আমের জন্য দেশখ্যাত চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জের কানসাট রাজার বাগান। একসময় বাগানটিতে অনেক জাতের আম উৎপাদন হলেও দিন দিন এর অনেকটাই হারিয়ে যেতে বসেছে। প্রায় ১০০ বিঘার বাগানটি চলে গিয়েছিল বেদখলেও। স্থানীয়রা ইচ্ছেমতো বাগানের গাছের ডালপালা কেটে নিয়ে যেত। মাদকসেবীদের আস্তানাও ছিল এটি।
বেদখলে যাওয়া বাগানটি উদ্ধার করে এখন সেখানে গড়ে উঠেছে জাদুঘর। নাম দেয়া হয়েছে বঙ্গবন্ধু লাইভ ম্যাংগো মিউজিয়াম। জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে বাগানটির সীমানাপ্রাচীর ও অবকাঠামো উন্নয়নের বেশ কিছু কাজ শেষও হয়েছে এরই মধ্যে।
বাগানসংশ্লিষ্টরা বলছেন, আম চাষের জন্য উপযোগী হওয়ায় চাঁপাইনবাবগঞ্জে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে বহু জাতের আমের বাগান। সেসব আমের স্বাদ ও গন্ধে একটির থেকে আলাদা অন্যটি। তবে বর্তমান প্রজন্মের অনেকেই এ জাতগুলোর সঙ্গে পরিচিত নন।
তাই আগামীতে সংরক্ষণ ও উন্নয়নসহ আমশিল্পের বিকাশে জাতগুলো সংরক্ষণ করা জরুরি। এ লক্ষ্যেই গড়ে তোলা হচ্ছে আমের বৃহৎ জার্মপ্লাজম সেন্টার বা বঙ্গবন্ধু লাইভ ম্যাংগো মিউজিয়াম।
আম গবেষকরা বলেন, ভবিষ্যতের গবেষণা ও আমের জাত উন্নয়নে এ উদ্যোগ অবদান রাখবে। এতে বিলুপ্তির হাত থেকে রক্ষা পাবে আমের বিভিন্ন জাত। পর্যটনেও রাখবে অবদান। লাভবান হবে সবাই।
জাদুঘর নির্মাণে খুশি স্থানীয় আব্দুস সামাদ বলেন, ‘এখন জাদুঘরটি দেখতে বিভিন্ন এলাকা থেকে মানুষ ঘুরতে আসবে, এতে এলাকার পরিচিত বাড়বে। এলাকার দোকানগুলোতে নানা পণ্যের বেচাবিক্রি বাড়বে। এতে স্থানীয়দের লাভই হবে।’
চাঁপাইনবাবগঞ্জ আঞ্চলিক উদ্যানতত্ত্ব গবেষণা কেন্দ্রের মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মোখলেসুর রহমান জানান, জাদুঘরটিতে জাতির পিতার ম্যুরালসহ দৃষ্টিনন্দন ফটক নির্মাণ, পুকুর খনন, ১০০ জাতের আমের নামকরণসহ ম্যাংগোপিডিয়া প্রকাশ, আধুনিক জার্মপ্লাজমের চারা রোপণ, টপ ওয়ার্কিংয়ের মাধ্যমে পুরোনো গাছকে আধুনিক গাছে রূপান্তর, নার্সারি নির্মাণ, পর্যটকদের জন্য ছাউনির ব্যবস্থা করা হয়েছে।
তিনি আরও জানান, বাগানের মধ্যে নির্মাণ করা হয়েছে আরসিসি রাস্তা, আমজাত পণ্যের প্রদর্শনী কেন্দ্রও। প্রতি একরে ১৫ মেট্রিক টন আম উৎপাদনের লক্ষ্যে আলট্রাহাইডেন সিটি পদ্ধতিতে আম চাষের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে।
দেশ-বিদেশ থেকে আমের জাত সংগ্রহ ও জার্মপ্লাজম তৈরি হচ্ছে, যেখান থেকে আমচাষিরা উন্নত জাতের স্যাপলিং সংগ্রহ করে আম ব্যবসায় সম্প্রসারণ ঘটাতে পারবে। এ মিউজিয়ামে পাওয়া যাবে জিআই সনদপ্রাপ্ত ক্ষীরসাপাত আমের স্যাপলিং।
মোখলেসুর রহমান জানান, বিদেশি আমের কর্নারে জাপানের মিয়াজাকি, দিল্লির চোষা, আমেরিকার ব্লাকস্টার, সুমিষ্ট চিয়াং মাই অ্যাপেল ম্যাংগো ও ব্লু ম্যাংগো লাগানো হয়েছে। এ বছর বিভিন্ন প্রজাতির চারা তৈরির পরিকল্পনা রয়েছে।
তিনি বলেন, ‘আমের জাত সংরক্ষণের এমন উদ্যোগ আগামীতে গবেষণার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় ভূমিকা রাখবে। আমাদের এখানে (আঞ্চলিক উদ্যানতত্ত্ব গবেষণা কেন্দ্রে) জায়গার সংকট রয়েছে, অনেক জাত সংরক্ষণের প্রয়োজন থাকলেও অনেক সময় জায়গা না থাকার কারণে রাখতে পারি না। বঙ্গবন্ধু লাইভ ম্যাংগো মিউজিয়ামে জাতগুলো সংরক্ষণ করা হচ্ছে, সেখান থেকেও আমাদের বিজ্ঞানীরা কাজ করতে পারবেন।’
তিনি আরও বলেন, ‘গবেষণার বাইরেও জাদুঘরটি জেলার পর্যটন খাতের বিকাশে বড় ভূমিকা রাখবে। ম্যাংগো ট্যুরিজমের দুয়ার খুলবে এর মাধ্যমে।’
শিবগঞ্জ ম্যাংগো প্রডিউসার কো-অপারেটিভ সোসাইটির সেক্রেটারি ইসমাইল খান শামীম বলেন, ‘জাদুঘর থেকে আমসংক্রান্ত নানা তথ্য জেনে অনেক নতুন উদ্যোক্তার সৃষ্টি হবে। জেলার অর্থনীতিতে তারা বড় ভূমিকা রাখবে।’
শিবগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. সাকিব আল রাব্বী বলেন, বঙ্গবন্ধু লাইভ ম্যাংগো মিউজিয়ামে বর্তমানে ৫৪ থেকে ৫৫ প্রজাতির আমের জাত সংরক্ষণ করা হয়েছে।
চাঁপাইনবাবগঞ্জের জেলা প্রশাসক এ কে এম গালিভ খান বলেন, ‘জেলার আমের ঐতিহ্যকে দেশে-বিদেশে পরিচিত করা, আমকেন্দ্রিক পর্যটনের বিকাশ এবং সুস্বাদু আম রক্ষা ও জনপ্রিয় করতেই এ জাদুঘর গড়ে তোলা হচ্ছে। জাদুঘরটি ঘিরে ম্যাংগো ট্যুরিজমের মহাপরিকল্পনা রয়েছে আমাদের।’