খুলনা শহর থেকে প্রায় ৬০ কিলোমিটার দূরে বিল খুলশী ও বিল ডাকাতিয়ার মাঝামাঝি প্রত্যন্ত এক গ্রাম ময়নাপুর। ডুমুরিয়া উপজেলার ধামালিয়া ইউনিয়নের এই গ্রামটিতে আছে একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। বর্তমানে এই স্কুলে শিক্ষার্থীর সংখ্যা মাত্র একজন। দ্বিতীয় শ্রেণির ওই ছাত্রের নাম অর্পণ সরকার।
ময়নাপুর গ্রামে এখন ৩ থেকে ৫ বছর বয়সী ৭ জন শিশু আছে। আশা করা হচ্ছে, তারাই আরেকটু বড় হয়ে এই বিদ্যালয়ে পড়বে।
এ অবস্থায় পর্যাপ্ত শিক্ষার্থী না থাকায় জেলা শিক্ষা অফিস ইতোমধ্যেই বিদ্যালয়টি বন্ধ করে দিতে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন করেছে। তবে সীমিত শিক্ষক দিয়ে হলেও বিদ্যালয়টি চালু রাখার জোর দাবি স্থানীয়দের।
বুধবার দুপুরে ওই বিদ্যালয়ে গিয়ে দেখা যায়, সরকারি কোনো ছুটির দিন না হলেও সেখানে কোনো শিক্ষার্থী, এমনকি কোনো শিক্ষকও নেই। তিনটি তালাবদ্ধ কক্ষ। বিদ্যালয়ের বারান্দায় এক কৃষক দম্পতি ধান মাড়াই করছেন। আর বিদ্যালয়েরই একটি কক্ষে তাদের কৃষি মালামাল রেখেছেন।
কৃষক বরুন মণ্ডল বলেন, ‘এই স্কুল আমাদের বাড়ির একেবারে সীমানাঘেঁষা। বলা যায়, আমাদের বাড়ির উঠান এই বিদ্যালয়টির মাঠ।’
বরুন জানান, স্কুলটিতে একসময় ৬০ থেকে ৮০ জন ছেলেমেয়ে একসঙ্গে লেখাপড়া করেছে। কিন্তু এখন আর এই স্কুলে ছেলেমেয়েরা পড়তে আসে না। মাঝেমধ্যে শিক্ষকরা এসে দুয়েকজনকে পড়িয়ে আবার চলে যান। গত দুই বছর ধরেই এমনটি চলছে।
দেয়ালের এক পাশে লেখা রয়েছে, বিদ্যালয়টি ১৯৯১ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। এ ছাড়া বর্তমান ভবনটি ২০০৮ সালে খুলনা জেলা পরিষদের অর্থায়নে তৈরি করা হয়। ইটের তৈরি এই ভবনটির ছাউনিতে রয়েছে টিন শেড। আর মোট কক্ষ চারটি।
স্কুলের বারান্দায় এক কৃষক দম্পতি ধান মাড়াইয়ের কাজ করছেন। ছবি: নিউজবাংলা
বিদ্যালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক স্বপ্না রানীর বাড়িতে গিয়ে তাকে না পাওয়া গেলেও কথা হয় মুঠোফোনে। নিউজবাংলাকে তিনি বলেন, ‘১৯৯১ সালে প্রতিষ্ঠার সময় থেকে আমি ওই বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করি। একসময় বিনা বেতনে পড়িয়েছি। এখন সরকারি বেতন পাই।
তিনি জানান, স্থানীয়দের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে তৎকালীন সংসদ সদস্য সালাহউদ্দীন ইউসুফ বিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। প্রথম দিকে এর নাম ছিল গ্রামীণ প্রাথমিক বিদ্যালয়। তখন সরকারের অর্থায়নে একটি পাকা ভবন নির্মাণ করা হয়েছিল। দীর্ঘদিন পর ওই ভবনটির বারান্দায় স্থায়ীভাবে পানি জমতে শুরু করে।
এ অবস্থায় ২০০৮ সালে সংসদ সদস্য নারায়ণ চন্দ্র চন্দ জেলা পরিষদের মাধ্যমে একটি আধাপাকা ভবন নির্মাণ করেন। বর্তমানে এই ভবনেই চলে বিদ্যালয়ের কার্যক্রম। ২০১৩ সালে বিদ্যালয়টিকে জাতীয়করণ করা হয়।
