ভূমি অধিগ্রহণে প্রতারণার দায়ে শরীয়তপুরের জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের এলএ শাখার সার্ভেয়ার মোশারফ হোসেনকে সাময়িক বরখাস্তে সুপারিশ করা হয়েছে।
জেলা প্রশাসক মো. পারভেজ হাসান মঙ্গলবার বিভাগীয় কমিশনার বরাবর চিঠি দিয়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণের অনুরোধ জানান। তার বিরুদ্ধে সরকারি কর্মচারী (শৃঙ্খলা ও আপিল) বিধিমালা ২০১৮ অনুযায়ী বিভাগীয় ব্যবস্থা নেয়ার সুপারিশ করা হয়েছে।
চিঠিতে সার্ভেয়ার মোশারফের বিরুদ্ধে পদ্মা সেতু থেকে শরীয়তপুর শহর পর্যন্ত প্রস্তাবিত চার লেন সড়কে ভূমি অধিগ্রহণ কাজে প্রতারণা করে মানুষের কাছ থেকে টাকা হাতিয়ে নেয়ার প্রমাণ পাওয়ার উল্লেখ করা হয়েছে।
বৃহস্পতিবার নিউজবাংলাকে বিষয়টি নিশ্চিত করেন শরীয়তপুরের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) আসমাউল হুসনা লিজা।
জেলা প্রশাসক কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, ১ হাজার ৬৮২ কোটি টাকা ব্যয়ে পদ্মা সেতুর সংযোগ সড়ক থেকে শরীয়তপুর জেলা শহর পর্যন্ত সংযোগ সড়ক নির্মাণ প্রকল্পের কাজ চলমান। ২৭ কিলোমিটার দীর্ঘ সড়ক নির্মাণের জন্য ১০৫ হেক্টর জমি অধিগ্রহণের কাজ শুরু করে জেলা প্রশাসন। মোট ২১টি এলএ কেসের মাধ্যমে জমি অধিগ্রহণ কার্যক্রম চলছে। এর মধ্যে ৬টি এলএ কেসের যৌথ তদন্তের কাজ শেষ হয়েছে। বাকি এলএ কেসের স্থাপনার তালিকা প্রস্তুত করছে সড়ক ও জনপথ বিভাগ এবং জেলা প্রশাসনের ভূমি অধিগ্রহণ শাখা।
জমি অধিগ্রহণের খবরে অতিরিক্ত অর্থ হাতিয়ে নিতে অধিগ্ৰহণকৃত জমিতে নতুন করে শতাধিক স্থাপনা তৈরি করে একটি সংঘবদ্ধ চক্র। যৌথ তদন্তে নতুন করে নির্মিত সব স্থাপনার নাম তালিকা থেকে বাদ করে জেলা প্রশাসন। তখনই সক্রিয় হয়ে ওঠেন ভূমি অধিগ্রহণ শাখার সার্ভেয়ার মোশারফ হোসেন।
এলএ কেসের যৌথ তদন্তে বাদ পড়া ঘরের মালিকদের মোটা অঙ্কের টাকার বিনিময়ে তালিকাভুক্ত করে ক্ষতিপূরণের টাকা পাইয়ে দেয়ার আশ্বাস দেন মোশারফ। অতিরিক্ত টাকা পাওয়ার আশায় জমির মালিকরাও চুক্তিবদ্ধ হন তার সঙ্গে।
গত ৩০ এপ্রিল মোশারফ হোসেনকে শরীয়তপুর থেকে গাজীপুরে বদলি করা হয়। বিষয়টি সামনে এলে শিবচরের কুতুবপুর এলাকার মো. শাকিল ১৫ থেকে ২০ জন নতুন করে নির্মিত স্থাপনার মালিকদের নিয়ে জেলা প্রশাসক বরাবর অভিযোগ করেন।
