রাজধানীর মেয়র হানিফ ফ্লাইওভারে দুর্ঘটনার হার রাজধানীর অন্য ফ্লাইওভারগুলোর চেয়ে বেশি। আর এখানে সবচেয়ে বেশি দুর্ঘটনা ঘটে মোটরসাইকেলের।
২০১৩ সালের অক্টোবর মাসে চালু হওয়া ১১ দশমিক ৭ কিলোমিটার দীর্ঘ এই ফ্লাইওভার দিয়ে গুলিস্তান থেকে শনির আখড়া ও পোস্তগোলা পর্যন্ত যাতায়াত করা যায়। চার লেনের ফ্লাইওভারে উঠতে ছয়টি এবং বের হতে সাতটি পথ রয়েছে।
পুলিশের তথ্য বলছে, ২০১৯ সালে মেয়র হানিফ ফ্লাইওভারে দুর্ঘটনায় ৩৩ জন নিহত হয়েছেন। ২০২০ সালে নিহতের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় ৫৭ জনে। ২০২১ সালে করোনার মধ্যেও নিহতের সংখ্যা ছিল ৪৭ জন।
সম্প্রতি এ ফ্লাইওভারের যাত্রাবাড়ী অংশে ঘটে যাওয়া একটি দুর্ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে প্রত্যক্ষদর্শী আকরামুল হক নিউজবাংলাকে বলেন, ‘সকালে হানিফ ফ্লাইওভারে একটি মোটরসাইকেলকে একটি বাস পেছন থেকে ধাক্কা দেয়। আমি ছিলাম বাসের পেছনে আমার মোটরসাইকেলে। বাসের সামনের দুই চাকার ডানপাশের চাকার নিচে বাইক ও বামপাশের চাকার নিচে ওই ব্যক্তি চলে যান। আমরা কয়েকজন মিলে বাসটিকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে বাসের চাকার নিচ থেকে ওই বাইকারকে ও তার বাইক টেনে বের করি। সায়দাবাদের লেন থেকে বাসটা ডান দিকে যাচ্ছিল।’
মেয়র হানিফ ফ্লাইওভারের ওপর যত্রতত্র এমনভাবে পথচারী পার হয়ে থাকেন। ছবি: সাইফুল ইসলাম/ নিউজবাংলা
মেয়র হানিফ ফ্লাইওভারের দুর্ঘটনা নিয়ে গবেষণা করেছেন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) সড়ক দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের (এআরআই) পরিচালক অধ্যাপক মো. হাদিউজ্জামান। দুর্ঘটনার বেশ কিছু কারণ চিহ্নিত করেছেন তিনি।
তিনি নিউজবাংলাকে বলেন, ‘ফ্লাইওভারে ওঠার মুখে থাকে যানজট। সেটি কাটিয়ে ফ্লাইওভারে উঠেই মোটরসাইকেলচালক তার বাইকের গতি বাড়িয়ে দেন। ফ্লাইওভারে স্পিড লিমিট ৬০ কিলোমিটার। তবে অনেক বাইকার ১০০ থেকে ১১০ কিলোমিটার গতিতে চালান। এ কারণে ঝুঁকি বেড়ে যায়।
‘বকশীবাজারের দিকে ফ্লাইওভার থেকে নেমে চার লেন হয়ে যায় দুই লেন। সেখানে যেটা হয়, বাসগুলো নামার সময় এমনভাবে থাকে যাতে সেখান দিয়ে কোনো মোটরসাইকেল না নামতে পারে। কারণ মোটরসাইকেল ভাড়ায় যাত্রী পরিবহন করে। বাস ড্রাইভাররা তাই বাইকারদের প্রতিযোগী মনে করে। যেহেতু মোটরসাইকেলচালকদের দক্ষতা ও অভিজ্ঞতার যথেষ্ট ঘাটতি আছে, তাই তারা মাপটা ঠিকমতো বুঝতে পারেন না। অনেক সময় মোটরসাইকেল নিয়ে সরু জায়গা দিয়ে নামার সময় তারা দুর্ঘটনাকবলিত হন।’
