বিএনপি ভোটে না এলে স্বতন্ত্র পরিচয়ে ভোটে লড়বেন- আবার জানিয়ে রাখলেন সিটি করপোরেশনে গত দুই নির্বাচনে জয় পাওয়া মনিরুল হক সাক্কু। আবার জয় পাওয়ার বিষয়ে তার কোনো সংশয় নেই।
আওয়ামী লীগ এই নির্বাচনে প্রার্থী ঘোষণার পর দৃশ্যত দলে কোনো বিদ্রোহ নেই, যে অনৈক্যের কারণে বারবার কুমিল্লায় ভুগেছে ক্ষমতাসীন দল।
অন্যদিকে বরাবর এককাট্টা থাকা বিএনপিতেই এবার অনৈক্যের সুর। সাক্কুর মতোই স্বতন্ত্র পরিচয়ে ভোটে লড়ার ঘোষণা দিয়ে রেখেছেন স্বেচ্ছাসেবক দলের নেতা নিজাম উদ্দিন কায়সার, যার অনুসারীদের সঙ্গে সাক্কু অনুসারীদের বিরোধ প্রবল।
কুমিল্লায় যে ঘরোয়া বিবাদের কারণে বারবার আওয়ামী লীগ ভুগেছে, এবার সেই একই বিবাদ বিএনপির মধ্যে তৈরি হয় কি না, তা নিয়ে আছে আলোচনা।
এই নির্বাচনে দুই প্রধান দলের প্রতীক নৌকা ও ধানের শীষে লড়াই হচ্ছে না, এটা নিশ্চিত। কারণ, বিএনপি ভোটে যাচ্ছে না। তবে পৌরসভা ও সিটি করপোরেশন মিলিয়ে টানা তিনটি ভোটে সহজ জয় পাওয়া সাক্কু ভোটে যাচ্ছেন স্বতন্ত্র হলেও। আর স্বেচ্ছাসেবক দলের নেতা কায়সারও মনোনয়নপত্র তুলেছেন স্বতন্ত্র হিসেবেই।
তবে প্রতিপক্ষ নিয়ে ভাবছেন না সাক্কু। ২০০৫ সাল থেকে যতবার জনপ্রতিনিধি হিসেবে নগর পরিচালনা করেছেন, ততবার তিনিই ছিলেন দায়িত্বে। ভোটাররা কখনও বিমুখ করেননি তাকে।
নিউজবাংলাকে দেয়া একান্ত সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন, এবারও তিনিই জিতবেন।
সাক্কু বলেন, ‘২০১২ সালে আমি আওয়ামী লীগের বর্ষীয়ান নেতা সদ্য প্রয়াত আফজল খানকে হারিয়ে জয়লাভ করেছি। এখানে ভয়ভীতির কিছু নেই। জনগণ আমাকে চেয়েছে, আমি নির্বাচিত হয়েছি।
‘আমি চাই বিজয়ী হয়ে আমার অসমাপ্ত কাজগুলো সমাপ্ত করব। সুতরাং আওয়ামী লীগের যতই হেভিওয়েট প্রার্থী আসুক, আমার সমস্যা হবে না। আমার অসমাপ্ত কাজগুলো শেষ করার জন্য জনগণের ইচ্ছায় শেষবারের মতো মেয়র নির্বাচন করব।’
সাক্কুর মধ্যে বিশেষ কিছু যে আছে, তা এরই মধ্যে স্পষ্ট। তিনি ২০০৫ সালে যখন পৌরসভার মেয়র হিসেবে জেতেন, তখন রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় তার দল বিএনপি।
এই ভোটের চার বছরের মাথায় জাতীয় নির্বাচনে বিপর্যয় ঘটে যায় বিএনপির। কুমিল্লা সদর আসনে গো-হারা হেরে যান দলের প্রার্থী। ১৯৭৩ সালের পর প্রথমবারের মতো নৌকার প্রার্থী হিসেবে জয় পান আ ক ম বাহাউদ্দিন বাহার।
আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর পৌরসভা থেকে সিটি করপোরেশন হয় কুমিল্লা। দল ক্ষমতায়, এই অবস্থায় ২০১২ সালে করপোরেশনের প্রথম নির্বাচনে উন্নয়নের স্বার্থে জনগণ আওয়ামী লীগের প্রার্থীকে ভোট দেবে- এমন আশা পূরণ হয়নি ক্ষমতাসীনদের জন্য। দলের ডাকসাইটে নেতা আফজল খান হেরে যান ৩৫ হাজার ভোটে।
পরের নির্বাচনে জাতীয় রাজনীতিতে বিএনপির অবস্থান আরও নড়বড়ে। ২০১৪ সালের নির্বাচন বানচালের আন্দোলন ও পরের বছর সরকার পতনের আন্দোলনে নেমে খালি হাতে ঘরে ফেরার পর জাতীয় রাজনীতিতে দাপট তৈরি হয় আওয়ামী লীগের। তবু সাক্কুর হাত থেকে কুমিল্লা দখলে নিতে ব্যর্থ হয় তারা।
