দেশের আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকার বেশি লোপাটের জন্য আলোচিত প্রশান্ত কুমার হালদারকে (পি কে হালদার) গ্রেপ্তারের পর রোববার তিন দিনের রিমান্ডে নিয়েছে ভারতের কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা সংস্থা এনফোর্সমেন্ট ডিরেক্টরেট (ইডি)।
কবে তাকে দেশে ফিরিয়ে আনা হবে-সে ব্যাপারে এখনও নিশ্চিত করে কেউ কিছু বলতে পারছেন না। তবে যাদের টাকা লোপাট করে লাপাত্তা হয়েছিলেন পি কে হালদার, সেই গ্রাহকদের টাকা ফেরত পাওয়ার আলোচনা সামনে চলে এসেছে। পি কে হালদারের প্রেপ্তারে একটু আশার আলো দেখছেন গ্রাহকরা।
পি কে হালদার চারটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান দখল করে বিশাল অঙ্কের এই অর্থ হাতিয়ে নিয়েছিলেন। প্রতিষ্ঠানগুলো হলো-ইন্টারন্যাশনাল লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস, পিপলস লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস, এফএএস ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেড ও বাংলাদেশ ইন্ডাস্ট্রিয়াল ফাইন্যান্স কোম্পানি (বিআইএফসি)।
এরমধ্যে একেবারেই খারাপ অবস্থা হয়েছিল পিপলস লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেসের। এই প্রতিষ্ঠানে এক কোটি টাকা রেখেছিলেন সামিয়া বিনতে মাহবুব। অনিয়ম-দুর্নীতির কারণে প্রতিষ্ঠানটি অবসায়ন করা হলে টাকা ফেরত পাওয়ার জন্য অনেক গ্রাহকের সঙ্গে আন্দোলতে নেমেছিলেন সামিয়া বিনতে।
আন্দোলন পরিচালনার জন্য ক্ষুদ্র আমানতকারীদের স্বার্থ সংরক্ষণ নামে একটি সংগঠন গঠন করা হয়েছিল। সেই সংগঠনের সমন্বয়কারী ছিলেন সামিয়া বিনতে মাহবুব।
পি কে হালদার গ্রেপ্তারের খবরে সন্তোষ প্রকাশ করে রোববার সন্ধ্যায় তিনি নিউজবাংলাকে বলেন, ‘অন্ধকার গুহায় একটু আলো দেখতে পাচ্ছি। আমরা এখন তাকিয়ে আছি সরকারের দিকে; আদালতের দিকে। তাকে যেন দ্রুত দেশে ফিরিয়ে আনা হয়। আমরা যেন আমাদের টাকাটা ফেরত পাই।’
সার্বিক বিষয় নিয়ে সংগঠনের পক্ষ থেকে খুব শিগগিরই একটা সংবাদ সম্মেলন করা হবে বলে জানান সামিয়া বিনতে মাহবুব।
ভুক্তভোগী গ্রাহকদের টাকা ফেরত পাওয়ার কোনো সম্ভাবনা আছে কি না, থাকলে সেটা কীভাবে পাবেন-এ প্রশ্নের উত্তরে দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) আইনজীবী খুরশীদ আলম খান নিউজবাংলাকে বলেন, ‘মামলাগুলো যদি আমরা সফলভাবে করতে পারি, তাহলে আমাদের দেশের আদালতের মাধ্যমে ভারতসহ বিভিন্ন দেশে পি কে হালদারের সম্পদ জব্দ করতে পারব। তারপর বিচারপ্রক্রিয়ায় যখন রায় হবে, তখন ভুক্তভোগীরা টাকা পাবেন। তবে সেটা দীর্ঘ ও জটিল আইনিপ্রক্রিয়া।’
তিনি বলেন, ‘পি কে হালদার গ্রেপ্তারের পর গ্রাহকদের টাকা ফেরত পাওয়ার একটা সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। আদালতের মাধ্যমে দেশে ও বিদেশে আসামির (পি কে হালদার) যেসব সম্পদ রয়েছে, সেগুলো প্রথমে জব্দ করে, পরে বিক্রি করে সেই টাকা গ্রাহকদের ফেরত দেয়ার ব্যবস্থা হতে পারে। এসব কিছুই হবে আদালতের মাধ্যমে। কেননা, এখন অবধি পি কে হালদারের বিষয়ে যা কিছু হয়েছে, তার সব কিছুই কিন্তু আদালতের আদেশে হয়েছে।’
খুরশীদ আলম বলেন, ‘মিউচুয়াল লিগ্যাল অ্যাসিস্ট্যান্স রিকোয়েস্ট (এমএলএআর) ২০১২-এর আওতায় ভারতকে পি কে হালদারের বিষয়ে তথ্য দেয় দুদক। এর ভিত্তিতে ইডি অনুসন্ধান চালিয়ে তাকে গ্রেপ্তার করেছে। বাংলাদেশের অনুরোধকে গুরুত্ব দিয়ে একই দিনে ৯টি বাড়িতে অভিযান চালিয়েছে ইডি। ৯টি বাড়ির মধ্যে তিনটি বাড়ি তারা এক সপ্তাহ ধরে রেকি করেছিল, যার একটা থেকে পি কে হালদারকে গ্রেপ্তার করা হয়।’
