বর্তমান সরকারের আমলে আর নতুন নির্বাচন কমিশনের অধীনে কোনো নির্বাচনে না আসার ঘোষণা থাকায় বিএনপির একাধিক নেতা কুমিল্লা সিটি করপোরেশন নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার আগ্রহ দেখিয়েছেন।
দেশের যে দুটি সিটি করপোরেশনের মেয়র পদটি বিএনপির দখলে আছে তার একটি কুমিল্লা। করপোরেশন প্রতিষ্ঠার পর দুটি নির্বাচনে প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী আওয়ামী লীগের প্রার্থীদের বিরুদ্ধে সহজ জয় পান বিএনপি নেতা মনিরুল হক সাক্কু। এবার তার চোখ হ্যাটট্রিকে।
সেখানে ভোটের তফসিল ঘোষণা হয়ে যাওয়ার পর আওয়ামী লীগের নৌকার প্রার্থী কে হবেন, এ নিয়ে আলোচনা যেমন আছে, তেমনি বিএনপি কি সাক্কুকে হ্যাটট্রিক করার সুযোগ দিয়ে তার হাতে মার্কা তুলে দেবে কি না- এই প্রশ্নও বড় হয়েছে।
গত ২৫ এপ্রিল কুমিল্লা সিটি করপোরেশনের নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা হয়। ভোটের তারিখ ঠিক করা হয় ১৫ জুন। যারা প্রার্থী হতে চান তাদেরকে মনোনয়নপত্র জমা দিতে হবে ১৭ মের মধ্যে। সেই হিসাবে প্রার্থীরা এবার তিন সপ্তাহের মতো সময় পাবেন।
ফেব্রুয়ারির শেষে কাজী হাবিবুল আউয়ালের নেতৃত্বাধীন নির্বাচন কমিশনের প্রথম পরীক্ষা হবে চট্টগ্রাম বিভাগের এই নগরীতে।
বিএনপি সেখানে প্রার্থী ঘোষণা করবে কি না- এ নিয়ে অনিশ্চয়তার মধ্যে দলের অন্তত তিন জন নেতা নানাভাবে ভোটারদের কাছে তাদের আগ্রহের কথা জানাচ্ছেন।
এদের মধ্যে বর্তমান মেয়র সাক্কু এরই মধ্যে আভাস দিয়েছেন, বিএনপি মার্কা না দিলে তিনি স্বতন্ত্র পরিচয়েই প্রার্থী হতে পারেন।
নিউজবাংলাকে তিনি বলেন, ‘আমি এখনও মেয়র। দিন রাত নগরীর বিভিন্ন প্রান্তে ছুটছি। দল নির্বাচনে গেলে মনোনয়ন চাইব। দল নির্বাচনে না গেলে সবার সাথে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেব।’
২০১২ ও ২০১৭ সালের নির্বাচনে সাক্কুকে ভোটে জেতাতে বিএনপির কেন্দ্রীয় নেতাদের মরিয়া চেষ্টা থাকলেও তার সঙ্গে দলের এখন দূরত্বের বিষয়টি স্পষ্ট। তাকে দলের কেন্দ্রীয় নির্বাহী কমিটির সদস্যের পদ থেকে সরিয়ে দেয়ার বিষয়টি প্রকাশ পায় গত ডিসেম্বরে।
এই সিদ্ধান্ত নেয়ার কোনো কারণ উল্লেখ না করলেও সাক্কু সে সময় গণমাধ্যমকে জানান, দলীয় কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ সন্তোষজনক না হওয়ার কারণ ব্যাখ্যা করতে দল থেকে চিঠি পেয়েছিলেন তিনি।
গত বছরের ২২ সেপ্টেম্বর বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সঙ্গে কুমিল্লা বিভাগের জাতীয় নির্বাহী কমিটির সদস্যদের সঙ্গে মতবিনিময় সভায়ও অনুপস্থিত ছিলেন সাক্কু।
