নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে ঢাকা-রংপুর মহাসড়কে তিন চাকার যানবাহন চলাচল করছে। ফলে ঈদযাত্রার এই সময়ে দুর্ঘটনার ঝুঁকি বাড়ছে।
ঝুঁকি এড়াতে মহাসড়কে তিন চাকার অটোরিকশা না চালাতে বিভিন্ন এলাকায় বেশ কিছুদিন থেকে মাইকিং করছে হাইওয়ে পুলিশ।
সেই নির্দেশকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে অটোরিকশা চালিয়েই যাচ্ছেন চালকরা।
হাইওয়ে পুলিশের এক কর্মকর্তা বলেন, ‘সড়কে দুর্ঘটনার অন্যতম অটোরিকশা ও পথচারীদের বাঁচানোর চেষ্টায় হয়। কিছু দুর্ঘটনা হয় রাতে, সেগুলো চালকদের অসাবধানতার কারণে হয়।’
মহাসড়কটির রংপুরের পীরগঞ্জ থেকে নীলফামারীর সৈয়দপুর অংশে প্রায় ৮০ কিলোমিটার এলাকায় সরেজমিনে ঘুরে দেখা গেছে, প্রতি এলাকায় অবাধে চলাচল করছে ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা, রিকশা ও ভ্যান। কোথাও কোথাও প্রকাশ্যেই চলছে নছিমন, করিমন, ভটভটিও।
মহাসড়কের সাদুল্লাপুরের ধাপেরহাট, পীরগঞ্জ বাজার, বড়দরগা, শঠিবাড়ি, মিঠাপুকুর, জায়গীরহাট, মডার্ন মোড়, দর্শনা, টার্মিনাল, মেডিক্যাল মোড়, সিও বাজার, হাজিরহাট, তারাগঞ্জসহ অর্ধশত এলাকায় স্ট্যান্ড করে তিন চাকার যানবাহন চলাচল করতে দেখা গেছে।
মহাসড়কের ওপরেই এইসব এলাকায় সারি সারি ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা দাঁড়িয়ে আছে। অনেকটা অঘোষিত অটো স্ট্যান্ড। সেখান থেকে চালকরা ডেকে ডেকে যাত্রী তুলছেন। সেখান থেকে মহাসড়ক দিয়ে বিভিন্ন গন্তব্যে ছুটছেন তারা।
২০১২ সালের অক্টোবরে উচ্চ আদালত মহাসড়কে তিন চাকার সিএনজিচালিত অটোরিকশা চলাচলে নিষেধাজ্ঞা জারি করে। একটি মহল এই নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে মহাসড়কে এসব অবৈধ যান চালিয়ে আসছে।
দুর্ঘটনা রোধে মহাসড়কে তিন চাকার রিকশা, অটোরিকশা, ভটভটি, নছিমন, করিমন বন্ধে পরিবহন দর্মঘটও একাধিবার করেছেন পরিবহন শ্রমিকরা।
স্থানীয় প্রশাসনের আশ্বাসে সেই ধর্মঘট প্রত্যাহার হলেও কিছুদিন পর আগের অবস্থাই চলে সব।
স্থানীয়রা বলছেন, হাইওয়ে পুলিশকে ম্যানেজ করে এসব তিন চাকার বাহন চলছে সড়কে।
এ নিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন মহাসড়কটি দিয়ে চলাচলকারী বিভিন্ন পরিবহনের চালক ও যাত্রীরা।
রংপুর বিভাগের প্রবেশদ্বার মডার্ন মোড়ে বৃহস্পতিবার দেখা গেছে, দূরপাল্লার বাস ট্রাকের সঙ্গে অটোরিকশাও যাত্রী তুলছেন। সেখান থেকে মহাসড়কের ওপর দিয়ে মিঠাপুকুর, শঠিবাড়ি, ধাপেরহাট, সাদুল্লাপুর, পীরগঞ্জ যাতায়াত করছে।
অটোচালক মেসবাহ উদ্দিন বলেন, ‘আমরা যকন (যখন) অটোচলাই তকন সাইড দিতে চায় না। চাপ দিবের ধরে। তকন গাড়ি হ্যালি পড়ে যায়। রাস্তার নিচোত পড়ে। যাত্রীদের হা, পাও (পাত,পা) ভাঙে।
‘গাড়ি খালি সো সো করে যায়। কলিজা সাৎ সাৎ করে।’
তিনি বলেন, ‘বাড়িত বউ, বাচ্চা আছে পেটোর দাহে (পেটের কারণে) গাড়ি নিয়ে আসি। জীবন বাচপার যায়া অনেক সময় গাড়ি নিচোত নামে দেয়া লাগে।’
আরেক অটোচালক মেহেরুল ইসলাম বলেন, ‘সড়কে কাচ চলোছে (কাজ চলছে), বাসের ড্রাইভারা উল্টোপাল্টা করি গাড়ি চলায়। এ্যাপাশে (এক পাশে) একবার ওপাশে একবার যায়। বোঝা যায় না কোন পাকে যাবে গাড়িটা।
‘হুরহুর করি গাড়ির খুব কাছ দিয়ে যায়। আমরা মরলে ওমার কী?’