এখন দুদকের কাজ কী হবে- এ প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেলন, ‘দুদকের কাজ চলছে। তিনটা মামলার তদন্ত শেষ হয়েছে। দুদকের এখন মুখ্য কাজ হবে, বহিঃসমর্পণ চুক্তি অনুসারে পি কে হালদারকে যদি দ্রুত বাংলাদেশে আনা যায়, তাহলে দেশে এনে তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা। তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা খুবই প্রয়োজন। কারণ, মামলায় ইতিমধ্যে যাদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে, তাদের দেয়া তথ্য–উপাত্ত মিলিয়ে দেখতে হবে।
‘এ ছাড়া তার নিজেরও তো বক্তব্য আছে। এত বড় একটা আর্থিক কেলেঙ্কারি, সে কীভাবে করল, তা জানা দরকার। একা তো তার পক্ষে হাজার হাজার কোটি টাকা বিদেশে নেয়া সম্ভব নয়। নিশ্চয়ই তার সঙ্গে আরও অনেক রাঘববোয়াল ছিল। তারা কারা, সব বের করতে হবে। পি কে হালদারকে যদি বহিঃসমর্পণ চুক্তির মাধ্যমে দেশে আনা হয়, তখন দুদক আদালতের অনুমতি নিয়ে তাকে জিজ্ঞাসাবাদের সুযোগ পাবে।
‘এখন সবচেয়ে বড় কাজ হচ্ছে পি কে হালদারকে দেশে ফিরিয়ে আনা। দুদক তো আগেই আবেদন জানিয়েছে। এখন সরকার বহিঃসমর্পণ চুক্তির আওতায় ফিরিয়ে আনতে কাজ করবে। গ্রাহকদের টাকা ফেরতসহ বিচার প্রক্রিয়া সব কিছুই নির্ভর করছে এখন পি কে হালদারকে দেশে ফিরিয়ে আনার উপর।’
ভারতে অবৈধভাবে প্রবেশ, বসবাস, বেনামে সম্পত্তি কেনা, আইনবহির্ভূতভাবে অর্থ বাংলাদেশ থেকে ভারতে আনা—এসব অভিযোগে পি কে হালদার ও তার পাঁচ সহযোগীকে শনিবার গ্রেপ্তার করে ইডি।
খুরশীদ আলম জানান, দেশে পি কে হালদারের বিরুদ্ধে মোট ৩৭টি মামলা আছে। তার মধ্যে ৩৬টি মামলা অর্থপাচার ও জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের।
সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকা লোপাটের জন্য দেশের আর্থিক খাতে আলোচিত নাম পি কে। তিনি একটি আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও একটি ব্যাংকের শীর্ষ কর্মকর্তা ছিলেন। আবার দেশের আর্থিক খাতের শীর্ষ দখলদার ও খেলাপিদের একজন। এমন চরিত্রের আর একজনকেও এ দেশে পাওয়া যায়নি।
শিক্ষাজীবন শেষে পি কে হালদার যোগ দেন আর্থিক প্রতিষ্ঠান আইআইডিএফসিতে, ২০০৮ সাল পর্যন্ত উপব্যবস্থাপনা (ডিএমডি) পরিচালক ছিলেন। ১০ বছরের ব্যাংকিং অভিজ্ঞতা নিয়েই ২০০৯ সালে তিনি অদৃশ্য আশীর্বাদে রিলায়েন্স ফাইন্যান্সের এমডি হয়ে যান। এরপর ২০১৫ সালের জুলাইয়ে এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংকের এমডি পদে যোগ দেন।
২০১৪ সালের জাতীয় নির্বাচনের আগে ও পরে কমপক্ষে চারটি ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানের (এনবিএফআই) মালিকানায় অস্বাভাবিক পরিবর্তন আসে। সেই চার প্রতিষ্ঠানের আর্থিক অবস্থা এখন চরম খারাপ। একটি বিলুপ্তের পথে, বাকি তিনটিও গ্রাহকদের টাকা ফেরত দিতে পারছে না। নানা কৌশল করে এসব প্রতিষ্ঠান দখল করেন পি কে হালদার। প্রতিষ্ঠান দখল করার জন্য নামে-বেনামে অসংখ্য কোম্পানি খুলেছেন, শেয়ারবাজার থেকে বিপুল পরিমাণ শেয়ার কিনেছেন, দখল করা আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণের নামে টাকাও সরিয়েছেন। এমনকি দেশের বাইরেও কোম্পানি খোলেন।
