দফায় দফায় কালবৈশাখী ঝড়ে নুয়ে পড়েছিল বিভিন্ন জেলার ক্ষেতের কাঁচা ও আধাপাকা ইরি-বোরো ধান। এর মধ্যে আবার ঘূর্ণিঝড় আসানির প্রভাবে বৃষ্টিতে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এসব ধান।
ধান কাটার আগ মুহূর্তে এমন প্রাকৃতিক দুর্যোগে ইতোমধ্যে ক্ষতির মুখে মেহেরপুর, নওগাঁ, পিরোজপুর ও শেরপুরের কৃষকরা। এর মধ্যেই ‘মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা’ হয়ে দাঁড়িয়েছে শ্রমিক সংকট।
বৈরী আবহাওয়ায় শ্রমিক সংকটে অনেক জমির পাকা ধান সংগ্রহ করতে পারছে না বলে জানিয়েছেন চাষিরা। আর শ্রমিক পাওয়া গেলেও মাঠ থেকে মাড়াই শেষ করে ধান ঘরে তুলতে গুনতে হচ্ছে বাড়তি খরচ। এমন পরিস্থিতিতে কাটা ধান মাঠেই ফেলে রাখতে হচ্ছে অনেক কৃষককে। এতে লোকসানের আশঙ্কায় রয়েছেন তারা।
কৃষি বিভাগ বলছে, বৈরী আবহাওয়ায় পাকা ধান কাটতে কৃষকরা বিপাকে পড়েছেন ঠিকই, তবে আর ঝড়-বৃষ্টি না হলে বড় ক্ষয়ক্ষতি ছাড়াই মাঠের ধান কাটা হয়ে যাবে।
মেহেরপুরের জোড়পুকুর গ্রামের কৃষক আব্দুল মতিন নিউজবাংলাকে বলেন, ‘১৬ বিঘা জমিতে ধান আবাদ করেছি। শ্রমিক সংকট থাকায় গত দুই দিন আগে ৭ বিঘা জমির ধান কেটে মাঠেই ফেলা রাখা ছিল। কিন্তু বেশির ভাগ ধান বৃষ্টির কারণে মাঠেই পানির নিচে ডুবে আছে। ঠিকমতো শ্রমিক পাচ্ছি না। এমনভাবে থাকলে ধানে গজ বের হয়ে যাবে।’
ধান চাষি করিম বলেন, ‘আমার ধান উঁচু জায়গায় থাকায় তেমন একটা ক্ষতি না হলেও ধান মাড়াই করতে এসে বিপদে পড়ে গেছি। এক বিঘা জমির ধান কাটা থেকে মাড়াই করতে পাঁচ হাজার টাকা লাগছে। যেখানে লাগার কথা তিন থেকে সাড়ে তিন হাজার টাকা।’
স্বপন বলেন, ‘বৃষ্টিতে মাঠে কেটে রাখা ধান নিয়ে বিপাকে পড়ে গেছি। কেটে রাখা ধান এখন পানির নিচে। বেশি সময় ধরে পানি জমে থাকলে ধান থেকে চারা বের হয়ে যাবে। এখন শ্রমিক সংকটও দেখা দিয়েছে। ধান মাড়াইয়ের জন্য বাড়তি খরচ গুনতে হচ্ছে।’
মেহেরপুর কৃষি বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, জেলায় ৩০ শতাংশ ধান কাটা-মাড়াই হয়েছে। এখনও ৭০ শতাংশ জমির ধান মাঠেই রয়েছে। জেলায় চলতি মৌসুমে ১৯ হাজার হেক্টর জমিতে বোরো ধানের চাষ হয়েছে। ধানের উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৭৭ হাজার মেট্রিক টন।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক শস্য কৃষিবিদ কামরুজ্জামান নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমারা কৃষি বিভাগের পক্ষ থেকে সব সময় চাষিদের বলেছি ধান আধাপাকা হলেই কেটে ফেলতে। কারণ প্রাকৃতিক দুর্যোগ বলেকয়ে আসে না। যেসব ধান মাঠে কেটে রাখা ছিল তা পানিতে ডুবে গেছে, সে জমিগুলোর পানি দ্রুত অপসারণ করতে হবে। ধান কাটলে উঁচু জায়গায় পালা দিয়ে পলিথিনে ঢেকে দিতে হবে।’
