বোরো ফসল উঠার মৌমুসে কৃষকের ঘরে ঈদের যে আনন্দ থাকার কথা, তা নেই এবার শেরপুরের কয়েক হাজার ঘরে।
ঝড় ও শিলা বৃষ্টিতে ফসল হারিয়ে চিন্তা ও হতাশায় ভুগছে এই পরিবারগুলো। বছরের বাকি সময় কীভাবে কাটবে এ নিয়ে দুচিন্তার মধ্যে ঈদ বাড়তি এক বোঝা তাদের।
জেলার ৫২টি ইউনিয়ন ও চারটি পৌর এলাকায় এ বছর ৯১ হাজার পাঁচ শ হেক্টর জমিতে বোরো ধানের আবাদ করা হয়েছে। কিন্তু গত ১৯ এপ্রিল ভোরে ঘণ্টাব্যাপী শিলা বৃষ্টি ও ঝড়ের তাণ্ডবে শ্রীবরদী, ঝিনাইগাতী ও শেরপুর সদর উপজেলার ৭ ইউনিয়নের দুই হাজার একর জমির বোরো ধানের আবাদ ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
এ এলাকার এক হাজার ২০০ একর জমির ধান নষ্ট হয়েছে। আংশিক ক্ষতি হয়েছে আরও ৮০০ একর জমির। সবজির ক্ষয়ক্ষতি আরও বেশি।
আবার টিনের ঘরের চাল ছিদ্র হয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে শতশত ঘর-বাড়ি। এতেও বেড়েছে মেরামতের বোঝা।
শ্রীবরদীর কুরুয়া, কুড়িকাহনিয়া, গোশাইপুর, মাটিয়াকুড়া, জঙ্গলখিলা ও ঘোনাপাড়ার এক ফসলা জমি হওয়ায় বোরোর ওপর নির্ভর করে কৃষকের সারা বছরের জীবিকা। ছেলেমেয়েদের পড়ালেখা, বিয়ে-শাদি, আনন্দ-উৎসবও নির্ভর করে এর ওপর।
এবার ফসল ফলেছিল হয়েছিল ভালো। কৃষকরা আশা করেছিল, ধান বিক্রি করে ঋণ ও চাষ এবং সেচের টাকা পরিশোধ করে বেশ লাভ হবে। কিন্তু হয়েছে উল্টো। এখন সবার দুশ্চিন্তা কীভাবে পরিশোধ করবো ঋণ, সেচ ও জমি চাষের বিল। সারা বছরের খাওয়া পরারই বা কী হবে। ছেলে মেয়েদের বায়না জামা-কাপড়ও কিনতে দিতে পারছে না বহুজন।
গোশাইপুরে কৃষক জারুল ইসলাম বলেন, ‘দেড়কুড় জমি লাগাইছিলাম। সম্পুর্ণ জমিন হিলে (শিলাবৃষ্টি) খাইয়া গেছেগা। এহন আমগর চলার কোনো পথও নাই। কীভাবে চলমু? ৪০ হাজার টাহা ঋণ করছিলাম, ধান বেইচা ঋণ শোধ করমু বইলা। তাও পাইলাম না। গরুযে খাওয়ামু খেড়ও নাই। ঈদ আইয়া পরছে। দুইদিন পরেই ঈদ পোলাপানগরে কিছু কিন্না দিবার পাই নাই। আমাগর ঈদ এইবার শেষ।’
কুড়িকাহনিয়ার রহমত মিয়া বলেন, ‘দুইকুর ধান আবাদ করছি। ৩০-৩৫ হাজার টাহা ঋণ করছি। টাহা পইসা নাই। এক ছটাক ধানও পামু না। ঋণ দফা কিয়া হুজমু এইলা। বাড়িত খাওনা নাই। পোলাপানের ঈদের খরচ কিছুই করা হামুনা। এক ফসলা জমিন এইলা। সারাবছর কী কইরা খামু এহন?’
কৃষানী মলেদা বেগম বলেন, ‘এহন তো ধান কাডা শুরু করতাম আমরা। টাহারও অভাব থাকত না। কিন্তু হিলে তো সব শেষ কইরা দিছে। ধান যা লাগাইছিলাম কিছুই নাই। পুকুরও মাছ আছিল তাও আস্তে পানি নষ্ট হইয়া মইরা গেতাছে। ঈদ কাপড় চোপড়ও কিনি নাই এইবার। পোলাপান নিয়া খুব কষ্টে আছি। আমাদের ঘরে খাওনই নাই।’শিশু বয়সেই নাঈম মিয়া পরিবারের বিপদটা বুঝতে পেরেছে। সে বলে, ‘আমগর তো সব শেষ। আমগর বাপ-মা এই সময়ে ফসল কাইটা ঈদের জামা কাপড় কিন্না দিতো। আমগর এইবার ফসল কাটাও নাই ঈদও নাই।’
কিশোর সাদিকুল ইসলাম বলে, ‘এইবার আমাদের যে অবস্থা শিল পইরা তো সব ধান শেষ। তার জন্য আমাদের বাবা-মা ঈদে নতুন কাপড় চোপড় কিনে দিতে পারতাছে না। আমগর এইবার আর নতুন কাপড় পইরা ঈদ করা হবে না।’শেরপুর জেলা প্রশাসক মোমিনুর রশীদ বলেন, ‘এ ক্ষয়ক্ষতি সরকারের একার পক্ষে পুষিয়ে দেয়া সম্ভব নয়। আমরা আমাদের সীমিত সামর্থ্যের মধ্য দিয়ে এক লক্ষ টাকা ও ২০ মেট্রিক টন চাল বিতরণ করেছি। আরও বরাদ্দের জন্য চাহিদাপত্র মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছি। ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদেরকে কৃষি প্রণোদনার মাধ্যমে ঘুরে দাড়ানোর সুযোগ করে দেব।’