প্রতিষ্ঠানগুলো দখলের সময় পি কে হালদার প্রথমে রিলায়েন্স ফাইন্যান্স এবং পরে এনআরবি গ্লোবাল ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) ছিলেন। আর এসব কাজে তাকে সব ধরনের সমর্থন ও সহায়তা দিয়েছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতিনির্ধারণী পর্যায়ের একাধিক কর্মকর্তা। মূলত বাংলাদেশ ব্যাংক ও বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) —এই দুই নিয়ন্ত্রক সংস্থার চোখের সামনেই সবকিছু ঘটেছে।
২০১৯ সালের মাঝামাঝিতে যখন তার দখল করা আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো গ্রাহকের টাকা ফেরত দিতে ব্যর্থ হতে শুরু করে, তখন পি কে হালদার ভারতে পালিয়ে যান। পরে বসবাস শুরু করেন কানাডা ও সিঙ্গাপুরে। এরপর আবার চলে আসেন ভারতের পশ্চিমবঙ্গে।
পি কের দখল করা প্রতিষ্ঠান চারটি হলো ইন্টারন্যাশনাল লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস, পিপলস লিজিং অ্যান্ড ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস, এফএএস ফাইন্যান্স অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট লিমিটেড ও বাংলাদেশ ইন্ডাস্ট্রিয়াল ফাইন্যান্স কোম্পানি (বিআইএফসি)।
অনিয়ম-দুর্নীতির কারণে গ্রাহকদের টাকা ফেরত দিতে পারেনি আর্থিক প্রতিষ্ঠান পিপলস লিজিং অ্যান্ড ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস লিমিটেড। এমন পরিস্থিতিতে ২০১৯ সালে এই আর্থিক প্রতিষ্ঠানটি অবসায়নের সিদ্ধান্ত নিয়েছিল সরকার। এর প্রভাব পড়ে পুরো আর্থিক প্রতিষ্ঠান খাতে, যা এখনও কাটিয়ে উঠতে পারেনি।
চার আর্থিক প্রতিষ্ঠানের মধ্যে সবচেয়ে খারাপ অবস্থা হয়েছিল পিপলস লিজিং অ্যান্ড ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস লিমিটেডের। অনিয়ম-দুর্নীতির কারণে গ্রাহকদের টাকা ফেরত দিতে পারছিল না প্রতিষ্ঠানটি। এমন পরিস্থিতিতে ২০১৯ সালে এই আর্থিক প্রতিষ্ঠানটি অবসায়নের সিদ্ধান্ত নিয়েছিল সরকার। এর প্রভাব পড়ে পুরো আর্থিক প্রতিষ্ঠান খাতে, যা এখনো কাটিয়ে উঠতে পারেনি।
সে কারণে পরে আদালতের নির্দেশে পিপলস লিজিংকে নতুন করে পুনর্গঠন করার সিদ্ধান্ত নেয় সরকার। পুনর্গঠনের অংশ হিসেবে প্রতিষ্ঠানটির প্রকৃত ক্ষতির পরিমাণ চিহ্নিত করতে কাজ শুরু হয়েছে। বন্ধ হয়ে গেছে অবসায়নের প্রক্রিয়া। আর আমানতকারীরা এখনও ঘুরছেন সরকারের বিভিন্ন সংস্থার দ্বারে দ্বারে।
তবে, পুনর্গঠন প্রক্রিয়ার অংশ হিসেবে আদালতের নির্দেশে বয়স্ক, অসুস্থ আমানতকারীরা তাদের মোট আমানতের ১০ শতাংশ অথবা পাঁচ লাখ টাকা ফেরত পেয়েছেন।
২০২০ সালের শেষের দিকে আন্দোলনেও নেমেছিলে আমানতকারীরা। মিছিল-সমাবেশ, মানববন্দন, বাংলাদেশ ব্যাংকে স্বারকলিপিও দিয়েছিলেন তারা। হাইকোর্টের নির্দেশে কয়েকজন আমানতকারী আদালেতে উপস্থিত হয়ে টাকা ফেরত না পেয়ে তাদের কষ্ট ও মানবেতর জীবনযাপনের কথাও বলেছিলেন।
পিপলস লিজিংয়ের ক্ষুদ্র আমানতকারীদের সংগঠনের সমন্বয়কারী সামিয়া বিনতে মাহবুব প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি ও আমার স্বামী বিদেশি কোম্পানিতে চাকরি করতাম। সেখান থেকে পাওয়া টাকা ও গয়না বিক্রি করে এক কোটি টাকা পিপলস লিজিংয়ে রেখেছিলাম। ছয় মাস পর একটা জমি কেনার জন্য টাকাটা জমিয়েছিলাম। এর মধ্যে প্রতিষ্ঠানটি বন্ধ হয়ে যায়। এরপর অর্থাভাবে আমার চিকিৎসা বন্ধ হয়ে গেছে। আমার ছেলেকে স্কুলে দিতে পারছি না। মানবেতর জীবন যাপন করতে হচ্ছে। এখন একটু আশার আলো দেখতে পাচ্ছি।
‘অন্য গ্রাহকরা একটু আশান্বিত হয়েছেন। সবাই যোগাযোগ করছেন। আমরা খুব শিগগিরই বসবো; বসে ঠিক করব কী করা যায় এখন। তবে সরকার প্রতি আমাদের অনুরোধ, যেহেতু আসামি গ্রেপ্তার হয়েছে, এখন যেনো আমাদের টাকা ফেরতের ব্যবস্থা করা হয়।’