ইতিহাস বলছে, নবাবি আমলে ঢাকায় ঢোল পিটিয়ে ঈদের ঘোষণা করা হতো। রাজপথ পদদলিত হতো ঈদের মিছিলে। বিভিন্ন স্থানে মেলা, রেসকোর্সে ঘোড়দৌড় আর মুখরোচক খাবারের গন্ধে মৌ মৌ করত চারপাশ।
অতীতের মতো জাঁকজমকপূর্ণ ঈদ আয়োজন আর চোখে পড়ে না। অনেকেই বলেন, এ যুগে ঢাকার ঈদ পানসে। চোখ ধাঁধানো, মন জুড়ানো সেই সব আয়োজন এখন আর দেখা যায় না।
নগরায়ণের কুঠারাঘাতে কমেছে মানুষের সঙ্গে মানুষের যোগাযোগ। ঈদ সীমাবদ্ধ হয়ে গেছে ব্যক্তি ও পরিবারের মাঝে।
এই অবস্থা বেশি হারে পরিলক্ষিত হয় নতুন ঢাকায়। কারণ এসব এলাকায় বেশিসংখ্যক একক পরিবারের বাস। আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে যোগাযোগ কম, তাই নিজস্ব পরিমণ্ডলে হয় ঈদ আয়োজন।
তবে ঈদ আয়োজনের কিছু ঐতিহ্য ধরে রেখেছেন পুরান ঢাকার বাসিন্দারা। তারা পরিবার, আত্মীয়স্বজন, এমনকি বংশপরম্পরায় বাস করছেন সেখানে।
আত্মীয়স্বজনের বাড়িতে যাওয়া-আসা, ঐতিহ্যবাহী ও মুখরোচক খাবারের সঙ্গে মেহমানদারি ও গানবাজনায় বেশ আড়ম্বরভাবে ঈদ পালন করেন ‘পুরান ঢাকাইয়ারা’।
পুরান ঢাকার বাসিন্দা লেখক ও গবেষক এম মামুন হোসেন। ওয়ারীতে বাড়ি তার। ঢাকার ইতিহাস-ঐতিহ্য নিয়ে গবেষণা করছেন দীর্ঘদিন। প্রকাশিত হয়েছে একাধিক গ্রন্থ।
নিউজবাংলার সঙ্গে আলাপকালে তিনি বলেন, ‘পুরান ঢাকার ঈদ আয়োজনটা নতুন ঢাকার চেয়ে একটু ব্যতিক্রম। বিভিন্ন মুখরোচক খাবার ছাড়াও বড় পার্থক্য হচ্ছে, পুরান ঢাকার মানুষরা তাদের আত্মীয়স্বজনের নিয়ে ঈদ করেন। একে অন্যের বাড়িতে যান। সবাই সবার সঙ্গে দেখা করেন, ঈদ শুভেচ্ছা বিনিময় করেন।’
তিনি বলেন, ‘ঈদে উৎসবমুখর থাকে প্রতিটি বাড়ি। এখানকার মানুষজন আত্মীয়স্বজনের বাড়িতে যাতায়াত করেন, খোঁজখবর নেন, মেহমানদারি করেন। যেটা ঢাকার অন্যান্য স্থানে খুব বেশি হয় না।’
এম মামুন হোসেন বলেন, ‘আরেকটি রেওয়াজ প্রচলিত আছে, তা হলো- সালামি। বয়স যতই হোক না কেন, বয়সে যারা বড় তাদের কাছ থেকে সালামি পাওয়া যায়। টাকার পরিমাণ যা-ই হোক।’
‘কিন্তু নতুন ঢাকায় বেশির ভাগই একক পরিবার। তারা নিজেদের মতো করে উদযাপন করেন। আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে উৎসবমুখর আয়োজনে ঈদ উদযাপন হয়ে ওঠে না।’
অভিন্ন মত দিয়েছেন নতুন ঢাকার বাসিন্দা হোসনী মোবারক। রাজধানীর আফতাবনগরের এই বাসিন্দা ‘ইউরোগ্যাজ এলপিজি’র হেড অফ অপারেশন অ্যান্ড মার্কেটিং হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন।
