প্রথম দেখায় একে অনেকেই বক ভাবতে পারেন। বকের মতো লম্বাটে ঠোঁটের কারণে সহজেই আলাদা করা যায় এই পাখিকে।
এ পাখির নাম শামুকখোল। উপযুক্ত পরিবেশ, পর্যাপ্ত খাবার ও প্রজনন সুবিধার কারণে দেশের আনাচে-কানাচে এখন শামুকখোল পাখির দেখা মেলে।
জলাশয়ের পাশে এদের দেখা যায় বেশি আর আবাস গড়ে গাছের উঁচু ডালে। শীত মৌসুমে হাওর ও বিলে পরিযায়ী পাখির ঝাঁকের সঙ্গে দলবেঁধে চলতে দেখা যায় শামুকখোলকেও।
এই পাখি দেশীয় নাকি পরিযায়ী- এমন বিতর্ক রয়েছে।
বিশেষজ্ঞদের কেউ কেউ মনে করেন, এটি পরিযায়ী পাখি ছিল, এখন দেশীয় হয়ে গেছে। আবার কারও মতে, এটি এই অঞ্চলেরই পাখি।
সারা বিশ্বে এই পাখির সংখ্যা কমেছে। তবে আশার বিষয় হলো, দেশে এই পাখির সংখ্যা বেড়েছে।
বিতর্ক শুরু কবে?
শামুকখোল পাখির আদি নিবাস নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টি হয় ২০২১ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর ভয়েস অফ আমেরিকায় একটি প্রতিবেদন প্রকাশের পর। প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘আজ থেকে ২০-২৫ বছর আগেও বাংলাদেশে সহজে দেখা মিলত না এই পাখির। উপযুক্ত পরিবেশ, পর্যাপ্ত খাবার এবং প্রজনন সুবিধার কারণে এই পাখি এখন বাংলাদেশের আনাচে-কানাচে দেখা মিলছে। সেই সঙ্গে বহুগুণ বৃদ্ধিও পেয়েছে শামুকখোলের সংখ্যা।’
ওই প্রতিবেদনে পাখি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড. এস এম ইকবালের বরাত দিয়ে বলা হয়, ‘একসময় শামুকখোল পাখি মূলত আমাদের দেশে গ্রীষ্মকালে আসত। এ জন্য এদের যাযাবর কিংবা পরিযায়ী পাখি বলা হয়। এরা বাংলাদেশে তখন খুব বেশি স্থায়ীভাবে বসবাস করত না।
‘এখন শামুকখোল বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলার খাল, বিল এবং নদীর কাছাকাছি এলাকাগুলোয় স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেছে। এরা প্রজনন শেষে আর দেশের বাইরে যাচ্ছে না।’
অনলাইন বিশ্বকোষ উইকিপিডিয়া বলছে, শামুকখোল পাখি বাংলাদেশ, ভারত ছাড়াও দক্ষিণ এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার বিভিন্ন দেশে দেখা যায়।
কী বলছেন দেশের পাখি বিশেষজ্ঞরা
শামুকখোল পরিযায়ী পাখি ছিল- এমন বক্তব্যের সঙ্গে ভিন্নমত পোষণ করেছেন বাংলাদেশ বার্ডস ক্লাবের সভাপতি ইনাম আল হকের।
তিনি শনিবার নিউজবাংলাকে বলেন, ‘শামুকখোল আমাদের অঞ্চলেরই পাখি। এটি পরিযায়ী নয়। বিশ্বের আরও অনেক দেশেই এই পাখি পাওয়া যায়।
