সেতুর টোল চেয়ে গাড়ি থামানোয় আদায়কারীদের ওপর ‘হামলা’র বিষয়টি নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি না করার পরামর্শ দিয়েছেন পটুয়াখালীর সংরক্ষিত নারী আসনের সংসদ সদস্য (এমপি) কাজী কানিজ সুলতানার ছেলে।
তিনি জানান, সবাইকে নিয়ে ‘বিষয়টা’ ক্লোজ করা হবে।
বরিশাল-পটুয়াখালী মহাসড়কের পায়রা সেতুর (লেবুখালী) টোলপ্লাজায় বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় টোল আদায়কারী এবং এমপির ছেলে ও তার বন্ধুদের মধ্যে হাতাহাতি ও মারামারিতে অন্তত পাঁচজন আহত হয়েছেন। তাদের মধ্যে তিনজন চিকিৎসা নিয়েছেন হাসপাতালে।
একই দিন রাতে রেলমন্ত্রী নূরুল ইসলাম সুজনের আত্মীয় পরিচয়ে বিনা টিকিটে ট্রেনে ভ্রমণ করার অপরাধে তিন যাত্রীকে জরিমানা করে বরখাস্ত হয়েছেন এক টিটিই। মন্ত্রী অবশ্য সংবাদমাধ্যমের কাছে দাবি করেছেন, ট্রেনের ওই তিন যাত্রীর সঙ্গে তার আত্মীয়তার কোনো সম্পর্ক নেই। তবে নিউজবাংলার অনুসন্ধানে দেখা গেছে, আলোচিত তিন যাত্রীই রেলমন্ত্রীর দূর সম্পর্কের আত্মীয়।
এসব ঘটনায় ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) ও সংক্ষুব্ধ নাগরিক আন্দোলনের প্রতিনিধিরা। তারা বলছেন, সবখানেই একটা গা জোয়ারি মনোভাব। দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকা, কোনো জবাবদিহিতা না থাকায় তারা (মন্ত্রী-এমপি ও তাদের স্বজনরা) কোনো আইনের তোয়াক্কা করছেন না।
কী ঘটেছিল টোলপ্লাজায়
পায়রা সেতুর টোলপ্লাজায় দায়িত্বরত ম্যানেজার মো. আসাদুজ্জামান বলেন, ‘সংরক্ষিত নারী আসনের এমপি কাজী কানিজ সুলতানা হেলেনকে বহনকারী সংসদ সদস্যের স্টিকারযুক্ত গাড়িটিসহ তাদের বহরে থাকা পাঁচটি গাড়ি এবং অনেকগুলো মোটরসাইকেল বৃহস্পতিবার সকালে আমরা টোল আদায় না করেই ছেড়ে দিই। তারা তখন পটুয়াখালী থেকে বরিশালের দিকে যাচ্ছিলেন। বিয়ের অনুষ্ঠান শেষে সন্ধ্যায় এমপির বড় ছেলে মাহিন হোসেন তালুকদার জয় নববধূকে নিয়ে বরিশাল থেকে পটুয়াখালীর দিকে ফিরছিলেন। এ সময় পায়রা সেতু হয়ে টোল পরিশোধ না করে যেতে চাইলে তারা বাধার মুখে পড়েন।
‘এ সময় আমার স্টাফরা গাড়ির টোল চাইলে ওই গাড়ির লোকজন বলেন, আমাদের গাড়ির ভাড়া পেছনের গাড়ির লোকজন দেবেন। এ সময় স্টাফরা পেছনের চারটি গাড়িতে ভাড়া চান। তবে কেউই ভাড়া না দেয়ায় কাউন্টারের দিকে তারা ফিরে আসেন। তখন এমপির ছোট ছেলে তাজ হোসেন তালুকদার তার মায়ের বরাত দিয়ে টোল পরিশোধে আপত্তি জানান। একপর্যায়ে প্লাজার লোকজনের সঙ্গে তর্কে জড়িয়ে পড়েন এমপির ছেলে ও তার বন্ধুরা।
‘এমপির ছেলের বন্ধু আশিকুর রহমান আশিক আচমকা টোলপ্লাজার সুপারভাইজার মো. রাসেলের ওপর হামলা চালিয়ে তাকে জখম করেন। পরে কাউন্টারের ভেতর থেকে অন্য স্টাফরা তাকে বাঁচাতে এগিয়ে গেলে এমপির ছেলে তাজসহ তার বন্ধুরা মিলে তাদেরও মারধর শুরু করেন। এই ফাঁকে টোল না দিয়েই নববধূকে বহনকারী সাদা রঙের কারটি সামনে চলে যায়। পরে টোলপ্লাজার সব স্টাফ একত্রিত হলে এমপির ছেলের বন্ধুদের সঙ্গে তাদের হাতাহাতি ও মারামারির ঘটনা ঘটে। এ সময় উভয় পক্ষের বেশ কয়েকজন আহত হন।’