নিউজবাংলাকে তিনি বলেন, ‘পুরান ঢাকায় ঈদের মধ্যে সবাই সবার সঙ্গে দেখা করবেই, আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে দেখা করা, তাদের বাড়িতে যাওয়া, আপ্যায়ন, এসব আচার দেখতে পাওয়া যায়।
‘কিন্তু আমরা যারা নতুন ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় থাকি। তাদের মধ্যে এসব নেই। আমরা সর্বোচ্চ বাবা-মা, ভাই-বোন এবং স্ত্রীর বাবা-মায়ের খোঁজ নিয়েই শেষ। কিন্তু পুরান ঢাকায় এমনটা হয় না, ওখানকার মানুষ আত্মীয়স্বজন, পাড়া,-প্রতিবেশী, বন্ধুদের বাড়ি যান, খোঁজখবর নেন।’
হোসনী মোবারক বলেন, ‘আমি নামাজ পড়ে এসে ঘুমালাম প্রায় ২টা পর্যন্ত। দিনই প্রায় শেষ। আর কী করা যাবে? পুরান ঢাকায় গেলে দেখা যাবে, নামাজ থেকে ফিরে তারা একসঙ্গে মজা করে সেমাইয়ের সঙ্গে বাকরখানি মিলিয়ে খাচ্ছেন। আনন্দ করছেন।
‘তাদের মহল্লায় বিভিন্ন মেলা ও উৎসবের আয়োজন থাকে। কিন্তু আমাদের বাচ্চারা তো মাঠই পায় না। আমাদের ঈদ সীমাবদ্ধ। বলতে গেলে, ঘরের ভেতরেই।’
ঈদের খাবারের প্রতি বাড়তি নজর থাকে পুরান ঢাকার বাসিন্দাদের। নাজিরাবাদের বাসিন্দা ইসমাইল আলী বলেন, ‘ঈদের দিন সকাল থেকেই পুরান ঢাকায় বিভিন্ন মুখরোচক খাবার রান্নাবান্না শুরু হয়ে যায়। বিশেষত ঘরের নারীরা ভোর থেকেই ব্যস্ত থাকেন এসব আয়োজনে।’
তিনি জানান, শিরমাল, বাকরখানি, চাপাতি, নানরুটি, কাকচা কুলিচা, নানখাতাই, শিক কাবাব, হাড্ডি কাবাব, মাছ ও মাংসের কোফতা, শামি ও টিকা কাবাব, পরোটা, বোগদাদি রুটি, মোরগ কাবাব, ফালুদার শরবতসহ নানা রকম মুখরোচক এবং ঐতিহ্যবাহী তৈরি করার চেষ্টা করে প্রতিটি পরিবার।
ঈদের দিনে পুরান ঢাকার বাসিন্দাদের কার্যক্রমের বর্ণনা দিতে গিয়ে গবেষক এম মামুন হোসেন বলেন, ‘নারীরা খোরমা খেজুর দুধে ভিজিয়ে রাখেন। সকালে খেতে দেন বাড়ির সদস্যদের। সঙ্গে সেমাই ও অন্যান্য মিষ্টিজাতীয় খাবার। নামাজ থেকে ফিরে আবারও সেমাই, পায়েস, পোলাও-কোরমা, আবার কেউ বিরিয়ানি, খিচুড়ির সঙ্গে রেজালা, টিকিয়া খান।’
তিনি বলেন, ‘পুরান ঢাকার বিভিন্ন মহল্লায় মেলার আয়োজন থাকে। মেলায় মনোহারি পণ্য বিকিকিনি চলে। মেয়েদের হাতের রঙিন কাচের চুড়ির দোকানগুলো চোখে পড়ে ব্যাপক হারে। এ ছাড়া চরকিতে (নাগরদোলায়) চড়ে আনন্দ উপভোগ বিশেষভাবে দৃষ্টিগোচর হয়।’
মামুন হোসেন জানান, অনেক শৌখিন পুরান ঢাকার বাসিন্দারা। ঈদের দিনে গানবাজনারও আয়োজন থাকে বিভিন্ন বাড়িতে, পাড়া বা মহল্লায়। থাকে নাচের পরিবেশনা। এসব আয়োজন পার্থক্য গড়ে পুরান ঢাকাকে নতুন ঢাকার চেয়ে এগিয়ে রেখেছে।