২০১৭ সালে দলীয় প্রতীকে প্রথম ভোটে আওয়ামী লীগ প্রার্থী করে আফজল খানের মেয়ে আঞ্জুম সুলতানা সীমাকে। সীমা তার বাবার তুলনায় ভোট পেয়েছেন বেশি। ব্যবধান কমাতে পারেন অনেকটাই। সাক্কু জয় পান ১১ হাজারের কিছু বেশি ভোটে।
এই নির্বাচনের ফলাফলের পর অতীতের প্রায় সব নির্বাচনের মতোই কুমিল্লা আওয়ামী লীগে আফজল-বাহারের বিরোধের বিষয়টি সামনে আসে।
৯০ সাল থেকেই জাতীয় ও স্থানীয় নির্বাচনে দুই ডাকসাইটে নেতার বিভেদে ভুগেছে ক্ষমতাসীন দল। জাতীয় নির্বাচনে নানা সময় দেখা গেছে বাহারকে আওয়ামী লীগ মনোনয়ন দিলে আফজল হন স্বতন্ত্র প্রার্থী। আর আফজলকে মনোনয়ন দিলে বাহার করেন বিরোধিতা। স্থানীয় নির্বাচনেও এক পক্ষের কেউ সমর্থন বা মনোনয়ন পেলে অপর পক্ষ করেন বিরোধিতা।
আফজল খানের মেয়েকে মনোনয়ন দেয়ার পর অতীতের সেই বিষয়টি আর আসবে না- এমন আশা করছিল ক্ষমতাসীন দল। কিন্তু ভোট শেষে প্রকাশ হয়, দুই পক্ষ এককাট্টা হতে পারেনি।
২০২১ সালে আফজল খানের মৃত্যুর পর তার অনুসারীরা এখন দৃশ্যত প্রভাব হারিয়ে ফেলেছে। এই অবস্থায় বাহারের অনুসারী হিসেবে পরিচিত আরফানুল হক রিফাতের হাতে নৌকা তুলে দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে ক্ষমতাসীন দল।
ওদিকে বিএনপি ঘোষণা দিয়ে রেখেছে বর্তমান সরকার ও নির্বাচন কমিশনের অধীনে কোনো ভোটেই আসবে না তারা। কুমিল্লাও তার বাইরে নয়। তবে সেখানে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে পরোক্ষ লড়াই হবে, সেটা আগেভাগেই জানা হয়ে যায় এ কারণে, সাক্কুর ঘোষণা প্রকাশ্যেই ছিল, দল যাই করুক, ভোটে লড়বেন তিনি।
বিএনপির ভোট বর্জনের ঘোষণার মধ্যেও নির্বাচনে লড়ার বিষয়ে সাক্কু বলেন, ‘আমি দল থেকে অব্যাহতি নিয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী হয়ে নির্বাচন করব। ২০১২ সালেও জেলা বিএনপির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদকের পদে থাকাকালে দল থেকে অব্যাহতিপত্র দিয়ে নির্বাচন করেছি। পরে দল আবারও আমাকে গ্রহণ করেছে।
‘এরপর আবার ২০১৭ সালের দ্বিতীয়বারের মতো নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেছি। গতবার ধানের শীষ প্রতীকে বিজয়ী হয়েছি। দল আমার বিষয়ে অবগত আছে।’
তবে মনোনয়পত্র সংগ্রহ করার মধ্য দিয়ে সাক্কু তার নির্বাচনের প্রস্তুতি নিয়ে এবার নির্ভার থাকতে পারছেন না নিজ দলের বিরোধিতায়।
মহানগর স্বেচ্ছাসেবক দলের সভাপতি নিজাম উদ্দিন কায়সারও ভোটে লড়ার ঘোষণা দিয়ে মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করেছেন। বলেছেন, ভোট তিনি করবেনই।
ভোটের আগে একই দলের একাধিক আগ্রহী নেতা মোটেও অস্বাভাবিক নয়। তবে সাক্কুর জন্য কায়সার বিপত্তি অন্য কারণে যে তিনি ‘সাক্কু ঠেকাও’-এর আওয়াজ তুলেছেন।
কুমিল্লা মহানগরে বিএনপি দৃশ্যত দুই ভাগে বিভক্ত। এক অংশের নেতৃত্ব দেন সাক্কু, আর তার প্রতিদ্বন্দ্বী সাবেক সংসদ সদস্য আমিনুর রশীদ ইয়াসিন। এই ইয়াসিনের শ্যালক হলেন কায়সার।
সাক্কু ও ইয়াসিনের বিরোধ কুমিল্লার মানুষজনের কাছে খুবই পরিচিত ইস্যু। দুই নেতার দ্বন্দ্বের কারণে দলীয় সভা আলাদা স্থানে হয়ে আসছে সেখানে।
কেন্দ্রীয়ভাবে কোনো কর্মসূচির ডাক দেয়া হলে সাক্কুর অনুসারীরা দক্ষিণ জেলা বিএনপি অফিসে অবস্থা নেন। অন্যদিকে ইয়াসিন সমর্থকরা একত্রিত হন ধর্মসাগর পাড়ে তার ব্যক্তিগত কার্যালয়ে।
