বগুড়ার সান্তাহার রেলস্টেশনের চার ট্রেন টিকিট এক্সামিনারের (টিটিই) হাত দিয়ে শুধু মে মাসের আট দিনেই টিকিটহীন যাত্রীদের কাছ থেকে জরিমানাসহ আদায় হয়েছে ৪ লাখ টাকা। এর মধ্যে গত ৬ মে রাতেই আদায় হয়েছে ১ লাখ ৩৫ হাজার টাকা।
সান্তাহার স্টেশনের ওপর দিয়ে যাতায়াত করা অন্তত ৪০টি ট্রেনে টিকিট চেক ও অর্থ আদায় করাই এই টিটিইদের কাজ ।
সান্তাহার রেলস্টেশনের কর্মকর্তারা বলছেন, ব্রডগেজ ও মিটারগেজ ট্রেনের প্রতি বগিতে গড়ে ৮ থেকে ১০ জন যাত্রী বিনা টিকিটে রেল ভ্রমণ করেন। আর ঈদের মৌসুমে এই যাত্রীদের সংখ্যা প্রতি বগিতে দ্বিগুণ হয়ে যায়।
সোমবার দুপুরে স্টেশনে গিয়ে কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে এসব বিষয় জানা গেছে। তবে যাত্রীদের পাশাপাশি রেলের দায়িত্বশীল ব্যক্তিরা জানান, সবাই ইচ্ছা করে বিনা টিকিটে ভ্রমণ করেন না। অনেকেই সময় স্বল্পতার কারণে টিকিট সংগ্রহ করতে পারেন না। তারা ট্রেনের ভেতরেই টিটিইদের কাছে রেলভাড়া পরিশোধ করেন।
সোমবার দুপুরে একতা-দ্রুতযান নামে আন্তনগর ট্রেন চেপে গাজীপুর যাওয়ার জন্য অপেক্ষা করছিলেন যাত্রী রুবেল হোসেন। তার বাড়ি সান্তাহারের ঢেকড়া গ্রামে। রুবেল বলেন, ‘পরিবার নিয়ে যাওয়া-আসার কারণে আগে থেকেই টিকিট কেটে রাখি। কিন্তু অনেকে চান স্টেশনে পৌঁছে টিকিট সংগ্রহ করতে। স্টেশনে আসার পর দেখা যায় সেই সময় পাওয়া যায় না। তখন তারা ট্রেনে উঠে টিটিইদের কাছে টিকিটের টাকা জমা দেন।’
রুবেলের পাশে থাকা আসিফ আহমেদ এই কথায় সায় দেন। তাকে মাঝেমধ্যে টিকিট ছাড়াই ট্রেনে উঠতে হয়। বেসরকারি চাকরিজীবী আসিফকে কাজের সুবাদে নাটোরে যেতে হয়। এ জন্য তাড়াহুড়োর সময় যে ট্রেন সামনে পান, তাতেই উঠে পড়েন। তবে সোমবার নাটোরে যাওয়ার জন্য দ্রুতযানের টিকিট কেটেছেন তিনি।
আসিফের দাবি, তিনি কখনও ফাঁকি দেয়ার চেষ্টা করেননি। কিন্তু টিটিইরা টিকিট নিতে এলেই বাড়তি মাশুল (জরিমানা) ধরেন। এটাই একটু খারাপ লাগে তার।
আর এই টাকা আদায় অনেক ধৈর্যের কাজ বলে মনে করেন টিটিইরা। সান্তাহারে চারজন টিটিই কর্মরত রয়েছেন। অবশ্য মোট পদ পাঁচটি। একটি পদ শূন্য।
টিটিই মো. রবিউল ইসলাম বলেন, ‘মানুষের কাছে টাকা আদায় করাটাই কষ্টের। টাকা চাইতে গেলেই অনেকে নানা বাহানা করতে শুরু করেন। অনেকে খারাপ আচরণ করেন। এতে দুই পক্ষের মধ্যেই বাজে ব্যবহার ঘটে যায়।’
তিনি আরও বলেন, ‘তবে এর ব্যতিক্রমও রয়েছে। ভদ্রলোকদের সঙ্গে কখনও দুই কথা বলতে হয় না। তারা টিকিটের টাকা চাইতে গেলে বিনা বাক্যব্যয়ে দিয়ে দেন।’
সান্তাহার টিটিই কার্যালয় জানায়, বিনা টিকিটে রেল ভ্রমণ করায় চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে জরিমানাসহ ১৫ লাখ ৪৩ হাজার ৫৩৫ টাকা আদায় হয়েছে। ফেব্রুয়ারি মাসে ১২ লাখ ৪০ হাজার ৭০ টাকা, মার্চ মাসে ১৩ লাখ ১৩ হাজার ৯৪০ টাকা এবং এপ্রিল মাসে ৭ লাখ ৬৪ লাখ ৮১৫ টাকা আদায় হয়।
