প্রস্তাবিত উপাত্ত সুরক্ষা আইনে মানুষের ব্যক্তিগত তথ্য সরকারি সংস্থার নিয়ন্ত্রণে চলে যাওয়ার ঝুঁকি রয়েছে বলে মনে করে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ-টিআইবি। তাদের মতে, এতে এসব তথ্য ও আইনের অপব্যবহারের ঝুঁকিও বাড়বে।
সোমবার টিআইবি আয়োজিত ‘উপাত্ত সুরক্ষা আইন, ২০২২ (খসড়া): পর্যালোচনা ও সুপারিশ’ বিষয়ে এক ভার্চুয়াল সংবাদ সম্মেলনে এ কথা জানানো হয়।
প্রস্তাবিত আইনের খসড়ার বিভিন্ন বিষয়কে অস্পষ্ট ও বিভ্রান্তিকর উল্লেখ করে টিআইবি বলেছে, ‘আইনটি এখন যেভাবে আছে সেভাবে পাস হলে তা ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মতো আরেকটি বিতর্কিত ও কালো আইনে পরিণত হবে।’
এ ধরনের আইন প্রয়োজন থাকলেও তার জন্য আলাদা একটা স্বাধীন ও নিরপেক্ষ কমিশন গঠন প্রয়োজন বলেও মনে করে টিআইবি।
ব্যক্তিগত তথ্য সুরক্ষা আইনের উদ্দেশ্য, মানুষের ব্যক্তিগত তথ্যের বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার সীমিত করা। ব্যক্তির সম্মতি ছাড়া কোনো তথ্য যেন ব্যবহার না করা হয়, তা নিশ্চিত করা এবং এ ধররেন কার্যক্রম রোধ করা।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এ ধরনের আইন কার্যকরে স্বাধীন কমিশন বা সংস্থা গঠন করা হলেও খসড়ায় সে ক্ষমতা দেয়া হয়েছে ডিজিটাল সিকিউরিটি এজেন্সিকে। নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষের ক্ষমতা দেয়া হয়েছে। আইনের বিভিন্ন শব্দের অস্পষ্টটা রয়েছে, সেগুলোর বিস্তারিত ব্যাখ্যাও আইনে নেই। খসড়া আইনের ধারা ৬৬-তে সরল বিশ্বাসে কৃত কার্যক্রমের জন্য কেউ ক্ষতিগ্রস্ত হলে সংশ্লিষ্টদের দায়মুক্তির বিধান রাখা হয়েছে।
এই খসড়াটি অনলাইনে প্রকাশ করে অংশীজনদের মতামত চেয়েছে সরকার।
আইনের খসড়া নিয়ে টিআইবি বলছে, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের অপব্যবহার করে মানুষকে হয়রানি করা হচ্ছে। তেমনি এই আইনটি অস্পষ্টতার কারণে যথেষ্ট অপব্যবহারের সুযোগ আছে। খসড়ায় আইনের বিভিন্ন দিক যথাযথভাবে বিবেচনা করা হয়নি।
টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ‘ব্যক্তিগত তথ্যের সুরক্ষা দেওয়ার উদ্যোগকে সাধুবাদ জানাই। তবে খসড়াটি যেভাবে রয়েছে তাতে, ব্যক্তিগত তথ্যের সুরক্ষার নামে ব্যক্তিগত তথ্য সরকারি প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণে যাওয়ার ঝুঁকি সৃষ্টি হয়েছে। যা মানুষের সংবিধান স্বীকৃত মৌলিক অধিকার ব্যক্তিস্বাধীনতা, বাক-স্বাধীনতা, ব্যক্তিগত গোপনীয়তার অধিকার, ব্যক্তিগত তথ্য গোপনীয়তার অধিকারগুলোকে খর্ব করার ঝুঁকি তৈরি করেছে।
‘এখানে কিছু কিছু শব্দ ও ধারণার উল্লেখ করা হয়েছে যেগুলোর সুনির্দিষ্ট ব্যাখ্যা নেই। যার ফলে আইনের অপব্যবহারের ঝুঁকি সৃষ্টি হয়েছে। এমনকি আইনের শিরোনামটিও বিভ্রান্তিকর বলে মনে হয়েছে। ফলে আইনটি যে উদ্দেশ্যে করা হয়েছে যা ব্যক্তিগত সুরক্ষা প্রদান সেটি কার্যকর করা যাবে তা প্রশ্ন থেকে যায়। তাই আইনটির দুর্বলতাগুলো চিহ্নিত করার পাশাপাশি প্রায়োগিক ক্ষেত্রের ঝুঁকিগুলো যেন না থাকে।’