কায়সার বলেন, ‘তিনি (সাক্কু) দলের কোনো অনুষ্ঠানে যোগ দেন না। দলে থেকেও হাজি ইয়াসিনের অনুসারী বহু নেতাকর্মীকে মামলা করে জেল খাটিয়েছেন। তিনি আসলে আওয়ামী লীগের লোক, বিএনপির সাইনবোর্ড ব্যবহার করে রাজনীতি করে যাচ্ছেন। তাই দলীয় কমান্ড না মানায় ২০২১ সালের ১৩ ডিসেম্বর তাকে বিএনপির কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটি থেকে অব্যহতি দেয়া হয়।’
২০১৮ সালের জাতীয় নির্বাচনে কুমিল্লা সদর আসনে বিএনপি প্রার্থী করে ইয়াসিনকে। সে সময় তিনি নেতা-কর্মী নিয়ে সাক্কুর বাসভবনে যান। তবে বাসায় থেকেও দেখা করেননি মেয়র।
দলে অনৈক্য নিয়ে কতদূর আগাতে পারবেন- এমন প্রশ্নে সাক্কু নিউজবাংলাকে বলেন, ‘কে প্রার্থী হলো না হলো, ঐক্য রইল কি রইল না- এটা আমি চিন্তা করছি না ‘
নিজাম উদ্দিন কায়সার যদি নির্বাচন করেন তাহলে তো ভোট ভাগাভাগি হবে- এই মন্তব্যের জবাবে সদ্যবিদায়ী মেয়র দলের, ‘আপনার ৫ হাজার ১০ হাজার কর্মী থাকতে পারে। নির্বাচনে জেতার জন্য জনগণের ভালোবাসা দরকার হয়। আমার প্রতি নগরবাসীর ভালোবাসা আছে। তা নিয়ে আমি নির্বাচন করব।’
সাক্কুকে চ্যালেঞ্জ জানানো কায়সার বলেন, ‘আমি আগামীর সুন্দর কুমিল্লা নগরী গড়তে নির্বাচন করব। আজ দলের নেতাকর্মীরা দলের আরেকজনের দ্বারা নির্যাতিত। আমি সেইসব নেতাকর্মীর জন্যও নির্বাচনটা করব।’
এই আরেকজন বলতে স্পষ্টতই তিনি সাক্কুকে বুঝিয়েছেন।
বিএনপিতে এই বিভেদ নিয়ে বিএনপির কেন্দ্রীয় ত্রাণ ও পুনর্বাসন সম্পাদক ও কুমিল্লা দক্ষিণ জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক আমিনুর রশীদ ইয়াছিন বলেন, ‘দল নির্বাচনে যাচ্ছে না, এটা স্পষ্ট। এখন কে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবে কে করবে না সেটা তাদের ব্যাপার।’
কিন্তু আপনাদের দলের দুইজন ভোট করছেন বলেই জানিয়েছেন। তাদেরকে কী বলবেন, এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘যদি তারা কেউ নির্বাচন করে দল তাদের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবে। আমরা সবকিছুই মনিটরিং করছি। দলের সিদ্ধান্তের বাইরে কেউ গেলে তার বিষয়ে দল সিদ্ধান্ত নেবে।’
২০১২ ও ২০১৭ দুইবারই কুমিল্লায় আংশিক ইভিএম ব্যবহার হয়েছে। এবার পুরো ভোটই হবে এই যন্ত্রে। সাক্কু বলেন, ‘ইভিএমে যদি কারচুপি হয়, তাহলে সরকারের ভাবমূর্তি নষ্ট হবে। সামনে জাতীয় সংসদ নির্বাচন। আরও অনেক মেয়র প্রার্থী আছে। তারাও আমার মতো ইভিএমে সুষ্ঠু ভোট গ্রহণ আশা করে।’
জেলা নির্বাচন কর্মকর্তা মো. শাহেদুন্নবী চৌধুরী বলেন, ‘নির্বাচন নিয়ে সংশয়ের কিছু নেই। অবাধ সুষ্ঠ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন আমাদের অঙ্গীকার। আমরা সেই অঙ্গীকার বাস্তবায়নের পথে।’
নির্বাচনে আগামী ১৭ মে পর্যন্ত মনোনয়ন ফরম সংগ্রহ ও জমা নেয়া হবে রিটার্নিং কর্মকর্তার কার্যালয়ে । ১৯ মে হবে মনোনয়নপত্র যাচাই-বাছাই। ২৭ মে প্রতীক বরাদ্দ আর ১৫ জুন হবে ভোট।
নির্বাচনে ১০৫ কেন্দ্রে ৬৪০টি ভোট কক্ষ থাকবে। এই সিটিতে দুজন তৃতীয় লিঙ্গেরসহ মোট ভোটার দুই লাখ ২৯ হাজার ৯২০ জন।