গাড়ি মহাসড়কে চলা নিষেধ তবুও কেন চালান, এমন প্রশ্নের উত্তরে দর্শদাস এলাকার অটোচালক জহুরুল ইসলাম বলেন, ‘আমার এক ছেলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে, আরেক ছেলে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে, মেয়েটা একটা কলেজে পড়ে। তাদের টাকা দেয়া লাগে। কোটে পাই টাকা।
‘বাপের এক ছটাক জমি নাই। হাতের ওপর চলি। হয় জীবন না হয় সংসার। এইভাবে ঝুঁকি নিয়ে জীবন হাতোত নিয়ে চলাই আর কী?’
ইদ্রিস আলী বলেন, ‘মামলা দেয় পুলিশ কিন্তু এমনে এমনে কি কাউও গাড়ি চলায়। আমরা তো গরিব মানুষ। আমাদের এখানে সবাই উস্টে (হোচট) খায়?’
অটোরিকশার যাত্রী ছিদ্দিকুর রহমান বলেন, ‘আমরা জায়গীরহাট যাবো। এখান (মডার্ণ) থেকে পাঁচ/ছয় কিলোমিটার দূর। তাই অটোতে উঠচি। কিন্তু বাস যখন যায় তখন ভয় লাগে। তা ছাড়া কে আগে যাবে কে পরে যাবে এমন প্রতিযোগিতা চলে রাস্তায়। এজন্য ভয়টা বেশি।’
ঢাকাগামী আগমনি পরিবহনের চালক রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘অটোচালকরা ডানপাশ বামপাশ বোঝে না, হঠাৎ একপাশে গাড়ি ঢুকিয়ে দেয়।
‘দেখতে দেখতে ব্রেক করা কঠিন হয়ে পড়ে। অনেক সময় বেঁচে যাই, অনেকেই দুর্ঘটনার কবলে পড়েন। দেখা নাই, শুনা নাই হুরহুর করি (হুট করে) এপাশ থেকে ওপাশ যায়। এটা খুবই অসুবিধা। অনেক সময় যানজট লাগে।’
রংপুর থেকে সিরাগঞ্জ পর্যন্ত চলাচল করা সোহাগ পরিবহনের চালক ফারুক হোসেন বলেন, ‘ওরা জানে না কীভাবে মহাসড়কে গাড়ি চালাতে হয়। অনেক সময় তারা হুট করে দ্রুতগতির গাড়ির সামনে চলে আসে। তখন যে কী পরিমাণ কষ্ট হয় গাড়ি দাঁড়া করাতে, সেটা চালকরাই বলতে পারবেন।
‘এতগুলো যাত্রী বাসে থাকে সবার নিরাপত্তার কথা ভাবতে হয়। এমনকি অটোতে যে যাত্রী থাকে তারাও তো রিকসে থাকেন তাই না, এজন্য আমাদের সমস্যা। বিশেষ করে সন্ধার পর এগুলো আরও সমস্যা। অনেক সময় লাইট ছাড়াও চলে।’
রংপুর মোটর শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক এম এ মজিদ বলেন, ‘মহাসড়কে তিন চাকার যান চলচল বন্ধ করতে বহু আন্দোলন করেছি। কিন্তু বন্ধ হয়নি। ‘অথচ, সড়কে দুর্ঘটনা ঘটলে চালক হয় ঘাতক। মামলা হয় চালকের নামে। আমরা চাই মহাসড়কে এসব অবৈধ চান চলাচল বন্ধ হোক। প্রশাসন দ্রুত বন্ধ করুক।’
বগুড়া হাইওয়ে পুলিশের (রংপুর অঞ্চল) সহকারী পুলিশ সুপার জাহিদুল ইসলাম নিউজবাংলাকে বলেন, ‘এসব নিষিদ্ধ যানবাহনের বিরুদ্ধে আমাদের সারা বছরই ব্যবস্থা চলমান আছে। দৈনিক ২০ থেকে ২৫টা মামলা দেয়া হচ্ছে। অনেক সময় এসব গাড়ি আটক করে আইনি ব্যবস্থা নেয়া হয়।
‘ঈদে যাতে যানজট এবং দুর্ঘটনা রোধ হয় সে জন্য সড়ক বিভাগ এবং সাসেকের (৬ লেন প্রকল্প) সঙ্গে আমরা বসেছি। ধাপেরহাট থেকে মডার্ন পর্যন্ত যেখানে খানাখন্দ রয়েছে সেখানে তারা চলাচলের উপযোগী করেছেন।’
পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, ‘গাড়িগুলো ডানে যাবে, নাকি বামে এজন্য অ্যারো (তীর) চিহ্ন বসানো হয়েছে। মিঠাপুকুর, শঠিবাড়িতে গাড়িগুলো কোন লেনে চলবে তা প্রচারে মাইক বসানো হয়েছে।
‘ঝুঁকিপূর্ণ এলাকাগুলোতে হাইওয়ে পুলিশ থাকবে, স্ব স্ব থানার পুলিশ এবং সড়ক বিভাগের লোকজন থাকবে। তারা রোটেশন ডিউটি করবে।