অলি আহমদের রাজনৈতিক অবস্থান নিয়ে প্রশ্ন তুলে তার গড়া এলডিপি থেকে সরে গেছেন দুই শতাধিক নেতা-কর্মী, যাদের মধ্যে আছেন একজন সহসভাপতি এবং একজন যুগ্ম মহাসচিবও।
তাদের অভিযোগ, অলি আহমদ বিএনপি থেকে বের হয়ে যে কথা বলে এলডিপি গঠন করেছিলেন, সেই লক্ষ্য থেকে তিনি বিচ্যুত হয়েছেন। তার দলে গণতন্ত্র নেই। তিনি নিজের মনমতো কাজ করেন, একজন মুক্তিযোদ্ধা হয়েও মুক্তিযুদ্ধবিরোধী দলের সঙ্গে সম্পর্ক রাখেন, তিনি বিএনপির বিরুদ্ধে ক্রমাগত কথা বলেন।
বৃহস্পতিবার দুপুরে পদত্যাগকারী এলডিপির সহসভাপতি আবু জাফর সিদ্দিকী এবং যুগ্ম মহাসচিব তমিজউদ্দিনের যৌথ স্বাক্ষরিত গণমাধ্যমে পাঠানো এক বিজ্ঞপ্তিতে পদত্যাগের বিষয়টি জানানো হয়।
পদত্যাগকারীদের ভাষ্য, তারা বড় বড় রাজনৈতিক দলে যোগদানের প্রস্তাব পেয়েছেন। শিগগিরই পছন্দসই দলে যোগ দেবেন।
অন্যদিকে এলডিপির দাবি, যারা পদত্যাগ করেছেন তারা দুষ্কৃতকারী।
বিএনপির প্রতিষ্ঠাকালীন নেতা অলি আহমদ ২০০১ সালে ধানের শীষ প্রতীক নিয়ে একটি আসনে জিতলেও এক জামায়াত নেতার কাছে অন্য একটি আসনে হেরে যান। ওই আসনটি বিএনপি আনুষ্ঠানিকভাবে উন্মুক্ত করে দিয়েছিল।
বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে একপর্যায়ে সরকারের বিরুদ্ধে বক্তব্য দিয়ে আলোচনায় আসেন তিনি। সে সময় তিনি জামায়াতকে যুদ্ধাপরাধীদের দল আখ্যা দিয়ে বিএনপির রাজনৈতিক অবস্থানের বিপরীতে অবস্থান নেন।
সে সময় বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া ও তার ছেলে তারেক রহমানকে দুর্নীতিবাজ উল্লেখ করে গণমাধ্যমে বক্তব্য রাখেন অলি আহমদ। স্বাধীনতাবিরোধী উল্লেখ করে জামায়াতেরও কঠোর সমালোচনা করতে থাকেন নিয়মিত।
একপর্যায়ে বিএনপি সরকারের শেষ বছরে ২০০৬ সালে এলডিপি নামে দল গঠন করে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে মহাজোটে যোগ দেন। তবে জরুরি অবস্থা জারির পর ২০০৮ সালে যে নির্বাচন হয়, তাতে আর আওয়ামী লীগের সঙ্গে সমঝোতা হয়নি এলডিপির।
ওই নির্বাচনে অলি নিজেদের প্রতীক ছাতা নিয়ে চট্টগ্রামের চন্দনাইশ থেকে নির্বাচিত হন নিজের শক্তিতে। তবে পরে বিএনপির নেতৃত্বাধীন জোটে যোগ দেন। পাশাপাশি জামায়াতের পক্ষেও কথা বলতে থাকেন।
এলডিপি থেকে সরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত জানিয়ে আবু জাফর সিদ্দিকী নিউজবাংলাকে বলেন, ‘দীর্ঘদিন ধরে দলের মধ্যে গণতন্ত্র চর্চা হচ্ছিল না। যে কারণে আমরা পদত্যাগ করেছি। আমাদের বড় বড় দলের পক্ষ থেকে অফার রয়েছে। এখনও কোনো সিদ্ধান্ত নিইনি। আমরা বসে সিদ্ধান্ত নেব। আমরা কোন দলে যোগ দেব।’
ক্ষমতাসীন বলয় থেকে এখনো কোনো অফার পাননি বলে জানান তিনি।