প্রধান শিক্ষক জানান, প্রথমদিকে এই বিদ্যালয়ে প্রায় শতাধিক শিক্ষার্থী ছিল। এমনকি ২০১৫ সালেও এখানে প্রায় ৬০ থেকে ৭০ জন শিক্ষার্থী ছিল। তবে পার্শ্ববর্তী গ্রামে ভালো অবকাঠামোতে একটি বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হলে এই বিদ্যালয়টির শিক্ষার্থী কমতে শুরু করে।
এ ছাড়া ময়নাপুর গ্রামে পরিবার আছে ২৯টি। গত ৭ বছর ধরে এখানে খুব বেশি শিশুর জন্ম নেয়নি। সর্বষেশ গত করোনার পর কয়েকটি পরিবারে সন্তান জন্ম নিয়েছে। এখন এই গ্রামে ৩ থেকে ৫ বছর বয়সী ৭ জন শিশু আছে। আশা করা হচ্ছে, তারাই আরেকটু বড় হয়ে এই বিদ্যালয়ে পড়বে।
ডুমুরিয়া উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিস থেকে জানা গেছে, উপজেলায় মোট ২১৪টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় রয়েছে। এর মধ্যে ময়নাপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী মাত্র একজন। তবে সেখানে শিক্ষক আছেন ৩ জন।
ডুমুরিয়া উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার সিকদার আতিকুর রহমান বলেন, ‘শিক্ষার্থী সার্ভের পর গত মার্চ মাসে ময়নাপুর স্কুলটি বন্ধের জন্য জেলা শিক্ষা অফিসে আবেদন করেছি। কিন্তু এখনও সিদ্ধান্ত আসেনি।’
খুলনা জেলা শিক্ষা অফিসার মো. সিরাজুদ্দোহাও জানিয়েছেন, স্কুলটি বন্ধ করে দিতে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে আবেদন করা হয়েছে। কিন্তু এই স্কুলটি বন্ধ হয়ে যাক তা চান না স্থানীয়রা।
পর্যাপ্ত শিক্ষার্থী না থাকায় স্কুলটি বন্ধ থাকে বেশির ভাগ সময়। ছবি: নিউজবাংলা
ময়নাপুর গ্রামের নিখিল কুমার মণ্ডল বলেন, ‘আমাদের গ্রামের মানুষ পরিবার পরিকল্পনা মেনে চলেন। এখানের প্রায় সব পরিবারেই দুটির বেশি সন্তান নেই। তাই স্কুলে শিক্ষার্থী কম। তবে ভবিষতে গ্রামে শিশুসন্তান বাড়বে। তারা এখানে লেখাপড়া করবে। এই মুহূর্তে স্কুলটি বন্ধ করা হলে গ্রামটি অন্ধকার হয়ে যাবে।’
বিজন মণ্ডল বলেন, ‘আগে এখানে শিক্ষার্থী ছিল। দুই থেকে তিন বছর হলো শিক্ষার্থী কমে গেছে। তবে সামনে বাড়বে। বিদ্যালয়টি বন্ধ হলে এই গ্রামের শিশুদের পার্শ্ববর্তী গ্রামে গিয়ে লেখাপড়া করতে কষ্টসাধ্য হয়ে যাবে।’
স্থানীয় ইউপি মেম্বার মো. মহসীন গাজী বলেন, ‘ওই এলাকাটি প্রত্যন্ত। বর্ষাকালে জলাবদ্ধ থাকে। সেখানে একমাত্র প্রতিষ্ঠান ওই স্কুলটি। তা বন্ধ হলে গ্রামে আর কিছু থাকবে না।’
ধামালিয় ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান জহুরুল হক বলেন, ‘ওই এলাকায় ভালো রাস্তাঘাট নেই। আমি নির্বাচিত হওয়ার পর সেখানে বরাদ্দের চেষ্টা করছি। আশা করি, শিগগিরই ভালো রাস্তা নির্মাণ হবে। তখন আশপাশের শিক্ষার্থীরাও স্কুলটিতে পড়তে যাবে।
‘তবে হঠাৎ করে বিদ্যালয়টি বন্ধ করে দিলে আমরা মেনে নিব না। চালু রাখতে প্রয়োজনে আন্দোলন করব।’
বিদ্যালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক স্বপ্না রানী বলেন, ‘সরকারের কাছে আমরা অনুরোধ করব, অন্তত একজন শিক্ষক দিয়ে হলেও যেন বিদ্যালয়টি চালু রাখা হয়। তাহলে ভবিষ্যতের শিক্ষার্থীরা উপকৃত হবে।’