নওগাঁর রাণীনগর উপজেলার ভেনলা গ্রামের সন্তোস কুমার বলেন, ‘পাঁচ বিঘা জমিতে কাটারি ভোগ জাতের ধান করেছি। গত মাসের ১৯ তারিখের ঝড় আর গত দুই দিনের বৃষ্টিতে ধান এখন পানির নিচে। শ্রমকিও পাচ্ছি না যে এক দিনে ধানগুলো কেটে মাড়াই করে ঘরে তুলব।’
প্রায় আট বিঘা জমিতে বিআর২৮ জাতের ধান চাষ করেছেন আত্রাই উপজেলার ভোপাড়া গ্রামের কৃষক আবু তাহের। নিউজবাংলাকে তিনি বলেন, ‘আর ১০ থেকে ১২ দিন পর ধানগুলো কাটা যাবে। কিন্তু ঝড় ও বৃষ্টির কারণে জমির ধান নুইয়ে পড়েছে। এভাবে ঝড়-বৃষ্টি হলে ফলন কমে যাবে। মহাবিপদে পড়ে গেছি, শ্রমিকও পাওয়া যাচ্ছে না ঠিকমতো।’
বদলগাছী উপজেলার মিঠাপুর গ্রামের কৃষক মাসুদ দেওয়ান বলেন, ‘ধানের আবাদ করেই সংসার চলে। এবার যে পরিস্থিতি, তাতে করে মনে হয় লোকসান গুনতে হবে। ঝড়ে ধান তো মাটিতে নুইয়ে পড়েছে। আবার গত দুই দিনের বৃষ্টিতে জমিতে পানি জমে গেছে। আজও (বুধবার) সকাল থেকে বৃষ্টি হচ্ছে।’
মান্দা উপজেলার মৈনম গ্রামের কৃষক উজ্জল কুমার ধান করেছেন ৬ বিঘা জমিতে। লোকসানের চিন্তার ভাঁজ তার কপালেও। বলেন, ‘এত শ্রম দিয়ে ধান করেছি। এখন কাটার সময় ঝড়-বৃষ্টি হলে তো লোকসানই গুনতে হবে।’
তিনি আরও বলেন, ‘প্রতি বিঘায় হাল চাষ খরচ ১ হাজার ২০০ টাকা, সেচ খরচ দেড় হাজার টাকা, চারা রোপণ খরচ এক হাজার টাকা এবং কীটনাশক ও সার খরচ প্রায় ৫ হাজার টাকা। এ ছাড়া ধান কাটা ও মাড়াই খরচ ৬ থেকে ৭ হাজার টাকা। সবমিলে ১৬ থেকে ১৭ হাজার টাকা খরচ হয়।’
‘দুই বিঘা জমির ধান কেটেছি। প্রতি বিঘায় ফলন হয়েছে ১৬ মণের মতো। বর্তমানে প্রতি মণ ধানের দাম ৮০০ থেকে ৯০০ টাকার মতো। সে হিসাবে বিঘাপ্রতি ৫ থেকে ৬ হাজার টাকা লোকসান। ঝড়-বৃষ্টির কারণে ফলন কম, উৎপাদন খরচ বেশি। সবমিলে লাভ হবে না’ যোগ করেন তিনি।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক কৃষিবিদ শামছুল ওয়াদুদ নিউজবাংলাকে বলেন, ‘জেলার মাঠের ৮০ শতাংশ ধান পেকে গেছে। ইতোমধ্যে ৪০ শতাংশ ধান কাটা ও মাড়াই হয়েছে। চলতি মাসের মধ্যে সব ধান কাটা শেষ হবে বলে আশা করছি।’
শ্রমিক সংকটের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘শ্রমিক সংকটে কৃষকদের কিছুটা সমস্যা হচ্ছে এটা সত্য। ধান কাটার জন্য বাড়তি মজুরিও গুনতে হচ্ছে। তবে আর ঝড়-বৃষ্টি না হলে কোনো ক্ষয়ক্ষতি ছাড়াই মাঠের ধান কাটা হয়ে যাবে বলে আশা করছি।’
পিরোজপুর সদর উপজেলার ঝনঝনিয়া গ্রামের কৃষক হাসান ফকির বলেন, ‘এ বছর পাঁচ বিঘা জমিতে ধান করছি। আল্লাহ দিলে ভালো ফলন হয়েছে। কিন্তু ধান যে কাটব সে ব্যবস্থা নেই। গতবারের মতো এবারও লোক (শ্রমিক) পাচ্ছি না, যা পাই তাদের এক হাজার থেকে বারো শ টাকা দিতে হয়, যা আমার পক্ষে দেয়া সম্ভব নয়।