টোলপ্লাজার ম্যানেজার বলেন, ‘এরপর পটুয়াখালী থেকে একদল লোক এসে আবারও হামলা চালায় আমাদের স্টাফদের ওপর। তখন কাউন্টারের বাইরে পুলিশও দাঁড়ানো ছিল। তবে লোকজন বেশি হওয়ায় পুলিশ প্রথমে কিছু করতে পারেনি। কিছুক্ষণ পর অতিরিক্ত পুলিশ এসে তাদের সরিয়ে দেয় এবং টোল পরিশোধ না করেই পাঁচটি গাড়িসহ অনেকগুলো মোটরসাইকেল সেতু পার হয়ে চলে যায়।
যা বলছেন এমপি ও তার ছেলে
নারী এমপির ছোট ছেলে তাজ হোসেন তালুকদার বলেন, ‘বড় ভাইয়া যখন আম্মুর পরিচয় দিছে (দিয়েছে) তখন ওনারা (টোল আদায়কারীরা) খুব বাজে কথা বলছে। যেগুলো ভাষায় প্রকাশ করার মতো না। স্বাভাবিক কারণেই পাশের সিটে নববধূ মানে আমার ভাবি বসা থাকায় ভাইয়ার খুব মাইন্ডে বাজছে। যে কারণে ভাইয়া গাড়ি থেকে নেমে তাদের প্রশ্ন করছে যে, তোমরা এ রকম ভাষা ব্যবহার কেন করছ। ব্যস আর কিছু না।
‘ভাইয়া যখন গাড়ি থেকে বের হয়েছে সেটা দেখে আমি আর আমার বন্ধুরা গিয়ে ওদের একই প্রশ্ন করি। তখন ওদের সঙ্গে কথা-কাটাকাটি হয়েছে। এর মধ্যে ওরা আমার বন্ধু আশিকের ওপর হামলা করে আহত করলে পুলিশ গিয়ে সবাইকে সরিয়ে দেয়।’
এমপিপুত্র তাজ বলেন, ‘আগামীকাল ভাইয়ার বৌভাত অনুষ্ঠান শেষে আমরা সবাই বসে এ বিষয়টা নিয়ে ক্লোজ করতে চাই। এটা নিয়ে আর আপনারা ঘাঁটাঘাঁটি কইরেন না।’
তবে হামলা ও মারামারির পুরো বিষয়টি অস্বীকার করেছেন নারী এমপি কাজী কানিজ সুলতানা হেলেন। তিনি বলেন, ‘আমার গাড়ি ঘটনাস্থলে ১০ মিনিট পরে পৌঁছায়। আমি ঘটনার সময় যেহেতু ছিলাম না, সেহেতু আমার ধারণা টোল পরিশোধের কোনো বিষয় না। আসল ঘটনা হলো যারা টোল আদায় করে তারা সন্ত্রাসীপ্রকৃতির, ডাকাতপ্রকৃতির, তাদের ভাব দেখলেই সেটা বোঝা যায়। তারা আমার নববধূর স্বর্ণালংকার ছিনিয়ে নেয়ার চেষ্টা করছিল। তার (নববধূর) হাত ক্ষতবিক্ষত হয়েছে।
টোলপ্লাজায় আউটসোর্সিংয়ের মাধ্যমে লোক রাখার সমালোচনা করে তিনি বলেন, ‘এভাবে লোকজন রাখা হয়েছে সেটা ঠিক না। কিছুদিন আগে ওরা ছাত্রলীগের এক নেতাকেও মারধর করেছে। ওদের আমার মনে হয় সরিয়ে দেয়া উচিত, কারণ ওদের ব্যবহার একদমই ভালো না। স্থানীয়রা ওদের ব্যপারে অনেক ক্ষুব্ধ।’
তার ছেলে ও নববধূর ওপর হামলার ঘটনাকে পরিকল্পিত দাবি করে তিনি বলেন, ‘ঘটনার সময় প্রায় দুই থেকে আড়াই মিনিট বিদ্যুৎ ছিল না। ঠিক তখনই ওরা আমার ছেলের বউয়ের স্বর্ণালংকার ছিনিয়ে নেয়ার চেষ্টা করেছিল। তখন আমার ছেলে ও তার বন্ধুরা সেটিকে প্রতিহত করেছে। মূলত ওরা পরিকল্পিতভাবেই এ ঘটনাটি ঘটিয়েছে। আমার ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করার জন্য। বিষয়টি সবার ভাবা উচিত।’
