেয়। অন্য পাঁচ জনকে তিন দিন করে রিমান্ড আদেশ দেয়া হয় বলে জানান তিনি।
ওই আইনজীবী জানান, বাংলাদেশে ভুয়া সংস্থা তৈরি করে বিভিন্ন রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক থেকে প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা তোলেন মূল অভিযুক্ত পি কে হালদার। অভিযোগ, বিভিন্ন ঘুর পথে সেই টাকা পাচার রুটে পশ্চিমবঙ্গে পাঠিয়ে দেয়া হতো।
এই ঘটনায় কোনো প্রভাবশালী ব্যক্তির যোগ রয়েছে কি না, তা খতিয়ে দেখছে ইডি।
অর্থ আত্মসাৎ ও পাচারের ঘটনায় দুর্নীতি দমন কমিশন বা দুদক পি কে হালদার ও তার সহযোগীদের বিরুদ্ধে ৩৪টি মামলা করেছে। ভারতের অর্থ সংক্রান্ত কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা বাহিনী এনফোর্সমেন্ট ডিরেকটরেটের কর্মকর্তারা পি কে হালদারসহ মোট ৬ জনকে গ্রেপ্তার করেছে। এ সংবাদ পিরোজপুরে গ্রামের বাড়িতে ছড়িয়ে পরলে এলাকাবাসীর কেউ কেউ স্বস্তি প্রকাশ করেছে। দেশে ফিরিয়ে এনে তার বিচারের দাবি জানিয়েছেন তারা।