গত জানুয়ারিতে নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে বিএনপি কোনো প্রার্থী না দিলেও দলটির নেতা তৈমূর আলম খন্দকার স্বতন্ত্র পরিচয়ে প্রার্থী হন। দলীয় আনুষ্ঠানিক সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে প্রার্থী হওয়ায় তার সব পদ কেড়ে নেয় দল। তবে ভোটের ময়দানে বিএনপির সব নেতা-কর্মীই তার পাশে ছিলেন। এই ভোটে আসলে দলটির নিষ্ক্রিয় হয়ে যাওয়া বহু নেতা-কর্মীকে আবার সক্রিয় হতে দেখা যায়।
সাক্কু ছাড়াও ভোটে আগ্রহী কুমিল্লা দক্ষিণ জেলা বিএনপির সদস্য কাউসার জামান বাপ্পি। তিনি নিউজবাংলাকে বলেন, ‘আমার মাঠ গোছানো রয়েছে। দল নির্বাচনে গেলে মনোনয়ন চাইবো। আশা করি দল অবশ্যই আমাকে মূল্যায়ন করবে।’
বিএনপি কী করবে না করবে- সেই ভাবনা শিকেয় তুলে রেখে ভোটের প্রস্তুতিতে মহানগর স্বেচ্ছাসেবক দলের সভাপতি নিজামউদ্দিন কায়সার। তিনি নিউজবাংলাকে বলেন, ‘দল নির্বাচনে আসবে কি না সেটা কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ সিদ্ধান্ত নেবেন। তবে এই সিটি নির্বাচনে আমি কুমিল্লায় নির্যাতিত নেতাকর্মীদের পরিস্থিতি অনুধাবন করেই প্রার্থী হওয়ার চিন্তা করেছি।’
২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার তিন বছর পর কুমিল্লা সিটির প্রথম নির্বাচনে ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থী আফজাল খানকে প্রায় ৩৫ হাজার ভোটে হারিয়ে নিজের জনপ্রিয়তার জানান দেন।
২০১৪ সালের জাতীয় নির্বাচন বর্জন ও পরের বছর সরকার পতন আন্দোলনে নেমে খালি হাতে ফেরা বিএনপি একে একে সিলেট ছাড়া সবগুলো সিটি করপোরেশন হারিয়ে ফেললেও সাক্কু তার অবস্থান ধরে রাখেন।
২০১৭ সালের নির্বাচনে ব্যবধান কমলেও সেবার আওয়ামী লীগের প্রার্থী আঞ্জুম সুলতানা সীমাকে সাক্কু হারান ১১ হাজার ৮৫ ভোটে।
জয়ের আশায় আওয়ামী লীগে বহু প্রার্থী
অর্থাৎ সিটি করপোরেশন হওয়ার পর প্রথম ভোটের তুলনায় দ্বিতীয় নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ভোটের ব্যবধান কমাতে পারে ২৪ হাজারের বেশি। তৃতীয় নির্বাচনে এসে ব্যবধান ঘুঁচিয়ে জয়ের আশাও করছে ক্ষমতাসীন দল।
কুমিল্লা শহরের এই ভোটে আওয়ামী লীগের টানা পরাজয়ের পরও ভোট এলে প্রার্থী হতে আগ্রহী নেতার অভাব পড়ে না। এবারও ব্যতিক্রম হচ্ছে না।
এবার রোজায় প্রতিদিনই এখানে সেখানে হচ্ছে ইফতার পার্টি। সেখানে সম্ভাব্য প্রার্থীরা অংশ নিচ্ছেন মূলত ভোটের প্রস্তুতি হিসেবে।
দোয়া, মোনাজাত আর ইফতার বিতরণে নিজেদের প্রার্থিতার জানান দিচ্ছেন তারা। বাড়ি বাড়ি গিয়ে খোঁজ নিচ্ছেন ভোটারদের। সেমাই-চিনি প্যাকেট করে পাঠিয়ে দিচ্ছেন। প্যাকেটের গায়ে লেখা থাকে ভোটে আগ্রহী নেতাদের নাম ও তাদের ওয়ার্ড নম্বর। কেবল মেয়র পদে আগ্রহীরাই নন, এভাবে মাঠে থাকছেন সম্ভাব্য কাউন্সিলর প্রার্থীরাও।