পদত্যাগী এই নেতাদের দুষ্কৃতকারী আখ্যা দিয়ে এলডিপি বলেছে, তারা সরে যাওয়ায় দল পূতপবিত্র হয়েছে।
এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে আবু জাফর সিদ্দিকী বলেন, ‘এতেই অলি আহমদের মানসিকতা ফুটে ওঠে। রাজনীতি করার অধিকার সবার আছে। আমরা পদত্যাগকারীরা যদি দুষ্কৃতকারী হই, অলি সাহেবও বিএনপি থেকে পদত্যাগ করেছিলেন। তা হলে তিনিও কি দুষ্কৃতকারী? এটা আমার প্রশ্ন।’
তিনি বলেন, ‘অলি আহমদের বয়স হয়েছে। আমাদের জন্য তিনি দোয়া করবেন। তাকে আমরা শ্রদ্ধা করি।’
অলির বিরুদ্ধে যেসব অভিযোগ
পদত্যাগকারীদের বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ২০০৬ সালে অলি আহমদের নেতৃত্বে বিএনপি থেকে বের হয়ে এলডিপির আত্মপ্রকাশের পর থেকে দলটির সঙ্গে সক্রিয় হন তারা। দল প্রতিষ্ঠার কেটে গেছে দীর্ঘ ১৬ বছর। এই দীর্ঘ সময়ে বাংলাদেশের রাজনীতিতে যেমন উত্থান-পতন এসেছে, তেমনি পাল্লা দিয়ে ক্রমাগত ‘অবস্থান পরিবর্তন’ করে গেছেন অলি আহমদ।
এতে বলা হয়, ‘নিয়মিত বিরতিতে রাজনৈতিক অবস্থান পাল্টানোর কারণে ইতোমধ্যে দলের প্রতিষ্ঠালগ্নের জ্যেষ্ঠ নেতারা তার নেতৃত্ব ত্যাগ করেছেন। দুর্ভাগ্যক্রমে এই ধারা থেকে এলডিপির সভাপতি অলি আহমদ সরে আসেননি, বরং দিনে-দিনে একটি সুপরিচিত রাজনৈতিক দলকে তিনি ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে এনে দাঁড় করিয়েছেন।’
বিবৃতিতে বলা হয়, ‘বাংলাদেশের সব রাজনৈতিক দল ও গণতন্ত্রপন্থি মানুষেরা যখন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের একদলীয় শাসনব্যবস্থার বিরুদ্ধে কার্যকর গণপ্রতিরোধ গড়ে তোলার সংগ্রামে সক্রিয়, তখনও অলি আহমদ তার নেতৃত্বের পুরো ক্ষমতা কাজে লাগিয়ে এলডিপিকে একটি রহস্যজনক রাজনৈতিক দল হিসেবে ব্যবহার করছেন।’
অলির বিরুদ্ধে নাম উল্লেখ না করে জামায়াতের সঙ্গে মেলামেশার প্রতিও ইঙ্গিত করা হয় বিবৃতিতে। এতে বলা হয়, ‘বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটের শরিক হয়ে ১০ বছর ধরে জোটবিরোধী কার্যক্রম করেছেন। অবস্থান নিয়েছেন জাতীয়তাবাদী শক্তির বিরুদ্ধে। মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় একজন মুক্তিযোদ্ধা হয়েও একটি বিশেষ দলের সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠতা দেখা গেছে চরমমাত্রায়, যা এলডিপির রাজনৈতিক আদর্শ ও লক্ষ্যকে দলিত-মথিত করে ফেলেছে। রাজনৈতিক অঙ্গনে এলডিপি একটি হাস্যকর প্রতিক্রিয়ায় পরিণত হয়েছে।’
কোন দলের বিষয়ে ইঙ্গিত করছেন- জানতে চাইলে আবু জাফর সিদ্দিকী নিউজবাংলাকে বলেন, 'উনি বলতেন, জামায়াতকে পছন্দ করেন না। কয়েক দিন আগে দেখি আবার জামায়াতের সেক্রেটারির সঙ্গে উনি মিটিং করছেন। এখন আপনি কী করবেন?’