অভিযোগে অধিক ক্ষতিপূরণের টাকা পাইয়ে দেয়ার কথা বলে মোশারফ হোসেন তার কাছ থেকে ১৫ লাখ টাকা নিয়েছেন বলে উল্লেখ করেন শাকিল। মোশারফের সঙ্গে হওয়া একটি চুক্তিনামাও অভিযোগপত্রের সঙ্গে জমা দেন তিনি। চুক্তিনামায় আগামী ১৫ জুনের মধ্যে শাকিলের কাছ থেকে নেয়া ১৫ লাখ টাকা ফেরত দেবেন বলে অঙ্গীকার করেন মোশাররফ। প্রাপ্ত টাকার বিপরীতে মোশারফের স্ত্রী সালমা আক্তার বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংক ঢাকার মৌচাক শাখার নামে ১৫ লাখ টাকার একটি চেক দেন শাকিলকে।
বিষয়টি জেলা প্রশাসককে জানালে তিনি সব ডকুমেন্ট যাচাই-বাছাই করে ঘটনার সত্যতা পান। বুধবার তিনি মোশারফকে সাময়িক বরখাস্ত ও তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেয়ার সুপারিশ করে ঢাকা বিভাগীয় কমিশনারকে চিঠি দিয়েছেন।
অভিযোগকারী শিবচরের কুতুবপুর এলাকার মো. শাকিল বলেন, ‘আমাদের বিভিন্ন আত্মীয়স্বজনের জমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে। সেখানে থাকা কিছু স্থাপনা ক্ষতিপূরণের তালিকায় ওঠেনি। সার্ভেয়ার মোশারফ ওই স্থাপনা তালিকায় উঠিয়ে দেয়ার কথা বলে ১৫ লাখ টাকা নিয়েছেন। তা না দিয়েই তিনি গাজীপুরে বদলি হয়ে যাচ্ছিলেন।’
শরীয়তপুরের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) আসমাউল হুসনা লিজা নিউজবাংলাকে বলেন, ‘মোশারফ হোসেন জমি অধিগ্রহণের কাজে গিয়ে অনিয়ম করছিলেন এমন মৌখিক অভিযোগ পাওয়া যায়। সতর্ক করার পরও তিনি সংযত হননি। তখন তাকে বদলির উদ্যোগ নেয়া হয়।
‘বদলি হওয়ার খবর পেয়ে যারা তাকে টাকা দিয়েছিলেন, তারা এলএ শাখায় ভিড় করেন। বিষয়টি নজরে এলে আমরা কিছু ডকুমেন্ট হাতে পাই। তা বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, মোশারফ প্রতারণা করে মানুষের কাছ থেকে টাকা নিয়েছেন। এতে জেলা প্রশাসনের ভাবমূর্তি মারাত্মকভাবে ক্ষুণ্ন হয়েছে।’
শরীয়তপুরের জেলা প্রশাসক পারভেজ হাসান নিউজবাংলাকে বলেন, ‘সার্ভেয়ার মোশারফ বিভিন্ন মানুষের কাছ থেকে টাকা নেন এবং মানুষকে হয়রানি করেন এমন খবর পেয়ে তাকে ওএসডি করে রাখা হয়েছিল। কিন্তু তার বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়ার মতো কোনো তথ্য-প্রমাণ আমাদের কাছে ছিল না। এক ব্যক্তির কাছ থেকে ১৫ লাখ টাকা নেয়ার কিছু ডকুমেন্ট হাতে আসার পর তাকে বরখাস্ত ও বিভাগীয় মামলা করার সুপারিশ করেছি।
‘মোশারফের বিরুদ্ধে এর আগে দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) দুটি মামলা হয়েছিল। তার একটিতে তিনি কারাগারে গিয়েছিলেন। সাময়িক বরখাস্তও হয়েছিলেন।’
এ বিষয়ে বক্তব্য জানতে সার্ভেয়ার মোশারফ হোসেনের মোবাইল ফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করেও তাকে পাওয়া যায়নি। একাধিকবার ফোন করলেও তিনি ফোন ধরেননি। খুদেবার্তা দিয়ে বিষয়টি সম্পর্কে জানতে চাইলেও তিনি সাড়া দেননি।