বঙ্গবাজার মার্কেট এলাকার অংশের সমস্যার কথা উল্লেখ করে হাদিউজ্জামান বলেন, ‘বঙ্গবাজার মার্কেট থেকে যে র্যাম্পটা উঠল, সেটা সামনে গিয়ে সায়েদাবাদের দিকে নেমে যাচ্ছে। এই অংশটুকু এবং মূল ফ্লাইওভার–এ দুই জায়গার সংযোগস্থলে স্টিলের পাত আছে। এই স্টিলের পাতে রাবার লাইনিং দিতে হয়, যাতে স্কিপ না করে, কিন্তু সেটা করা হয় নাই।
‘এই সংযোগস্থলটা ঝুঁকিপূর্ণ। এখানে উইভিং মুভমেন্টটা বেশি হয়। অর্থাৎ বাম থেকে ডানে, ডান থেকে বামে যাওয়ার চেষ্টা করেন চালকরা। উইভিং সেকশনটা ক্রিটিক্যাল। এখানে গাড়ি চালাতে যথেষ্ট অভিজ্ঞতা প্রয়োজন। স্টিলের সংযোগস্থলে কোনো কারণে মোটরসাইকেলের চাকা স্কিপ করছে কি না, কারণ মোটরসাইকেল দুই চাকার যান হওয়ায় ভারসাম্যের ঘাটতি থাকে। এই জায়গাটার তদন্ত করার দরকার আছে।’
মেয়র হানিফ ফ্লাইওভারের ওপর যত্রতত্র এমনভাবে পথচারী পার হয়ে থাকেন। এতে ফ্লাইওভারে দুর্ঘটনা বেড়ে যায়। ছবি:সাইফুল ইসলাম/নিউজবাংলা
দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ উল্লেখ করে হাদিউজ্জামান বলেন, ‘বাস মূল ফ্লাইওভারের ওপরে থামিয়ে যাত্রী নামাচ্ছে। যাত্রীরা আবার র্যাম্প দিয়ে হেঁটে হেঁটে সায়দাবাদের দিকে নামছে। বাস থামার ফলে ওইখানে আসলে সামনে কী আছে সেটা দেখতে সমস্যা হয়। ফলে ওই জায়গাটা ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলছে। ওইখানে দুর্ঘটনা অনেক হয়। এ কারণে এখানে ট্রাফিক ম্যানেজমেন্ট খুব জরুরি।’
মূল ফ্লাইওভারের ওপর থামিয়ে যাত্রী ওঠানামা করে বাস। ছবি: সাইফুল ইসলাম/নিউজবাংলা
সেফটি অডিটের গুরুত্ব উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘যেহেতু এখানে দুর্ঘটনা হচ্ছে, প্রতি মাসে এক-দুইটা দুর্ঘটনার খবর আসছে, এ কারণে এখানে সেফটি অডিট খুবই প্রয়োজন। সেফটি অডিট একটি স্ট্যান্ডার্ড মেকানিজম। কোনো স্থানে যদি বারবার দুর্ঘটনা হয়, সেটাকে আমরা বলি অ্যাকসিডেন্ট ব্ল্যাক স্পট। এই জায়গাগুলোতে সেফটি অডিট প্রয়োজন। সেফটি অডিটের মাধ্যমে দুর্ঘটনার মূল কারণ বের হয়ে আসবে।’
তিনি বলেন, ‘এটা পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপ (পিপিপি) প্রজেক্ট। এখানে সেফটি ইনবিল্ট থাকে। কারণ যারা ফ্লাইওভার তৈরি করেছে, তাদের টোল কালেক্ট করতে হয়। ফ্লাইওভার যদি ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে যায়, সবাই যদি ভয় পেয়ে এই ফ্লাইওভারে ওঠা ছেড়ে দেয়, তাহলে তাদের লস। সে কারণেই এই ফ্লাইওভারে সেফটি কারেকশনটা খুব জরুরি। না হলে ভবিষ্যতে অন্যান্য পিপিপি প্রজেক্টের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়ার আশঙ্কা থাকে।’