‘এখন আসল ঘূর্ণিঝড়, এতে ফসল যা হয়েছে তাও নষ্ট হয়ে যাবে। কোনো মতে ছোট ছোট ছেলেমেয়েসহ পরিবার নিয়ে ধান কাটতে নামছি।’
একই গ্রামের বিল্লাল বলেন, ‘গত কয়েক দিনের বৃষ্টিতে জমির সব ধান শুয়ে পড়ছে। আমার জমিতে হাঁটুসমান পানি। ধানগুলো কাটতেও পারছি না। শ্রমিক নাই, এটাও বড় সমস্যা এখানে।’
সদর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা শিপন চন্দ্র ঘোষ বলেন, ‘পিরোজপুরে এবার ২৭ হাজার ৫০০ হেক্টর জমিতে ধানের আবাদ হয়েছে। এ বছর ভালো ফলন হলেও বৃষ্টিতে ধান কাটতে কৃষকরা বাধাগ্রস্ত হচ্ছেন, তবে খুব বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবেন না।
‘কৃষি অফিস থেকে আগেই ঘূর্ণিঝড়ের বার্তা কৃষকদের মাঝে পৌঁছে দিয়েছি। তাই তারা ক্ষতি হওয়ার আগেই মাঠের ৮০ ভাগ ধান কেটে ফেলেছে। এখন মাঠে যে ধান আছে আশা করি, দুই-তিন দিনের মধ্যে কাটা হয়ে যাবে।’
শেরপুর সদর উপজেলার সুলতানপুর গ্রামের কৃষক রহিম মিয়া বলেন, ‘এ বছর আমাগোর ফসলের উফর খুব দুর্যোগ যাইতাছে। এর আগে শিলাবৃষ্টি এসে বেশ ক্ষতি করেছে। যে পরিমাণ ধান ফলন আশা করেছিলাম এর অর্ধেক অবো এহন। তাও তো ধান কাটবারই পাইতাছি না। হাজার-বারো শ টেহা করে কামলা নিয়া ধান কাইটা তো পুষতাছে না। নোকসান যাইতাছে।’
ঝিনাইগাতীর পাইকুড়া গ্রামের কৃষক রফিক মিয়াও জানালেন বিপাকের কথা। নিউজবাংলাকে বলেন, ‘এবারের মতো কামলার দাম এত চড়া জীবনেও দেহি নাই। এডা কামলা নিবার গেলে ১২০০ টেহা নাগে। এত বেশি টেহা দিয়ে কামলা নিয়া ধান কাটা পুষতাছে না। এ রহম চলতে থাকলে ধান চাষ করা বাদ দেওন নাগব।
নালিতাবাড়ীর কৃষক মফিজল মিয়া বলেন, ‘এক কুর জমির ধান কামলা দিয়ে কাটলে ১১ হাজার টেহা খরচ অয়। মেশিন দিয়ে কাটলে ৬-৭ হাজার টেহা খরচ অয়। কিন্তু মেশিন তো পাওয়াই যায় না। যহন আকাশে মেঘের ডাক দেয়, তহন তো আমাগো আত্মার মধ্যে পানি তাহে না। এবার মেঘ, বৃষ্টি ও ঝড়ের ভাব বেশি। তাই তাড়াতাড়ি ধান কাইটা ঘরে নিবার পাইলে বাঁচি।’
কৃষি বিভাগ জানিয়েছে, চলতি মৌসুমে শেরপুরে ৯১ হাজার পাঁচ শ হেক্টর জমিতে বোরো ধানের আবাদ করা হয়েছে। ইতোমধ্যে ধান কাটা শুরু হয়েছে। শ্রমিক সংকট থাকলেও ৪৫ ভাগ ধান কাটা শেষ। বাকি ধান কাটতে আরও ২০ দিনের মতো সময় লাগবে।
শেরপুর জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক ড. মুহিত কুমার দে নিউজবাংলাকে বলেন, ‘জেলায় ৫৬টি হারভেস্টিং মেশিন দিয়ে ধান কাটা হচ্ছে। আরও কয়েকটি যুক্ত করা হচ্ছে। এ ছাড়া উত্তরবঙ্গের শ্রমিকরা আসতে শুরু করেছেন। কাজেই শ্রমিক সংকট দ্রুতই কমে যাবে।’
প্রতিবেদন তৈরিতে তথ্য দিয়েছেন মেহেরপুর, নওগাঁ, পিরোজপুর, শেরপুর প্রতিনিধি।