অলি আহমদকে কর্তৃত্ববাদী মনোভাবের বলেও উল্লেখ করা হয় এতে। বলা হয়, “দল পরিচালনার ক্ষেত্রে অলি আহমদ চূড়ান্ত অর্থে ‘কর্তৃত্ববাদী ও আত্মঅহংকারে’ নিমগ্ন একজন মানুষ। অথচ জাতীয়তাবাদী শক্তির আধার হিসেবে শত শত তরুণ-যুবক ও রাজনীতিক তার নেতৃত্বের ছায়াতলে এসেছিল। কিন্তু দিন যত বয়েছে, তার পরিবর্তিত রূপ দেখে নেতাকর্মীরা হতাশ হয়েছে, ভেঙে পড়েছে।
“তিনি তার মনমতো দলীয় পদ ব্যবহার করেছেন, বাঁটোয়ারা করেছেন। নিজের মনমতো পদে বসিয়েছেন, পদ থেকে সরিয়েছেন। একটি গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দলের ন্যূনতম যে অঙ্গীকার থাকে, তা তিনি স্পষ্টরূপে দীর্ঘদিন ধরে ব্যত্যয় করে এসেছেন।”
অলি বিএনপির বিরুদ্ধে বিষোদগার করেন, এমন অভিযোগও আনা হয়েছে। বিবৃতিতে বলা হয়, ‘জাতীয়তাবাদী ঘরানার রাজনৈতিক দল হিসেবে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল-বিএনপি হচ্ছে এই চেতনার সূতিকাগার। কিন্তু মতের অমিলের কারণে বিএনপির নেতৃত্বের প্রতি নিয়মিত বিষোদ্গার অলি আহমদের নিত্যদিনের অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। বেশ কিছুদিন ধরে তিনি দক্ষিণপন্থি রাজনৈতিক দলগুলোর সমন্বয়ে নতুন একটি জোট গঠনের প্রচেষ্টা করছেন, যা স্পষ্টত জাতীয়তাবাদী শক্তির প্রতি প্রশ্নবিদ্ধ অঙ্গুলিহেলনের নামান্তর।’
যা বলছে এলডিপি
অলির বিরুদ্ধে এসব অভিযোগ এনে দুই শতাধিক নেতা-কর্মীর পদত্যাগের ঘটনায় দলটির যুগ্ম মহাসচিব সালাউদ্দিন রাজ্জাকের স্বাক্ষরিত একটি বিজ্ঞপ্তিতেও এসেছে।
এতে বলা হয়, ‘অলি আহমদ বীর বিক্রম ও ডক্টর রেদোয়ান আহমদ এ দলের মূল আকর্ষণ। তাদের নেতৃত্বে অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে এলডিপি আরও সংগঠিত ও শক্তিশালী।’
এতে বলা হয়, পদত্যাগকারী বেশ কয়েকজন নেতা দীর্ঘদিন ধরে আমেরিকায় অবস্থানরত অবৈধ প্রবাসীদের কাছে অর্থের বিনিময়ে এলডিপি সভাপতির নকল করে পদ বিক্রি করে আসছেন। বিষয়টি কর্নেল অলি আহমদের দৃষ্টিগোচর হলে তিনি এই নেতাদের দলীয় কার্যক্রম থেকে বিরত থাকার নির্দেশ দেন। তাছাড়া এরা অনেকেই দুই বছর যাবৎ দলীয় কার্যক্রমে অংশ নেন না।
বিবৃতিতে বলা হয়, ‘এরা এলডিপি থেকে বিদায় নেয়ায় এলডিপি পূতপবিত্র হয়েছে। সারা দেশে এলডিপির লাখ লাখ নেতাকর্মী। যারা দল ছেড়েছে এদের চলে যাওয়ায় দলের কিছু যায় আসে না। এলডিপি থেকে অতীতে যারা বিদায় নিয়েছে তারা কেউ রাজনীতিতে প্রতিষ্ঠিত হতে পারেনি, এরাও পারবে না।’