রংপুর থেকে ঢাকায় ফেরার বাস-ট্রেনের টিকিট পাচ্ছেন না যাত্রীরা। ঈদের ছুটি কাটিয়ে কর্মস্থলমুখী মানুষ রেলস্টেশন, বাসস্ট্যান্ডে ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা করেও নির্ধারিত দামে মিলছে না টিকিট।যাত্রীদের অভিযোগ, ফোনে বা স্টেশনের প্ল্যাটফর্মের পাশে চড়া দামে ট্রেনের টিকিট ঠিকই মিলছে। আর বাসের টিকিটও পাওয়া যায় কাউন্টারের বাইরে। এ জন্য দ্বিগুণ ভাড়া গুনতে হচ্ছে।পরিবহন খাতে এমন নৈরাজ্য বন্ধে প্রশাসনের কোনো তৎপরতা না দেখে ক্ষোভ ঝাড়ছেন যাত্রীরা।রংপুর রেলওয়ে স্টেশন কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, ঢাকাগামী কুড়িগ্রাম এক্সপ্রেসের রংপুর স্টেশনের জন্য বরাদ্দ ৫৮টি টিকিট আর রংপুর এক্সপ্রেসের বরাদ্দ ৭৮টি। নির্ধারিত দিনের যাত্রার চার দিন আগে টিকিট অনলাইন ও অফলাইনে বিক্রি করা হয়।
শনিবার দুপুরে রংপুর রেলস্টেশনে দেখা গেছে, ঢাকাগামী অনেক যাত্রী ট্রেনের টিকিট হন্যে হয়ে খুঁজছেন। স্টেশন কর্তৃপক্ষ বলছে, টিকিট বিক্রি শেষ।স্টেশনের প্রধান বুকিং কর্মকর্তা আপেল মাহমুদ নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমাদের যে বরাদ্দ তার চেয়ে বেশি যাত্রী লাইলে দাঁড়ানো। সকাল সাড়ে ৮টায় টিকিট দেয়ার সময় নির্ধারিত থাকলেও কেউ কেউ ৬টার আগে লাইনে দাঁড়ান। স্বল্পতার কারণে আমরা সবাইকে টিকিট দিতে পারছি না।’ তিনি বলেন, ‘সবাইকে টিকিট দিতে না পারায় মানুষ ভাবে আমরা কালোবাজারিতে জড়িত। আমাদের তো হাত-পা বাঁধা। এক যাত্রী ন্যাশনাল আইডি কার্ড শো করে তিনটি টিকিট নিতে পারেন। ২০ জন উপস্থিত হলে আধাঘণ্টায় টিকিট শেষ।
‘রংপুর এক্সপ্রেসের ৭৮টি টিকিটের জন্য ২৫ জন লাইনে দাঁড়ালে তাদের দিতে হয়। পরে অন্যরা পায় না। এ ছাড়া প্রতিদিন ভিআইপিদের জন্য আটটি টিকিট বরাদ্দ রয়েছে। এর মধ্যে বিচারপতি, বীর মুক্তিযোদ্ধা, স্থানীয় সাংসদ এবং রেলের কর্মকর্তারা রয়েছেন।’ আপেল মাহমুদ বলেন, ‘আমাদের কাছে তথ্য আসছে, ভিন্ন ওয়েতে ভিন্ন ভিন্ন দিন লোক দাঁড় করিয়ে টিকিট নেয় একটি চক্র। তারাই স্টেশনের বাইরে হয়তো টিকিট বিক্রি করে। কোনো একজন লাইনে দাঁড়িয়ে টিকিট চাইলে আমরা দিতে বাধ্য।’
রংপুর রেলওয়ে স্টেশনের একাধিক সূত্র নিউজবাংলাকে জানিয়েছে, অনলাইন বা অফলাইনে একটি চক্র আগাম টিকিট কেটে রাখেন। তারাই নানা কৌশলে স্টেশনের আশপাশে বেশি দরে টিকিট বিক্রি করেন। এ চক্রে স্টেশন এলাকার কিছু নারী ও যুবক জড়িত। এই সংখ্যা আটজনের মতো।শনিবার দুপুরে রায়হান আলী মঞ্জু নামে এক যাত্রী জানান, ‘১১ মে ঢাকা যাব বলে সকাল ৯টায় এসেছি টিকিট কাটতে। এসে শুনি টিকিট দেয়া শেষ। অনলাইনেও নেই। এরপর শুনতে পাই, অপেক্ষা করেন- টিকিট পাবেন।
‘দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে এক ছেলে এসে বলে, আমি ১১ তারিখ যাব না, ৩টা টিকিট আছে, লাগলে নিতে পারেন। তবে ৬০০ টাকা বেশি দিতে হবে। তখন মনে হলো সোনার হরিণ পেলাম। তাকে ৫০০ টাকা বেশি দিয়ে টিকিট নিলাম।’বিষয়টি কাউকে জানিয়েছেন কি না জানতে চাইলে মঞ্জু বলেন, ‘জানিয়ে কী হবে? বরং আমাদের যাওয়া হবে না। এটা পুলিশ এবং স্থানীয় প্রশাসনকে দেখতে হবে।’স্টেশন এলাকায় আবুল কালাম আজাদ নামে এক যাত্রী বলেন, ‘আমাকে একজন আশ্বাস দিয়েছে, ১০ তারিখেরে টিকিট দিবে। আমি অপেক্ষা করছি। তবে স্টেশন এলাকায় দিবে না বলেছে।’