আর মে মাসের প্রথম আট দিনে টিটিইরা ৪ লাখ টাকা সংগ্রহ করেছেন। এর মধ্যে এক দিনেই পাওয়া যায় ১ লাখ ৩৫ হাজার টাকা। এ টাকা আদায় অভিযানে ছিলেন টিটিই রবিউল ইসলাম।
তিনি জানান, ৫ মের রাত থেকে ৬ মে পর্যন্ত ওই টাকা আদায় করা হয়। চিলাহাটি থেকে পাকশী পর্যন্ত এ অভিযান চলেছিল।
জরিমানার বিষয়ে রবিউল জানান, টিকিট না থাকলে যাত্রীকে মূল ভাড়ার সঙ্গে সর্বনিম্ন ৫০ টাকা জরিমানা যোগ করা হয়। জরিমানার স্থান থেকে এক স্টেশনের ভাড়া হিসেবে এই জরিমানার ৫০ টাকা ধরা হয়। তবে কেউ অসদাচরণ করলে মূল টিকিটের দ্বিগুণ ভাড়া আদায় করার এখতিয়ার আছে টিকিট পরীক্ষকদের।
১৯৮০ সালের ৯ নম্বর রেলওয়ে আইনের ৬৯ ধারা অনুযায়ী টিটিইদের এই অধিকার দেয়া হয়েছে বলে উল্লেখ করেন রবিউল।
জ্যেষ্ঠ টিটিই কিশোরী মোহন রায় বলেন, ‘এখন ঈদের চাপ। তাই বগিপ্রতি হিসাব করলে অন্তত ২৫ জন যাত্রী টিকিটবিহীন থাকেন। অন্যান্য সময় সান্তাহার স্টেশনের ওপর দিয়ে চলা প্রতিটি রেলবগিতে গড়ে ১০ জন যাত্রীকে বিনা টিকিটে পাওয়া যায়। আমরা তাদের টিকিট করে দিই।’
সান্তাহার জংশন সূত্র জানায়, প্রতিদিন এই স্টেশনের ওপর দিয়ে ঢাকা, খুলনা, চিলাহাটি, লালমনিরহাট ও পঞ্চগড় রুটের ট্রেন যাতায়াত করে। এর মধ্যে আসা-যাওয়া মিলে ব্রডগেজ ও মিটারগেজের অন্তত ৪০টি ট্রেন রয়েছে। আর দৈনিক টিকিট বিক্রির হিসাবে গড়ে এসব রুটের প্রায় ৫ হাজার যাত্রী সান্তাহার স্টেশনে ওঠানামা করেন।
এসব তথ্য নিশ্চিত করেন সহকারী স্টেশন মাস্টার আব্দুল খালেক। তিনি বলেন, আন্তনগর ট্রেনের প্রতি বগিতে গড়ে ১০০ আসন থাকে। আর লোকালগুলোয় প্রায় ৫০টি।
সাধারণত দেখা যায়, ঈদ মৌসুমে এই বগিগুলোয় টিকিট ছাড়া দ্বিগুণ যাত্রী ভ্রমণ করে থাকেন। তবে অন্য সময় গড়ে ৮ থেকে ১০ জন যাত্রী বিনা টিকিটে রেল ভ্রমণ করেন।
আব্দুল খালেক জানান, অনেকে সময় স্বল্পতাসহ বিভিন্ন কারণে টিকিট ক্রয় করতে পারেন না। এসব দেখার জন্য স্টেশনে টিকিট কালেক্টর (টিসি) থাকে। আর ভ্রাম্যমাণভাবে টিটিইরা ট্রেনে ঘুরে বেড়ান।
কিন্তু সান্তাহারে ছয়টি টিসির পদে জনবল রয়েছে তিনজন। আর পাঁচটি টিটিই পদের বদলে কর্মরত রয়েছেন চারজন। কম লোক দিয়ে কাজ চালানো কষ্টকর।
সান্তাহার রেল জংশনের স্টেশন মাস্টার (গ্রেড-১) রেজাউল করিম ডালিম জানান, এ স্টেশনে গড়ে প্রতি মাসে এক কোটি টাকা আয় হয়। এর মধ্যে যাত্রী ভাড়া, পণ্য পরিবহন ভাড়াসহ বিভিন্ন খাতের টাকা রয়েছে। তবে টিটিইদের সংগ্রহকৃত সব টাকা এর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত হয় না।
এর কারণ হিসেবে তিনি বলেন, ‘একজন টিটিই যাত্রীদের কাছ থেকে রেলভাড়া সংগ্রহ করে যে স্টেশনে নামবেন, সেখানেই জমা দিতে হবে। এ জন্য তাদের আদায়কৃত টাকার হিসাবটা আলাদা থাকে।’
রেজাউল করিম আরও বলেন, ‘এখন সিস্টেম অনেক ভালো। টিটিই টিকিটের টাকা আদায় করে মেরে দেবেন এমন অবস্থা আর নেই। সবাই রেল বিভাগ নিয়ে এত কথা বলে। কিন্তু মানুষ প্রতিদিন আরও অনেক জায়গায় গিয়ে ভোগান্তির শিকার হয়। সেসব নিয়ে কেউ কোনো কথা বলে না।’