প্রস্তাবিত খসড়ায় আইনটি প্রয়োগের জন্য ডিজিটাল নিরাপত্তা এজেন্সিকে সীমাহীন ক্ষমতা দেয়া হয়েছে। ডেটা-উপাত্তের সুরক্ষার একক ক্ষমতাও থাকবে এই এজেন্সিতে।
এ বিষয়ে ইফতেখার বলেন, ‘আইনটিতে ব্যক্তিগত তথ্যের নিয়ন্ত্রক হিসাবে ডিজিটাল সিকিউরিটি এজেন্সিকে সীমাহীন এবং নিরঙ্কুশ ক্ষমতা দেয়া হয়েছে, যেটির কোনো প্রয়োজন ছিল না। এটি এই এজেন্সির এখিতিয়ার বহির্ভুতও।
‘এ এজেন্সি যে কোনো ক্ষেত্রে ব্যবস্থা নিতে পারবে এবং তার ক্ষমতা প্রয়োগ করতে পারবে। তিন ডজনের মতো উপধারার মাধ্যমে এজেন্সিটিকে অতিমানবীয় ক্ষমতা দেয়া হয়েছে। যেটা অপব্যবহারের সুযোগ থাকবে। তাই এ এজেন্সির সীমাহীন ক্ষমতা ব্যক্তিগত তথ্য সুরক্ষা আইনের মূল উদ্দেশ্য ধুলিস্যাৎ করে এটিকে একটি কালো আইনে রূপান্তর করবে।
‘তাই বিভিন্ন দেশের অভিজ্ঞতা ও আইনের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে আইনটি বাস্তবায়নের জন্য সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে একটি সংবিধিবদ্ধ ও স্বাধীন প্রতিষ্ঠান গঠন করতে হবে। তাদের কাছে এ আইনের ক্ষমতা অর্পণ করা উচিত। এ আইনের লঙ্ঘনের ক্ষেত্রে পুলিশের হাতে তদন্তের ক্ষমতা দেয়া হয়েছে, যা পুলিশেরও এখতিয়ারবহির্ভুত। তাই আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞদের মতামত দিয়ে আইনিটিকে ঢেলে সাজাতে হবে। প্রয়োগেও আলাদা স্বাধীন কমিশন থাকতে হবে। নাহলে বাংলাদেশ একটি নজরদারিভিত্তিক সমাজব্যবস্থার দিকে ধাবিত হবে।’
জাতিসংঘের বাণিজ্য ও উন্নয়নবিষয়ক সংস্থার (আঙ্কটাড) সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, বিশ্বের ১৯২টি দেশের মধ্যে ১৩৭টি দেশে ব্যক্তিগত তথ্য সুরক্ষা বা তথ্যের গোপনীয়তা সম্পর্কে দেশীয় আইন রয়েছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে পাঁচ দশকের বেশি সময় ধরে এই ধরনের আইন বাস্তবায়নের অভিজ্ঞতা রয়েছে। এদেশের ক্ষেত্রে বিষয়টি নতুন।
অনুষ্ঠানে মালয়েশিয়ার ইউনিভার্সিটি অব মালয়ার ‘ল অ্যান্ড ইমার্জিং টেকনোলজিস’ এর শিক্ষক এরশাদুল করিম বলেন, ‘ইউরোপের বিভিন্ন দেশ, উত্তর আমেরিকাসহ অন্যান্য দেশে ব্যক্তিগত তথ্য সুরক্ষায় আইন রয়েছে। এসব আইনে ব্যক্তিগত তথ্যের সুনির্দিষ্ট ব্যাখ্যা ও নির্দিষ্ট বৈশিষ্ট্যও আছে। কিন্তু বাংলাদেশে প্রস্তাবিত এ আইনের খসড়ায় ব্যক্তিগত তথ্য কী, তারই কোনো ব্যাখ্যা নেই। এসব অস্পষ্টতা দূর করতে হবে।’
টিআইবির পরিচালক শেখ মুহাম্মদ মনজুর-ই-আলম মূল উপস্থাপনায় বলেন, ‘ব্যক্তিগত তথ্য সুরক্ষা আইনের উদ্দেশ্য হচ্ছে মানুষের ব্যক্তিগত তথ্যের বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার সীমিত করা, যাতে কারও অসম্মতিতে কোনো ব্যক্তিগত তথ্য ব্যবহার না হয়। কিন্তু ডিজিটাল নিরাপত্তা এজেন্সির কাজ হলো ডিজিটাল নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, ডিজিটাল মাধ্যমে সংঘটিত অপরাধ শনাক্ত করা, প্রতিরোধ, দমনসহ অন্যান্য বিষয় দেখা। এ দুটির উদ্দেশ্যে কোনো মিল নেই। বিশ্বের অধিকাংশ দেশে এ দায়িত্ব পালন করছে স্বাধীন ও নিরপেক্ষ কমিশন।’