নগরীর দেয়ালে লাগানো হচ্ছে নতুন নতুন পোস্টার। তাতে রোজা আর ঈদ শুভেচ্ছার আড়ালেও নিজেদের ছবিটিই ভোটারদের কাছে তুলে ধরছেন সম্ভাব্য প্রার্থীরা। এদের অধিকাংশই আওয়ামী লীগের মনোনয়ন ও সমর্থন প্রত্যাশী।
মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আরফানুল হক রিফাত, শিক্ষা ও মানবসম্পদ বিষয়ক সম্পাদক কবিরুল ইসলাম সিকদার, ত্রাণ ও সমাজকল্যাণ বিষয়ক সম্পাদক নূর-উর রহমান মাহমুদ তানিম, যুব বিষয়ক ও ক্রীড়া বিষয়ক সম্পাদক আনিসুর রহমান মিঠু ও পদে না থাকা সৈয়দ সাফিউল হাসান চিশতী এই নেতাদের মধ্যে অন্যতম।
আরও আছেন কুমিল্লা চেম্বার অব কমার্সের সভাপতি মাসুদ পারভেজ খান ইমরান, মুক্তিযোদ্ধা মেজর মমিন ফাউন্ডেশনের সদস্য সচিব কাজী ফারুক আহাম্মেদ।
গতবার নৌকা নিয়ে লড়াই করা মহানগর আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি আঞ্জুম সুলাতানা সীমার তৎপরতা এবার নেই। তিনি অবশ্য সংরক্ষিত নারী আসনের সংসদ সদস্য। ভোটে দাঁড়াতে হলে তাকে এই পদ ছেড়ে আসতে হবে।
কুমিল্লা দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক যুগ্ম আহ্বায়ক সফিকুল ইসলাম সিকদারও ভোটে আগ্রহী বলে তার সমর্থকরা জানিয়েছেন। তবে তারও প্রকাশ্য তৎপরতা নেই।
নগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আরফানুল হক রিফাত নিউজবাংলাকে বলেন, ‘মেয়র পদে মহানগর আওয়ামী লীগের সভায় আমাকে সবাই সমর্থন দিয়েছেন। আশা করছি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী দলের জন্য আমার অবদানকে মূল্যায়ন করবেন। ’
মহানগর আওয়ামী লীগের যুব বিষয়ক ও ক্রীড়া বিষয়ক সম্পাদক আনিসুর রহমান মিঠু বলেন, তিনি দলের জন্য কাজ করতে গিয়ে তার চারজন কর্মী দুর্বৃত্তদের হাতে নিহত হয়েছে। তিনি ২৩টি মামলায় পড়েছেন। ১৩মাস জেল খেটেছেন। অনেক কর্মী সৃষ্টি করেছেন। এসব কিছু বিবেচনায় মাননীয় প্রধানমন্ত্রী তাকে অবশ্যই মূল্যায়ন করবেন।
ইতিহাস গবেষক আহসানুল কবির বলেন, ‘নির্বাচনে শিক্ষিত ও সংস্কৃতিবান্ধব প্রার্থী চাই। যিনি কুমিল্লা নগরীকে আগামী ১০০ বছরের উপযোগী করে গড়ে তুলতে পারেন।’
সচেতন নাগরিক কমিটি কুমিল্লার সাবেক সভাপতি বদুরুল হুদা জেনু বলেন, ‘মানুষ একটি সুষ্ঠু ভোটের পরিবেশ চায়। তার পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দিতে চায়। নাগরিকের এ দাবি নির্বাচন কমিশন কতটুকু পূরণ করতে পারে তা এখন দেখার বিষয়।’
কুমিল্লা মেডিকেল কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ মোসলেহ উদ্দিন আহমদে বলেন, ‘নগরীর যানজট জলাবদ্ধতা নিরসনের দাবি নগরীর প্রতিটি মানুষের। নগরীর পুরাতন গোমতীকে সাজানো গেলে নগরীর সৌন্দর্য বৃদ্ধি পেতো। আগামী নির্বাচনে এসব বিষয়ে সুস্পষ্ট প্রতিশ্রুতি প্রত্যাশা করছি।’