তবে এ অভিযোগ অস্বীকার করে টোলপ্লাজার ম্যানেজার আসাদুজ্জামান বলেন, ‘মাত্র ২০ থেকে ৩০ সেকেন্ডের জন্য বিদ্যুৎবিহীন ছিল এটি সত্যি। তবে ততক্ষণে আমাদের জেনারেটর চালু হয়ে গেছে। ওই সময় সিসিটিভির ভিডিওটা একটু অন্ধকার আসছে। আর যখন নববধূর গাড়িটি টোলপ্লাজা অতিক্রম করে, তখনই দেখতে পারবেন এমপির ছেলেসহ তার বন্ধুরা মিলে আমাদের স্টাফদের কীভাবে মারধর করেছে।
এমপির বক্তব্যের সমালোচনা করে তিনি বলেন, ‘একজন মাননীয় সংসদ সদস্যের বেলায় এসব ঘটনায় আরও সতর্কভাবে কথা বলা উচিত বলে আমি মনে করি। কারণ বললে অনেক কিছুই বলা যায়, কিন্তু প্রমাণ কী করবেন? যেখানে প্রায় ১৭টি সিসিটিভি ক্যামেরা চলমান। সেখানে এ রকম উল্টাপাল্টা কথা বলে নিজেকে ছোট করার শামিল।
তিনি বলেন, ‘ছেলের জন্য এত বড় বিয়ের আয়োজন করতে পারলেন অথচ টোলপ্লাজার টোল দিতে পারেন না? এই টোল তো কারও পকেটে যাবে না, এটি তো রাষ্ট্রীয় কোষাগারে যাবে।’
পটুয়াখালী সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. মনিরুজ্জামান বলেন, ‘পায়রা সেতু এলাকা দুমকী থানার আওতায়। তাই বিষয়টা দুমকীর পুলিশ দেখবে। আমরা খবর পেয়ে তাৎক্ষণিক পৌঁছে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করে চলে আসি।’
দুমকী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবদুস সালাম নিউজবাংলাকে বলেন, ‘ঘটনার পর সেখান থেকে দুই ব্যক্তিকে এনে পুলিশ হেফাজতে রেখে পরদিন দুপুরে ছেড়ে দেয়া হয়েছে। তবে এখন পর্যন্ত কেউ লিখিত অভিযোগ দেয়নি। তার পরও পুরো বিষয়টি আমরা পর্যবেক্ষণ করছি।’
এ বিষয়ে সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) সিলেটের সভাপতি ফারুক মাহমুদ চৌধুরী নিউজবাংলাকে বলেন, ‘সবখানেই একটা গা জোয়ারি মনোভাব দেখছি। শক্তিমান-ক্ষমতাবানদের জন্যই সবকিছু।
‘মন্ত্রী-এমপির আত্মীয়রা অনৈতিক-বেআইনি সুবিধা পেতে পেতে এমন অবস্থা হয়েছে যে এখন বিনা টিকিটে ট্রেনে চড়া, টোল না দিয়েই সেতু পার হওয়াকে তারা তাদের অধিকার মনে করেন। কেউ এতে বাধা দিলেই তার ওপর খড়গহস্ত হন। এমনকি রাষ্ট্রযন্ত্রকে তারা তাদের এই অপকর্মে ব্যবহার করছেন।’
সংক্ষুব্ধ নাগরিক আন্দোলন সিলেটের সমন্বয়ক আব্দুল করিম কিম নিউজবাংলাকে বলেন, ‘দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকা, কোনো জবাবদিহিতা না থাকায় তারা আর কোনো আইনের তোয়াক্কা করছেন না।
তিনি বলেন, ‘ক্ষমতাসীনরা বেআইনি কাজ আগেও করছেন। কিন্তু ধরা পড়ে গেলে তারা তা লুকানোর চেষ্টা করতেন না। লজ্জিত হতেন। কিন্তু এখন আমরা কী দেখছি, টিকিট ছাড়া মন্ত্রীর এক আত্মীয়কে ধরার কারণে রেলের এক কর্মকর্তাকেই শাস্তি দেয়া হয়েছে। দেশের আইনকানুনকে এভাবে প্রকাশ্যে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখানোর ঘটনা এ দেশে খুব কমই ঘটেছে।’