‘বিশ্বের স্বল্পসংখ্যক পাখি আছে যাদের মানিকজোড় বলা হয়। সারা বিশ্বেই এই জাতের পাখির সংখ্যা কমছে। বাংলাদেশেও সব ধরনের মানিকজোড় প্রজাতির পাখি কমছে। তবে ব্যতিক্রম শুধু শামুকখোলের ক্ষেত্রে। শামুকখোলের সংখ্যা সারা বিশ্বে কমছে।
‘আন্তর্জাতিক প্রকৃতি ও প্রকৃতি সম্পদ সংরক্ষণ সংঘ (আইইউসিএন) এ পাখিকে ন্যূনতম বিপদগ্রস্ত হিসেবে তালিকাভুক্ত করেছে। তবে আশার কথা হলো, বাংলাদেশে এই পাখির সংখ্যা কিছুটা বেড়েছে। আগে যেখানে দেখা যেত না, সেখানেও এখন এই পাখির দেখা মেলে।’
বাংলাদেশ বার্ডস ক্লাবের সভাপতি বলেন, ‘আমরা প্রতি বছরই পাখি শুমারি করি। তাতে দেখতে পাই, শামুকখোলের সংখ্যা অন্যান্য পাখির চেয়ে বেড়েছে। এমনকি ঢাকা শহরেও এখন মাঝে মাঝে শামুকখোল দেখা যায়।
‘দেশে ৭০০ প্রজাতির পাখি আছে। এর মধ্যে ৬৮০ প্রজাতির পাখিই কমছে। শামুকখোলসহ হাতেগোনা ২০টি প্রজাতির পাখির সংখ্যা বাড়ছে বলে আমরা জরিপে পেয়েছি।’
শামুকখোলের খাবার হচ্ছে- শামুক, ঝিনুক, মাছ, কাঁকড়া, ছোট জলচর প্রাণী, ব্যাঙ ইত্যাদি। এগুলোর সংখ্যা হয়তো বৃদ্ধি পেয়েছে। খাবার বৃদ্ধি ও পরিবেশ অনুকূলে থাকায় তাদের প্রজনন বেড়েছে। এ কারণে দেশের সবখানেই এখন এই পাখি দেখা যায়।
শামুকখোল দেশীয় পাখি বলেই মত আইইউসিএনের প্রধান গবেষক সীমান্ত দীপুর। তিনি নিউজবাংলাকে বলেন, ‘এটি দেশীয় প্রজাতির পাখি। জলাশয়ের পাশেই এই পাখিরা বেশি থাকে।’
টাঙ্গুয়ার হাওরে আগে এই পাখি দেখা যেত না জানিয়ে তিনি বলেন, ‘এখন টাঙ্গুয়ায়ও শামুকখোল পাখি দেখা যায়। গত বছর আমরা টাঙ্গুয়ায় প্রায় ২০০ শামুকখোল দেখেছি।’
সীমান্ত দীপু বলে, ‘দেশের সব জায়গায় পরিযায়ী পাখির সংখ্যা কমেছে, তবে টাঙ্গুয়ার হাওরে তেমন একটা কমেনি। দেশে এখন পর্যন্ত এই একটা এলাকা আছে যেখানে প্রতি বছর পাখি আসে। তবে এখানেও জীববৈচিত্র্যের অনেক পরিবর্তন হয়েছে। পাখিদের খাবার সংকট হচ্ছে।
‘অবাধে মাছ শিকার হচ্ছে, গাছপালা কাটা হচ্ছে- এগুলো পাখির ক্ষতি করে। তার হিসাবে, মেটে হাঁস, লালমাথা ভূঁতিহাঁস, কালেম পাখি, গয়ার পাখি, বক জাতীয় পাখির সংখ্যা কমেছে, আবার লালমতিয়া হাঁস, পিয়ং হাঁস, গিরিয়া হাঁস এগুলোর সংখ্যা বেড়েছে।’
কী বলছে প্রশাসন
সুনামগঞ্জের জেলা প্রশাসক জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন, ‘পাখি মৌসুমে হাওরগুলোয় আমাদের বাড়তি নজরদারি থাকে। আমরা এ বছর কোথাও শুনিনি পাখি শিকার করে নিয়ে গেছে।
‘পাখি শিকারের তথ্য জানামাত্র আমাদের টিম ঘটনাস্থলে পৌঁছে এবং দোষীদের মোবাইল কোর্টের মাধ্যমে সাজা দেয়া হয়। এ কারণে টাঙ্গুয়ায় এখনও বিপুলসংখ্যক পাখি আসছে।’