টিকিট কে দিতে চাইছে জানতে চাইলে আজাদ বলেন, ‘মোবাইল নাম্বার নিয়ে গেছে, ফোন করে জানাবে। এটা হয়রানি, নৈরাজ্য।এটা বন্ধ করতে কঠোর পদক্ষেপ নেয়া দরকার।’রংপুর রেলওয়ে স্টেশনের সুপার (ভারপ্রাপ্ত) শঙ্কর গাংগুলি নিউজবাংলাকে বলেন, ‘যাত্রীর চাপের কারণে টিকিট সংকট। এত বড় স্টেশন থেকে অফলাইনে এত কম টিকিট দিয়ে হয় না। তাছাড়া ভিআইপিদের চাপ থাকে। এ জন্য প্রতিদিন অন্য স্টেশন থেকে কমপক্ষে ৫৫টি টিকিট চেয়ে নিতে হচ্ছে।’
তিনি বলেন, ‘কালোবাজিতে টিকিটি বিক্রি হচ্ছে, এটা আমার কানেও আসছে। এটা তো আমাদের দেখার বিষয় না। এটা দেখবে পুলিশ বা প্রশাসনের লোকজন। আমাদের লোক জড়িত থাকলে প্রশাসন ধরে দিক। এটা আসলে কথার কথা বলা হয়।
‘আমি প্রশাসনকে অনেকবার বলেছি, যারা কালোবাজারি করছে তাদের ধরতে, অভিযান চালাতে। মাঝে মধ্যে অভিযান চালায়, কিন্তু কেউ ধরা পড়ে না।’ রেলওয়ে পুলিশের রংপুর স্টেশনের ফাঁড়ির ইনচার্জ মোস্তফা কামাল নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমাদের লোকজন যাত্রীদের নিরাপত্তা নিয়ে কাজ করছে। টিকিট কালোবাজারি নিয়েও কাজ করছি। এখন পর্যন্ত কোনো অভিযোগ পাইনি বা কাউকে আটকও করা হয়নি। মাঝে মাঝে অভিযান চালানো হয়।’ রংপুর কামারপাড়া ঢাকা কোচ স্ট্যান্ডে গিয়ে দেখা গেছে, সেখানেও টিকিট নেই। যাত্রীরা এ কাউন্টার সে কাউন্টার ঘুরে টিকিট খুঁজছেন।
বাস কাউন্টার থেকে বলা হচ্ছে, ১১ মে পর্যন্ত সব টিকিট বিক্রি হয়ে গেছে। তবে কালোবাজারি সিন্ডিকেটের সদস্যদের কাছে অতিরিক্ত টাকা দিয়ে টিকিট পাওয়া যাচ্ছে।কামারপাড়া বাসস্ট্যান্ড থেকে ঢাকা, চট্টগ্রাম ও সিলেটসহ বিভিন্ন জেলায় দুই শতাধিক এসি ও নন-এসি বাস চলাচল করে বলে জানান কামার পাড়া কোচ স্ট্যান্ড শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক মিঠু।শনিবার সকালে কোচ স্ট্যান্ডে দেখা যায়, এসআর ট্রাভেল, আগমনী এক্সপ্রেস, হানিফ পরিবহন, শ্যামলী পরিবহন, নাবিল ও এনাসহ বিভিন্ন বাস কাউন্টারে যাত্রীরা ভিড় করছেন। টিকিট না পেয়ে ভোগান্তিতে পড়েন তারা।
হানিফ পরিবহনের ম্যানেজার হোসেন আলী নিউজবাংলাকে বলেন, ‘টিকিট দুদিন আগে বিক্রি হয়ে গেছে। এবার যাত্রীদের চাপ বেশি, টিকিটের চাহিদা অনেক। টিকিট না থাকলে কোথা থেকে দেবো।’
শ্যামলী পরিবহনের ম্যানেজার মো. সফি বলেন, ‘১১ মে পর্যন্ত সব টিকিট বিক্রি হয়ে গেছে। আমাদের কাছে কোনো টিকিট নেই।’
কাউন্টারের বাইরে গিয়ে দেখা যায়, টিকিট মিলছে চড়া দামে।
গোলাম মওলা সিরাজ নামে এক যাত্রী বলেন, ‘আমি যাবো গাজীপুরে। বাসের ভাড়া ১২০০ টাকা। আমার পরিচিত হওয়ায় ১৫০০ টাকা দিয়ে টিকিট নিয়েছি।’ আব্দুল আজিম নামে এক যাত্রী বলেন, ‘আমার তিনজন যাবো। এনা পরিবহনের টিকিটের দাম ৬০০ টাকা। কাউন্টারে গিয়ে দেখলাম টিকিট নাই। পরে বাইরে এক হাজার করে তিনটা টিকিট নিলাম। যাইতেই হবে উপায় কী। কেউ তো এসব দেখে না। বিপুল ক্ষতি হচ্ছে পাবলিকের।’এ সব বিষয়ে জানতে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর রংপুরের সহকারী পরিচালক আফসানা পারভীনের মোবাইলে ফোন করলে তিনি ব্যস্ত বলে লাইন কেটে দেন।
রংপুর মহানগর পুলিশ কমিশনার আব্দুল আলীম মাহমুদ জানান, টিকিট কালোবাজারে বিক্রি হলে অবশ্যই ব্যবস্থা নেয়া হবে। এ বিষয়ে প্রয়োজনে বাস স্ট্যান্ড এবং কাউন্টারগুলোতে অভিযান চালানো হবে।